ঘরে থাকুন, বই পড়ুন
- হাছিবুল বাসার মানিক
বই হচ্ছে মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। যার সঙ্গে পার্থিব কোনো সম্পদের তুলনা হতে পারে না। একদিন হয়তো পার্থিব সব সম্পদ থাকবে না, কিন্তু একটি ভালো বই থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান কখনো নিঃশেষ হবে না। চিরকাল অন্তরে জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখবে। আমাদের মধ্যে হয়তো অনেকের জানা আছে, এ পর্যন্ত যাঁরা বিশ্বের বুকে সফল হয়েছেন, তাঁরা কতটা বই পড়তে আগ্রহী ছিলেন। জীবনে সফল হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা বই পড়া থেকে নিজেদের বঞ্চিত রাখেন না। বই পড়ার মধ্য দিয়ে রোজ নিজেকে সমৃদ্ধ করে তোলেন।
বই পড়ার অনেক উপকারিতা রয়েছে। বই পড়ার মাধ্যমে আমাদের জ্ঞানের পরিধি ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করে। মানসিক উদ্দীপনা ও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, যা মস্তিষ্ককে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। মানসিক চাপ দূরীভূত করে এবং মনোযোগ বৃদ্ধিতে যথেষ্ট কার্যকর ভূমিকা পালন করে। অন্যের বই পড়ে অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে জীবনে সফল হওয়ার পথ জানা যায়। তা ছাড়া আমাদের মনন জগতের কল্পনাশক্তি বৃদ্ধি পেতে সহায়তা করে বই। বই পড়ার মাধ্যমে মানুষের প্রচুর অনুশীলন হয়, ফলে মস্তিষ্কের স্মৃতিশক্তির বৃদ্ধি ঘটে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ভাষার বই পড়ার মাধ্যমে আমাদের ঝুলিতে নতুন নতুন শব্দ যুক্ত হয়, যার মাধ্যমে আমাদের বাচনভঙ্গিকে স্পষ্ট, সুন্দর ও তাৎপর্যমণ্ডিত করে তুলতে পারি। নিয়মিত বই পড়ার ফলে ভাবনার প্রকাশক্ষমতা বেড়ে যায়। যার ফলস্বরূপ নিজস্ব লেখনীশক্তি বৃদ্ধি ও স্বাতন্ত্র্য খুঁজে পাওয়া যায়। এ ছাড়া মানুষের মধ্যে সংলাপের দক্ষতা বৃদ্ধি, মানসিক প্রশান্তি দান, একাকিত্ব দূর, চিন্তাশক্তির বিকাশ, আত্মসম্মানবোধ, সহানুভূতিবোধ জাগিয়ে তুলে।
বই পড়ার উপকারিতা নিয়ে বিখ্যাত ব্যক্তিদের উক্তিগুলোর মাধ্যমে আমরা জানতে পারি বই পাঠের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও ফলাফল। নিচে বই পাঠ্যাভ্যাসের উপকারিতা নিয়ে বিখ্যাত মনীষীদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ উক্তি উল্লেখ করা হলো—
১. বই পড়ার অভ্যাস নেই আর পড়তে জানে না এমন লোকের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। (মার্ক টোয়েন)
২. গৃহের কোনো আসবাব বইয়ের মতো সুন্দর নয়। (সিডনি স্মিথ)
৩. বই কিনে কেউ কোনো দিন দেউলিয়া হয় না। (প্রমথ চৌধুরী)
৪. বই হচ্ছে মস্তিষ্কের সন্তান। (সুইফট)
৫. একটি বই পড়া মানে হলো একটি সবুজ বাগানকে পকেটে নিয়ে ঘোরা। (চীনা প্রবাদ)
৬. বই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ আত্মীয়, যার সঙ্গে কোনো দিন ঝগড়া হয় না,কোনো দিন মনোমালিন্য হয় না। (প্রতিভা বসু)
বর্তমানে করোনাভাইরাসের কারণে আমাদের বাধ্য হয়ে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে হচ্ছে। হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা লোকজনের জন্য বই হতে পারে সময়ের সেরা এক সঙ্গী। কোয়ারেন্টিনে থাকা অবস্থায় আপনি এমন এক অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেন যা মহামারি-লগ্নে কিংবা মহামারি-উত্তর গোটা জাতিকে পথ দেখাতে সক্ষম। এমন অনেক উদাহরণ পাওয়া যাবে, অতীতে পাঠক ছিলেন। সময়ের পরিক্রমায় ব্যস্ততায় সে অভ্যাস ভোঁতা হয়ে গেছে। করোনা মহামারির সময় বই পড়ে নিজেকে ঝালিয়ে দেশের কল্যাণে এগিয়ে আসুন। ঘরে বসে নিজের সুন্দর সময়গুলো অযথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, টিভিসহ অন্যান্য বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডে নষ্ট করবেন না।
বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্পের জনক বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জনপ্রিয় ছোটগল্পের সংকলন ‘গল্পগুচ্ছ’ পাঠের মাধ্যমে বাংলা ছোটগল্পে তাঁর সময়কালের সমাজবাস্তবতা, সামাজিক দৃশ্যপট, দৃষ্টিভঙ্গি জানতে পারি। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় প্রকাশিত এবং গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২ খণ্ডে ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে প্রকাশিত হয়েছে। এর মাধ্যমে বিশ্বকবিকে জানা সম্ভব। শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’, ‘শ্রীকান্ত’, ‘মেজদিদি’, ‘দেবদাস’ উপন্যাসের মাধ্যমে পাঠক তাঁর অন্তর জুড়াতে পারেন। এ সময়ের তরুণ-তরুণীদের কাছে জনপ্রিয় লেখক আহমদ ছফার ‘ওঙ্কার’, ‘গাভী বৃত্তান্ত’, ‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী’, ‘যদ্যপী আমার গুরু’, ‘বাঙ্গালি মুসলমানের মন’ হয়ে উঠতে পারে সমাজ রূপরেখার পরিবর্তনের প্রতিবিম্ব মূর্তি হিসেবে। এ ছাড়াও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ মুজতবা আলী, প্রমথ চৌধুরী, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা হয়ে উঠতে পারে পাঠকদের প্রথম পছন্দ।
আর যাঁরা মুক্তিযুদ্ধকে ভালোভাবে জানতে চান, তাঁরা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বই পড়তে পারেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’, ‘আমরা দেখা নয়া চীন’ বইগুলোর মাধ্যমে জাতির পিতার সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞান লাভ করা যাবে। জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’, এম আর আখতার মুকুলের ‘আমি বিজয় দেখেছি’, সেলিনা হোসেনের ‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’, আনোয়ার পাশার ‘রাইফেল রোটি আওরাত’, মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘আমার বন্ধু রাশেদ’, মইদুল হাসানের ‘মূলধারা একাত্তর’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘নিষিদ্ধ লোবান’, অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসের ‘দ্য রেইপ অব বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশ: রক্তের ঋণ’, হুমায়ূন আহমেদের ‘জোছনা ও জননীর গল্প’, ‘আগুনের পরশমণি’, ‘দেয়াল’ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উল্লেখযোগ্য রচনা। এসব বই পাঠ করে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানা সম্ভব।
তা ছাড়া দেশি-বিদেশি বিখ্যাত লেখকের প্রবন্ধ, কবির কাব্য, ফিকশন কিংবা নন ফিকশন, ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে নিজের জীবনকে সুন্দর ও নৈতিকতায় পরিপূর্ণ করুন, যা সুস্থ, সুন্দর জীবনযাপনে আপনাকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি জোগাবে। নিজে বই পড়ার পাশাপাশি আপনার বন্ধুকে বই পড়ায় উৎসাহী করে তুলুন। সমাজকে কুসংস্কারের প্রভাবমুক্ত করতে, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়তে, হোম কোয়ারেন্টিনে আপনার মনকে প্রাণবন্ত ও সতেজ রাখতে বই পড়ার বিকল্প নেই। আসুন আমরা বই পড়ার মাধ্যমে সুস্থ, সুন্দর জীবনযাপনের মাধ্যমে পার করি কোয়ারেন্টিনের একেকটা দিন।
*লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়