কোন দেশে কেমন কোরবানি ঈদ
- ফিচার ডেস্ক
পবিত্র ঈদুল আজহা মুসলিমদের প্রধান দুই ধর্মীয় উৎসবের অন্যতম। এটাকে ত্যাগের উৎসবও বলা হয়। বাংলাদেশের মতই বিশ্বের অনেক দেশেই ব্যাপক উৎসাহ উদ্দিপনায় এ উৎসব পালান করা হয়। আবার অনেক দেশেই উৎসবটি ততটা উৎসাহের সঙ্গে পালন করা যায় না। এসব নিয়েই আমাদের এবারের আয়োজন দেশে দেশে ‘কোরবানি ঈদ’।
ইন্দোনেশিয়া
প্রায় ৫ হাজার দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ইন্দোনেশিয়া। ২০১৫ সালের হিসাব অনুসারে জনসংখ্যা ২,৫৫,৪৬১,৭০০ জন, যার মধ্যে মুসলিম ধর্মাবলম্বী ৮৭ দশমিক দুই শতাংশ। ইন্দোনেশিয়ায় ঈদুল আজহা উপলক্ষে তিন দিনের সরকারি ছুটি থাকে। এ দিনে ইন্দোনেশীয় মুসলমানরা সকালে নামাজ ও খুতবার মধ্য দিয়ে ঈদের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেন। তার পর গবাদিপশু যেমন- গরু, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি কোরবানির মাধ্যমে ঈদুল আজহার মূল আনুষ্ঠানিকতা পালন করেন। তারা কোরবানির মাংস আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী ও দরিদ্রদের মধ্যে বিলি করেন।
সৌদিআরব
যেহেতু হজের শেষ দিনে কোরবানি করা হয়, তাই সৌদি আরবের এ ঈদ অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হয়। দেশটির জনগণ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হজের উদ্দেশে আসা মুসল্লিরা একসঙ্গে এখানে পশু কোরবানি করেন। এখানে কোরবানির জন্য উটই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায়, এছাড়া দুম্বাও কুরবানি করা হয়। সৌদি আরবের জনসংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৭০ লাখ। এর মধ্যে নথিভুক্ত অভিবাসীর সংখ্যা ৮৮ লাখ আর অবৈধ অভিবাসী প্রায় ১৫ লাখ। সৌদি আরবের নিজস্ব জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ।
ভারত
প্রতিবেশি দেশ ভারতে-ও কোরবানি করা হয়। বিশ্বের তৃতীয় সর্ববৃহৎ মুসলমান অধ্যুষিত দেশ এটি। ভারতে মুসলমানদের মোট সংখ্যা অনেক বেশি হলেও তা দেশটির মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৪.২ শতাংশ। ঈদুল আজহা উপলক্ষে ভারতে একদিনের সরকারি ছুটি পালিত হয়। দেশটির মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে খুব সাধারণভাবেই ঈদুল আজহা পালিত হয়। কোরবানির জন্য গরুই প্রধান প্রাণী হিসেবে বিবেচিত হয়। এ ছাড়া ছাগল ও দুম্বাও কোরবানি দেয়া হয়। তবে গত বছর থেকে দেশটিতে শুরু হওয়া গো-রক্ষা আন্দোলনের কারণে এবারের ঈদের গরু কোরবানি নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশ
ব্যাপক উৎসাহ উদ্দিপনা নিয়ে ঈদুল আজহা বাংলাদেশে পালিত হয়ে থাকে। এ সময় মুসলমানরা নতুন পোশাক পরে পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি যান এবং কুশল বিনিময় করেন। প্রত্যেক বাড়িতেই উন্নতমানের খাবার তৈরি হয়। অন্য ধর্মাবলম্বীরাও কোথাও কোথাও নিমন্ত্রিত হয়ে এ উৎসবে যোগদান করেন। এ উপলক্ষে কয়েকদিনের সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। প্রবাসীদের অধিকাংশই নিজ নিজ গ্রামের বাড়ি গিয়ে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে মিলিত হয়ে ঈদ উদযাপন করেন। বিভিন্ন মসজিদ-ময়দানে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় রেডিও-টেলিভিশনে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করা হয় এবং পত্রপত্রিকাগুলোয় ঈদুল আজহার তাৎপর্য তুলে ধরে মূল্যবান নিবন্ধ প্রকাশিত হয়।
মধ্যপ্রাচ্য
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান, কাতার, মিসর, তুরস্ক, ইয়েমেন, সিরিয়া, জর্ডান, ফিলিস্তিন, লেবানন, ওমান, কুয়েত, বাহরাইন ইত্যাদি দেশে কোরবানির জন্য পশুর মধ্যে উট ও দুম্বাই বেশি প্রাধান্য পেয়ে থাকে। প্রায় সব দেশে ইসলাম প্রধান ধর্ম হওয়ায় ঈদুল আজহা বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে পালিত হয়। অন্তত তিন দিনের সরকারি ছুটিতে এসব দেশের মানুষ অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে এই উৎসব পালন করেন।
মিসর
দেশটিতে ঈদুল আজহা মূলত সকালে মসজিদগুলোতে একত্রে নামাজ পড়া ও খুতবা শোনা এবং তারপর পশু কোরবানির মধ্য দিয়ে শুরু হয়। এটাই ঈদের মূল আনুষ্ঠানিকতা। ঈদের মূল আনুষ্ঠানিকতার পরই সবাই আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করেন এবং একসঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নেন। এ দিনে বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা দরিদ্রদের মাঝে গরুর গোশত এবং অন্যান্য খাদ্য বিতরণ করে। এদিন সারা দেশে সরকারি ছুটি থাকে। মিসরের মোট জনসংখ্যা ৯১,৬৭০,০০০ জন (২০১৬ সালের হিসার অনুসারে।) মুসলিম জনগোষ্ঠী ৯০ শতাংশ।
আফ্রিকা মহাদেশ
প্রায় ৪০ কোটি মুসলিম ধর্মাবলম্বীর বসবাস আফ্রিকা মহাদেশে। মরুভূমি অঞ্চলের দেশ হওয়ায় আফ্রিকার বিভিন্ন মুসলমান অধ্যুষিত দেশ যেমন মরক্কো, লিবিয়া, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, সুদান, সোমালিয়া, ইথিওপিয়া, মালি, সেনেগাল, গাম্বিয়া, গিনি, গিনি বিসাউ, সিয়েরা লিওন, নাইজেরিয়া ইত্যাদি দেশে কোরবানি দেয়ার জন্য ‘মরুভূমির জাহাজ’ হিসেবে খ্যাত উটই প্রধান প্রাণী। পাশাপাশি গরু, দুম্বা, ছাগল ইত্যাদি কোরবানি করা হয়। এসব দেশে ঈদ উপলক্ষে সরকারি ছুটি থাকে এবং নতুন পোশাক পরে সবাই ঘুরতে বের হয় আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের বাসায়।
পশ্চিমা দেশ
ইউরোপ, ওশেনিয়া, উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি মুসলিমের বসবাস। যাদের অধিকাংশ বিভিন্ন সময়ে এসব দেশে অভিবাসন করেছেন। এসব দেশে বসবাসরত মুসলমানরা ঈদুল আজহার দিন সকালের নাশতার আগেই মসজিদে গিয়ে ঈদের নামাজ পড়েন এবং তারপর ফিরে এসে পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে পশু কোরবানির পর একত্রে সময় কাটান। এসব দেশে বাংলাদেশ বা বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো রাস্তাঘাটে পশু জবাই করার নিয়ম নেই। অধিকাংশ মানুষ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি কসাইখানায় পছন্দমতো গবাদিপশুটি বেছে টাকা দিয়ে দেন এবং ঈদের দিন সেখান থেকেই নিয়ম অনুসারে কাটাকুটি শেষ হওয়ার পর তা ক্রেতাদের বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হয়।
এ ছাড়া এসব দেশে বসবাসরত বাঙালিরা সেখানে পশু জবাই না করে দেশে বসবাসরত আত্মীয়-স্বজনের কাছে কোরবানির জন্য টাকা পাঠিয়ে দিয়েও আনুষ্ঠানিকতা পালন করেন। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি পশ্চিমা দেশে ঈদের জন্য পৃথকভাবে কোনো সরকারি ছুটি নেই।
বুলগেরিয়া
এক সময় ওসমানি খেলাফতের অধিনে থাকা বুলগেরিয়ায় দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮ শতাংশ মুসলিম। পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে দেশটির মুসলমানরা সরকারিভাবে একদিনের ছুটি পায়। অন্যান্য মুসলিম দেশের মতই দেশটির মুসলিমরা নামাজ শেষে পশু কুরবানি করে। এ ক্ষেত্রে তারা বকরি বা দুম্বা কুরবানি করে থাকে। তবে দেশটির কিছু অঞ্চলে কট্টর খ্রিষ্টানদের দ্বারা কুরবানি করতে মুসলিমরা বাধার সম্মুখিন হয়।
ইউরোপের একমাত্র মুসলিম দেশ আলবেনিয়া
সংবিধানিকভাবে আলবেনিয়া সেক্যুলার হলেও, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমের বসবাস দেশটিতে। দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম খ্রিষ্টান। ঈদুল আজহা উপলক্ষে সরকারিভাবে দেশটিতে ছুটি ঘোষণা করা হয়। আলবেনিয়ায় বাংলাদেশের মত রাস্তাঘাটে কুরবানির পশু জবাই করা হয় না। সরকারি কসাইখানাগুলোতে পশু জবাই করতে হয়। অধিকাংশ মানুষই ভেরা ও দুম্বা কুরবানি করে। এছাড়াও মুসলিম এনজিওগুলোর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্য থেকে দুম্বা নিয়ে গিয়ে জবাই করে, মাংস গরিব মুসলিমদের মধ্যে বিতরণ করা হয়।
পাকিস্তান
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ মুসলমান অধ্যুষিত দেশ পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৯৬ দশমিক চার শতাংশ মানুষ মুসলিম ধর্মাবলম্বী। ২০১৬ সালের হিসাব অনুসারে এ দেশের জনসংখ্যা ২০,২৯,৭১,০০৩ জন। এ দেশে ঈদুল আজহা পালিত হয় চার দিন ধরে। উট ও দুম্বা এ দেশে কোরবানির জন্য প্রাধান্য পায়। এই দিনে দেশটিতে সব ধরনের অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, দোকানপাট ইত্যাদি পুরোপুরি বন্ধ থাকে। সকালে ঈদগাহে ঈদের নামাজ ও খুতবার পর আল্লাহ তাআলার উদ্দেশে পশু কোরবানির পর গোশত আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও দরিদ্রদের মধ্যে বিলি করা হয়।
সূত্র: মেট্রো, আল জাজিরা এবং মিডলইস্ট মনিটর।