তাহাদের চিলেকোঠা
- রাইদা তাসনিম ইসলাম
‘আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম—বিখ্যাত গায়ক নচিকেতা তার গানের সুরে এইভাবে বয়ান করেছেন বৃদ্ধদের জীবনযাপন, অনুভুতি। কীভাবে বছরের পর বছর পরিবার ছেড়ে আলাদা হয়ে অজানা পরিবেশে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে হয়, সাধারণ মানুষ হিসেবে এর ব্যখ্যা বুঝা অনেক কঠিন।
জার্মান চান্সেলর অট্ট ভন বিসমার্ক সমাজের অবহেলিত প্রবীণদের সুব্যবস্থামূলক বসবাসের জন্য ১৮৮০ সালের দিকে একটি সমাজনীতি আইন পাস করেন যেখানে ফুটে উঠেছে প্রবীণদের থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থার সঙ্গে, সুচিকিৎসা, বিনোদন ইত্যাদি বিষয়। এই আইনের প্রয়োগে ভারতে প্রথম ‘নেম্মাদ বিশরান্থি ধাবা’ নামক সমাজমূলক প্রবীণদের জন্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠে। এরই অনুকরণে আজ দেশে-বিদেশে গড়ে উঠেছে এই সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান। যেখানে দেখাশোনার পাশাপাশি থাকে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা।
রাজধানীর আগারগাও এলাকায় এরকম সুব্যবস্থামূলক সাড়ে ৭ একর জমিতে গড়ে উঠেছে প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরা বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান, যা একইসাথে হাসপাতাল, ইনস্টিটিউট ও নিবাস হিসেবে চলছে। তের কক্ষ বিশিষ্ট এই নিবাসে রয়েছে প্রবীণদের জন্য সুব্যবস্থা, রয়েছে একটি বাগান এবং অত্যাধুনিক হাসপাতাল যেখানে ২৪ ঘন্টা সেবক-সেবিকা পর্যবেক্ষণে থাকেন। ‘এই প্রতিষ্ঠানের মুল নীতি হচ্ছে প্রবীণদের সরবাক্ষণিক সকল সুবিধা দেওয়া। বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশে ৬২ এবং এরচেয়ে বেশি বয়সী প্রবীণরা এর ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারবে’—বললেন প্রতিষ্ঠানের সাধারণ নির্বাহী পরিচালক মাসুম আশরাফুল আলম। তিনি আরো বলেন, আমাদের এই প্রতিষ্ঠান শুরু হয়েছে প্রায় দুই দশক হলো। আমি দায়িত্বে আছি ২০১৩ সাল থেকে। এই জায়গারটির বিশেষত্ব হলো, এর পরিবেশ। সারাদিন কাজ করার পরও কোনো ক্লান্তি আসে না। এক অন্য ধরনের মায়া জড়িয়ে আছে এই জায়গায়।এই প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে রয়েছে প্রায় ২৫-৩০ জন প্রবীন এবং ৩৫ এর উপরে কর্মচারী। এই প্রবীণদের মধ্যে এমন ৫-৬ জন রয়েছেন যারা ৮ বছর ধরে থাকছেন। এমন একজন আছেন আনোয়ারা বেগম, যিনি এই নিবাসে বর্তমানে থাকা জ্যৈষ্ঠ বৃদ্ধা। তিনি বলেন, আমার তো মনেই পড়ছে না আমি কবে এখানে এসেছি। আমার তো মনে হয় আমি আমার পুরোটা জীবন এইখানে রয়েছি। আর যে কদিন বেঁচে থাকব এখানেই থাকব।
গত ৩ বছর ধরে এখানে আছেন অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর দেবাশিষ আনন্দ। তিনি বলেন, আমি চাকরি করতাম খুলনা শহরে, আমার পৈতৃক বাড়িও সেখানে। ২০১৭ সালে আমার মেয়ে আমাকে এখানে রেখে যায় ভালো থাকবার আশ্বাসে। মেয়ে, জামাই নাতিরা আসে মাসে একবার, কিছুক্ষণ থেকে চলে যায়। আপনার সময় কিভাবে কাটে জানতে চাইলে বলেন, সময় চলে যায়, গল্প করি, বাগানে একটু হাঁটাহাটি করি, এইভাবেই সময় পার করি।
প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক মাসুম বলেন, সপ্তাহে প্রায় প্রতিদিন পরিবারের সদস্যরা আসতে পারবেন। তবে দেখা করতে হলে অফিসের সময় ধরে আসতে হয়। সকাল ৮ থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত পরিবারের সদস্যরা এসে সময় দিতে পারবেন।
কি কি বিষয়ে লক্ষ্য রাখা হয় যখন কোন নতুন সদস্য থাকতে আসেন? এর উত্তরে বলেন, ‘এখানে প্রত্যেকেই পরিবারের সদস্যের মতো। যখন কেউ আসেন আমরা তার মানসিক বিষয়টা বুঝার চেষ্টা করি, তার পছন্দ, অপছন্দ ইত্যাদি বিষয় মাথায় রাখা হয়। বিনোদন হিসেবে এইখানে বছরে একবার বড় পিকনিকের ব্যবস্থা করা হয়।’
রাজধানীর কোলাহলময় শহরে এই রকম প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে গিয়ে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে নির্বাহী পরিচালক মাসুম বলেন, ‘আসলে এই বিষয়ে আমাদের হাতে কিছু করার নেই, অনেক কিছু মানিয়ে চলতে হয়, আমরাও মানিয়ে নিয়ে চলছি’।
এইখানে যারা রয়েছেন তারা প্রত্যেকেই নিজের জন্য এক ছোট্ট চিলেকোঠা বানিয়ে নিয়েছেন। সবারই চোখে অনেক প্রশ্ন কিন্তু উত্তর দেওয়ার মত কেউ নেই। ‘এটাই আমাদের চিলেকোঠা আর শেষ ঠিকানা’—বলছিলেন আনোয়ারা বেগম, নিবাসের এক বৃদ্ধা।