সিঙ্গাড়া এলো যেভাবে
- ফিচার ডেস্ক
রন্ধনও একপ্রকার শিল্প, সুনিপুণ রন্ধনশৈলী এবং সুন্দর পরিবেশনা অন্তর্ভুক্ত থাকে এর মধ্যে। এরই এক ছোট্ট অংশ আজকের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু, সেটি হলো সিঙ্গাড়া। সন্ধ্যেবেলায় চায়ের সঙ্গে গরম গরম সিঙ্গাড়া হলেই সন্ধ্যেটা জমে যায়। বাঙালির এক পরম ভালোবাসা হলো এটি।
তবে সিঙ্গাড়ার প্রথম প্রচলন কিন্তু বাংলায় অথবা ভারতে নয়। ইতিহাস বলছে ইরান থেকেই নাকি এদেশে এসেছে সিঙ্গাড়া। ইরানি ইতিহাসবিদ আবুল ফজল বায়হাকি তার ‘তারিখ-এ-বেহাগি’ বইয়ে উল্লেখ করেছিলেন ‘সাম্বোসা’র। এই ‘সাম্বোসা’ই সিঙ্গারার আদি রূপ। তবে দ্বাদশ শতাব্দী থেকেই মোটামুটি ভারত উপমহাদেশের মাটিতে পরিচিত নাম সিঙ্গাড়া। আমির খসরুর রচনায় এর উল্লেখ আছে।
বাংলায় এটির প্রচলনের নেপথ্যে আছে এক জমজমাট কাহিনী।
ঠাণ্ডা লুচি বারংবার ফেরত পাঠানোয় রাজবাড়ির হালুইকর অনুমতি চেয়েছিলেন রাজসভায় মিষ্টান্ন পাঠাতে। রাজচিকিৎসকের পরামর্শে মধুমেহ রোগাক্রান্ত রাজা অগ্নিশর্মা হয়ে শূলে চড়ানোর হুকুম দিয়েছিলেন হালুইকরকে। অনেক অনুনয় বিনয় করে নিজের প্রাণ রক্ষা করেছেন হালুইকর। রাজা আদেশ দিয়েছেন – হালুইকরকে তিনরাত্রের মধ্যে দেশত্যাগ করতে।
দ্বিতীয় রাত্রে হালুইকরের স্ত্রী ঠিক করেছে দেশত্যাগের আগে একবার দেখা করবে রাজার সাথে। সেইমতো তৃতীয়দিন সকাল বেলা রাজদরবারে এসে প্রণাম জানালো স্বয়ং রাজামশাইকে। রাজসভায় আসার কারণ জিজ্ঞেস করায়, রাজাকে জানায় – সে নাকি এমনভাবে লুচি তরকারি করতে পারে, যা রাজা আধঘন্টা বাদে খেলেও গরম পাবেন। এজাতীয় লুচি এবং তরকারি নাকি কিছুক্ষণ বাদে খাওয়াই দস্তুর।
সন্দিহান রাজা কিঞ্চিৎ কৌতূহলী হয়ে হালুইকরের স্ত্রীকে পাঠালেন পাকশালে। জানিয়ে দিলেন যখন রাজসভা থেকে খবর যাবে তৎক্ষণাৎ পাকশাল থেকে খাবার পৌঁছনো চাই। হালুইকরের স্ত্রী মৃদু হেসে মহারাজকে জানিয়েছিলো – খাদ্যদ্রব্য রাজসভায় তৎক্ষণাৎই পৌঁছবে, কিন্তু অনুগ্রহ করে তিনি যেন কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে খান – অন্যথায় মহামান্য রাজকীয় জিহ্বা পুড়ে যেতে পারে। বিস্মিত মহারাজের সামনে দিয়ে হাস্যমুখে হালুইকরের স্ত্রী চলে গেল পাকশালে।
রাজ-পাচক আলুর তরকারি তৈরি করে পাকশালে দাঁড়িয়ে কাঁপছেন, হুকুম এলেই লুচি ভাজতে হবে। ময়দার তাল মাখা রয়েছে হাতের সামনে। হালুইকরের স্ত্রী পাচককে কটাক্ষ করে বসলো ময়দার তাল নিয়ে। লেচি কেটে লুচি বেলে, কাঁচা ময়দার ভেতর লুচির জন্য তৈরি সাধারণ তরকারি ভরে দিয়ে, সমভুজাকৃতি ত্রিভুজের গড়ন বানিয়ে আড়ষ্ঠ রাজপাচকের সামনে নিজের আঁচল সামলে শুরু করলো চটুল গল্প।
রাজাজ্ঞা আসতেই তরকারির পুর ভর্তি দশটি ত্রিভুজাকৃতির লুচির ময়দা ফুটন্ত ঘি ভর্তি কড়ায় ফেলে দিয়ে, নিমেষের মধ্যে সোনালী রঙের ত্রিভুজগুলি তুলে নিয়ে স্বর্ণথালায় সাজিয়ে নিজেই চললো রাজসভায়। মহারাজ এরূপ অদ্ভুত দর্শন খাদ্যবস্তু দেখে স্তম্ভিত। হালুইকরের স্ত্রী অত্যন্ত বিনীতভাবে জানালো – খাদ্যদ্রব্যটির নাম সমভুজা। মহারাজ যেন সম্পূর্ণ বস্তুটি মুখে না ঢুকিয়ে একটি কামড় দিয়ে দেখেন – ঠাণ্ডা না গরম এবং অনুগ্রহ করে স্বাদটি জানান।
মহারাজ স্বাদ জানাননি। তিনি তিনছড়া মুক্তো মালা খুলে হালুইকরের স্ত্রীর হাতে দিয়েছিলেন। রাজবাড়ির হালুইকরের দণ্ডাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছিলেন। প্রায় ছ’মাস পর হেসে উঠেছিলেন মহারাজ, শান্তি পেয়েছিলো তামাম প্রজাকুল।
মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র। ১৭৬৬ সালে কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভার রাজ-হালুইকর, কলিঙ্গ তথা বর্তমান ওড়িষ্যা থেকে আগত গুণীনাথ হালুইকরের ষষ্ঠপুত্র গিরীধারী হালুইকরের স্ত্রী ধরিত্রী দেবী আবিষ্কার করেছিলেন সিঙ্গাড়া।
শাক্ত সাধক, পরবর্তিকালে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি রামপ্রসাদ, স্বয়ং সন্ধ্যাহ্নিক সেরে প্রতিসন্ধ্যায় বসতেন একথালা সিঙ্গাড়া নিয়ে। দোলপূর্ণিমার সন্ধ্যায়, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের দরবার থেকে বাইশটি সুসজ্জিত হস্তী ভেট নিয়ে গিয়েছিলো উমিচাঁদের কাছে – বাইশটি স্বর্ণথালা ভর্তি বাইশশোটি সিঙ্গাড়া।
সিঙ্গাড়ার জন্য ইতিহাস স্বীকৃতি দিয়েছে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে। নাম ভুলে গেছে তাঁর প্রধান হালুইকরের স্ত্রী ধরিত্রী বেহারার। ধরিত্রীদেবী সাধারণ বুদ্ধি খাটিয়ে আবিষ্কার করেছিলেন এই অসাধারণ খাদ্যদ্রব্যটির, যেটি সেই ১৭৬৬ সাল থেকে ছড়িয়ে পড়েছে বাংলা তথা সারা ভারতে।
ঐতিহাসিকদের মতে নবম শতাব্দীতে পারস্যের অধিবাসীরা যব এবং ময়দার তালের সঙ্গে গাজর কড়াইশুঁটি রসুন ও মাংস মেখে সেঁকে খেতো, যাকে বর্তমান সিঙ্গাড়ার জনক হিসাবে ধরা হলেও সুদূর পারস্য থেকে ভারতবর্ষে এসেও তাঁরা ময়দার তালে মাংসের কুচি ঢুকিয়ে সেঁকেই খেতেন। এরও বহুপরে তাঁরা ভারতবর্ষের উত্তরপূর্ব উপকূলে বিভিন্ন মশলা সহযোগে তৈরি আলুর তরকারি, ময়দার ভেতর ঢুকিয়ে ঘিয়ে ভাজার পদ্ধতিতে চমৎকৃত হ’ন।
শহুরে অভিজাত পরিবারের বৈঠকখানায় মোটা গদির সোফায় বসা অতিথির থালাই হোক বা প্রত্যন্ত গ্রামের জরাজীর্ণ চায়ের দোকানের সামনে নড়বড়ে বাঁশের বেঞ্চে রাখা তেলচিটে কালো ভাঙ্গা বেতের চুবড়ি – বিকেল সাড়ে চারটেই হোক বা সকাল পৌনে দশটা, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রধান হালুইকরের স্ত্রীর উদ্ভাবনটি সর্বত্র সর্বদা সর্বগামী।
ভাষাবিদদের মতে, সমভুজা–> সম্ভোজা–> সাম্ভোসা–> সামোসা।
মতান্তরে, সমভুজা–> সম্ভোজা–> সিভুসা–> সিঁঙুরা (নদীয়ার কথ্যভাষার প্রভাবে)–> সিঙ্গাড়া।
তথ্য ও ছবি: ইন্টারনেট