ভালো থাকবেন জেআরসি স্যার!
- খাজা রহমান
পিএইচডি গবেষণারত বাংলাদেশি এক ছাত্রের অসাধারণ প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসর নাকি বুয়েটের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলরকে চিঠিতে অনুরোধ করে লিখেছিলেন, “প্লিজ সেন্ড মোর জেআরসি”। সংক্ষেপে ওনাকে JRC নামে ডাকা হতো।
বড় বড় অঙ্কের হিসাব বা যে কোন জটিল সমস্যার সমাধান তিনি নাকি কোনো ক্যালকুলেটর ছাড়াই অনায়াসে করে ফেলতে পারেন। বুয়েটের ইতিহাসে একমাত্র তিনিই রেকর্ড শতকরা ৯৫ শতাংশ নম্বর পেয়ে অনার্সসহ প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অর্জন করে শিক্ষক হয়েছেন। আমেরিকার ১১০ তলা সিয়ার্স টাওয়ারের ডিজাইনার বিশ্ববিখ্যাত প্রকৌশলী ফজলুর রহমান খান এর সঙ্গে কাজ করার অফার পেয়েও শুধুমাত্র দেশের প্রতি দায়বদ্ধতায় ১৯৭১ সালে তিনি দেশে ফিরে এসেছিলেন।
তার সম্পর্কে এইরকম আরও অসংখ্য তথ্য অনেকটা মিথের মত প্রচলিত ছিল আমরা যখন সিভিল ইন্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র হিসেবে ক্লাস শুরু করি। সিনিয়র ভাইয়েরা সেই লেজেন্ডারি গল্পগুলো বলতেন আর আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো ‘হা’ করে শুনতাম।
তখন থেকেই অধীর আগ্রহে আমরা অপেক্ষা করতে থাকলাম সেই জেআরসি স্যারের ক্লাস করার মাহেন্দ্রক্ষণটির জন্য। অবশেষে লেভেল ৪, টার্ম ১ এর স্ট্রাকচারাল এনালাইসিস এন্ড ডিজাইন (পার্ট ৩) ক্লাসে গিয়ে মিললো ওনার দেখা।
মোটা ফ্রেমের চশমা চোখে নিতান্তই সাদামাটা নিপাট এক ভদ্রলোক ক্লাসে ঢুকলেন। রোল কল শেষে বোর্ডে একটা সমস্যা লিখলেন। এরপর ভয়াবহ ক্ষিপ্রতায় বোর্ডের এক মাথা থেকে শুরু করে অন্য মাথায় গিয়ে উত্তর বের করে ফেললেন!
আমাদের মতো কয়েকজন তখন রীতিমত তব্দা খেয়ে বসে আছি! বিষয়টা অনেকেরই মাথার উপর দিয়ে গেছে বুঝতে পেরে উনি একটু মুচকি হেসে ধীরে ধীরে প্রতিটি অংশ ভাগ করে করে বুঝিয়ে দিলেন। চোখ জুড়ানো হাতের লেখা আর ব্ল্যাকবোর্ডে আঁকানো তার ড্রয়িংগুলো!
আমাদের সেই লিভিং লেজেন্ড জেআরসি স্যার আজ একাধারে গবেষক, শিক্ষাবিদ, অসংখ্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পরামর্শক, আছেন সফটওয়্যার ও তথ্য প্রযুক্তি উন্নয়নে, গণিত অলিম্পিয়াডে, পদ্মা সেতু নির্মাণ প্যানেলের প্রধান হিসেবে, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের প্রধান হিসেবে, ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি। বর্তমানে কর্মরত ছিলেন ইউএপির উপাচার্য হিসেবে।
একান্ত নিভৃতচারী আর প্রচারবিমুখ এই মানুষটি অনেক দেরিতে হলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে পেয়েছেন গুণী ব্যাক্তির সন্মান আর পুরষ্কার, ভূষিত হয়েছেন এবারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শাখায় “একুশে পদকে (২০১৭) ”।
আমাদের সকলের প্রিয় সেই জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারের আজ আর আমাদের মাঝে নেই। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
দেশ-বিদেশের লাখো খবরের ভিড়েও আপনি হারিয়ে যাবেন না স্যার। সবার অনুপ্রেরণা, আদর্শ আর আলোর দিশারী হয়ে আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন আজীবন, এটাই প্রার্থনা।
অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সকল ছাত্র-ছাত্রী ও বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বুয়েট অ্যালামনাইদের পক্ষ থেকে আপনার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। সশ্রদ্ধ সালাম রইলো স্যার। ওপারে ভালো থাকবেন।
খাজা রহমান : বৈজ্ঞানিক গবেষক। জার্মানি থেকে।