তিয়ানজিন বিনহাই লাইব্রেরি: বইপ্রেমীদের ভূস্বর্গ

তিয়ানজিন বিনহাই লাইব্রেরি: বইপ্রেমীদের ভূস্বর্গ

  • সজল পাইক

লাইব্রেরি শব্দটি শুনলে আমাদের মনে সবসময় যে ছবিটি ভেসে আসে তা মোটামুটি এমনই–এক বা একাধিক সাধারণ পাঠকক্ষ; শিল্প, সাহিত্য, ইতিহাসসহ নানা বিষয়ের বইয়ের সেলফে থরে থরে সাজানো নতুন ও পুরনো নানা বই। কিন্তু গতানুগতিক এই পাঠাগার বা লাইব্রেরির সংজ্ঞা থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে এসে চীনের তিয়ানজিন শহরে সম্প্রতি ২০১৭ সালের শেষভাগে নির্মিত হয়েছে এক অনিন্দ্যসুন্দর ব্যতিক্রমী লাইব্রেরি, নাম তিয়ানজিন বিনহাই লাইব্রেরি।

অবস্থান

চীনের রাজধানী বেইজিং এর অনতিদূরে তিয়ানজিন শহরে সদ্য নির্মিত এই লাইব্রেরির পুরো নাম ‘তিয়ানজিন বিনহাই লাইব্রেরি’। লাইব্রেরিটির সংক্ষিপ্ত নাম The Eye, বাংলা পরিভাষা করলে যার অর্থ দাঁড়ায় ‘চোখ’। স্থাপনাটি বর্তমানে তিয়ানজিন সংস্কৃতি কেন্দ্রের মূল পাঁচ প্রধান আকর্ষণের একটি। সাধারণ লাইব্রেরির গতানুগতিক নকশা এবং স্থাপনা থেকে বেরিয়ে এসে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন আঙ্গিকে নির্মাণ করা হয়েছে এই লাইব্রেরিটি। তিয়ানজিন শহর পরিকল্পনা এবং নকশা বিভাগের সার্বিক সহযোগিতায় নেদারল্যান্ড ভিত্তিক নামকরা স্থাপনা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান MVRDV লাইব্রেরিটির পরিকল্পনা এবং নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করেছে।

গঠনশৈলী

আগেই বলা হয়েছে, অন্য দশটি লাইব্রেরি থেকে যে বিষয়টি এই লাইব্রেরিটিকে পৃথক করেছে তা হলো এর ব্যতিক্রমী গঠনশৈলী। পাঁচটি তলায় সজ্জিত প্রায় ৩৩,৭০০ বর্গ মিটারের এই লাইব্রেরিটিতে বই রাখার জন্য মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত পাকাপাকিভাবে ঢালাই করা স্তর রয়েছে। এই স্তরগুলোতে প্রায় ১.২ মিলিয়ন বই সংরক্ষণ করা সম্ভব। মূল কক্ষের ঠিক মধ্যবর্তী স্থানে একটি করিডোর রয়েছে। উজ্জ্বল, প্রশস্ত এই করিডোরের মানুষ ধারণ ক্ষমতা ১১০ জন। লাইব্রেরিটির ডাকনাম The Eye রাখার কারণটি হচ্ছে, এর অভ্যন্তরীণ গঠন অনেকটা চোখের মতোই। এমনকি বাইরের পার্ক থেকে লাইব্রেরিটির এই চোখা (iris) গঠন খুব সহজেই নজরে পড়ে। লাইব্রেরিটির নির্মাণ বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান MVRDV থেকে এক প্রেস রিলিজে বলা হয়েছিল–

“লাইব্রেরিটির একইসাথে কৌণিক এবং রৈখিক গঠনের পিছনের উদ্দেশ্য হচ্ছে যাতে স্থাপনাটির সর্বোচ্চ ব্যবহার সম্ভব হয়। বই পড়া, হাঁটা, সাক্ষাত এবং আলোচনা- সব কাজেই যেন স্থাপনাটি ব্যবহার করা যায়, এটাই আমাদের  উদ্দেশ্য। সব মিলিয়ে এটা দেখতে হবে একটি চোখের (eye) মতো।’’

লাইব্রেরির প্রথম এবং দ্বিতীয় তলায় মূলত বই পড়ার কক্ষ এবং লাউঞ্জ সুবিধা রয়েছে। উপরের তলাগুলোতে আছে কম্পিউটার কক্ষ এবং সাক্ষাৎকার কক্ষ। পাশাপাশি প্রশাসনিক কাজ পরিচালনা করার জন্য এখানে কক্ষ রাখা হয়েছে। ছাদের উপরের অংশে দুটি বহিঃপ্রাঙ্গণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। পাশাপাশি এখানে রয়েছে একটি বড় অডিটোরিয়াম এবং সংগ্রহশালার মতো আধুনিক সব ব্যবস্থা। নিচতলা শিশু সহ সব বয়সের মানুষের বই পড়ার স্থান হিসেবে খোলা রাখা হয়েছে। এছাড়া এখানে বড়দের জন্য রয়েছে কম্পিউটার সুবিধা, লাউঞ্জ এবং শ্রবণ কক্ষের মতো যাবতীয় সব আধুনিক সুযোগ-সুবিধা।। MVRDV-এর তরফ থেকে CNN-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলা হয়-

চোখাকৃতির নান্দনিক নকশা ভবনটির এমন এক বৈশিষ্ট্য যা একইসাথে বাইরে এবং ভিতর থেকে যে কেউ অনুধাবন করতে পারবেন। এই বিচিত্র নকশাশৈলী সত্ত্বেও ভবনটি তার সব ধরনের উদ্দেশ্য পূরণে পুরোপুরি সফল।

মূল নকশার পরিবর্তন

লাইব্রেরিটি এর নির্মাণ সংস্থা MVRDV থেকে সবথেকে দ্রুত নির্মিত কোনো স্থাপনা। নকশা প্রণয়নের সময় থেকে মাত্র তিন বছরের মধ্যে ভবনটি নির্মাণ করা হয়। ফলে লাইব্রেরির নির্মাণ কাজ দ্রুত শেষ করার তাগিদে এর প্রাথমিক নকশায় বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়। মূল নকশায় অলিন্দে (atrium) বই ব্যবস্থাপনার বিষয়টি থাকলেও দ্রুত কাজ শেষ করার তাগিদে স্থানীয় সিদ্ধান্তে এই পরিকল্পনা বাদ দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে বই রাখার স্তরগুলোতে যাতায়াতের জন্য পেছন দরজা এবং কক্ষের নকশা থাকলেও সেই পরিকল্পনা বাদ দেওয়া হয়। দ্রুততম সময়ে কাজ শেষ করে ভবনটি উদ্বোধন করাই ছিল এই নকশা পরিবর্তনের মূল কারণ। অবশ্য পরবর্তীতে সময় নিয়ে লাইব্রেরিটিকে তার মূল নকশা অনুসারে পুরোপুরি নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।

তাৎপর্য

শুধু একটি বইয়ের লাইব্রেরি হিসেবেই নয়, আরও কয়েকটি বিশেষ তাৎপর্য নিয়ে লাইব্রেরিটি নির্মাণ করা হয়েছে। একটি সার্থক সামাজিক শিক্ষা কেন্দ্র এবং সর্বোপরি পাশের পার্কের সাথে পুরো সংস্কৃতি কেন্দ্রের একটি মেলবন্ধন তৈরি করাই এই লাইব্রেরির একটি বিশেষ উদ্দেশ্য। পুরো পৃথিবী জুড়েই ভবিষ্যতে লাইব্রেরি নির্মাণের এক মডেল হিসেবে দেখা হচ্ছে এই স্থাপনাটিকে। অদূর ভবিষ্যতে পুরো স্থাপনার অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক খ্যাতনামা কয়েকজন স্থাপত্যবিদের সমন্বয়ে আরও চারটি সাংস্কৃতিক ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

জার্মান স্থাপনা সংস্থা  GMP এর নকশা অনুসারে, নির্মিতব্য পুরো সাংস্কৃতিক জেলার আয়তন ধরা হয়েছে প্রায় ১,২০,০০০ বর্গ মিটার। পুরো কাজ সম্পন্ন হলে এই লাইব্রেরিটি পুরনো শহর, আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা, সরকারি আবাসন সবকিছুর মধ্যে এক ‘সংযোগ’ হিসেবে কাজ করবে। এছাড়া প্রয়োজনীয় কোনো ধরনের নির্মাণের জন্য বাড়তি জায়গা রাখা হয়েছে, যাতে স্থান সংকুলান পরবর্তীতে কোনো সমস্যা হয়ে উঠতে না পারে। সর্বোপরি, অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এই লাইব্রেরি নির্মাণের মাধ্যমে এর আশেপাশের আধা সরকারি এলাকার মধ্যে এক চমৎকার সমন্বয় সাধন করা হয়েছে ।

দর্শনার্থী চাপ

আধুনিক স্থাপত্যকলায় নির্মিত অনিন্দ্যসুন্দর লাইব্রেরিটি তার উদ্দেশ্য পূরণে পুরোপুরি সফল। জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিদিনই লাইব্রেরিটি দেখতে আসছেন অসংখ্য দর্শনার্থী। উদ্বোধনের প্রথম সপ্তাহেই লাইব্রেরিটি দেখতে প্রায় ১০ হাজার দর্শনার্থী ভিড় জমান। অনেককেই দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করতে হয়, কেননা একসাথে এই বিপুল সংখ্যক দর্শনার্থীকে ঠাঁই দেবার ধারণ ক্ষমতা নেই ভবনটির। শুধু পাঠক নয়, ছুটির দিনসহ সপ্তাহের  অন্যান্য কর্মমুখর দিনে নয়নভিরাম এই লাইব্রেরিটি একনজর দেখতে ছুটে আসছেন গড়ে প্রায় ১৫ থেকে ১৮ হাজার দর্শনার্থী।

বিতর্ক

শুধু চীন নয়, সম্ভবত পুরো পৃথিবীর ইতিহাসে আধুনিকতম এই লাইব্রেরি নিয়ে একটা বিতর্কের জায়গা থেকে গিয়েছে। বইয়ের জন্য লাইব্রেরিটির মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত পাকাপাকি যে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, এই ব্যবস্থাপনার মধ্যেই রয়েছে কিছু বিচ্যুতি। আগেই বলা হয়েছে, দ্রুত কাজ শেষ করার জন্য এর নকশায় বেশ পরিবর্তন আনা হয়েছিল। এক্ষেত্রে বই রাখার জন্য নির্দিষ্ট স্থানগুলোতে যাতায়াতের জন্য পিছনের দরজাসহ কক্ষ নির্মাণের বিষয়টি প্রাথমিকভাবে বাদ পড়ে। ফলে, এগুলোতে যেমন একদিকে সাধারণভাবে যাতায়াতের জন্য নেই তেমন কোনো নির্দিষ্ট ব্যবস্থা, ঠিক তেমনি বেশ কিছু স্তরে নেই সত্যিকারের বই। এসব স্থানে আপাতত বইয়ের ছবি ব্যবহার করে কাজ চালানো হয়েছে। এই অব্যবস্থাপনার কারণে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতাসহ স্তরগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ কাজটি বেশ কঠিন। এই ত্রুটি সম্পর্কে চীনের সামাজিক মাধ্যমে দর্শনার্থীদের অভিমত অনেকটা এরকম-

“বিনহাই লাইব্রেরি সত্যিই সুন্দর। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আপনি বুঝতে পারবেন না কোন বইগুলো নকল আর কোন বইগুলো আসল।’’

তবে আশার কথা এই যে, অদূর ভবিষ্যতে দরজাসহ কক্ষ নির্মাণের মাধ্যমে এই সমস্যার একটি সমাধান সম্ভব। লাইব্রেরিটির সহকারি পরিচালক লিউ জিউফেংয়ের ভাষ্যমতে, “বর্তমানে লাইব্রেরিটিতে গতানুগতিকভাবে বই রাখার এবং পড়ার জন্য সনাতনী কক্ষও রয়েছে। কিন্তু কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে এর মূল অংশে বই রাখা সম্ভব হচ্ছে না। ভবিষ্যতে এই সমস্যার সমাধান করা হবে।’’

সূত্র: রোর মিডিয়া

ভিডিও: বিজনেস ইনসাইডার

Sharing is caring!

Leave a Comment