ফেইসবুক পেজের রিচ বাড়াবেন যেভাবে
- অমৃত মলঙ্গী
সাত বছর আগে ফেইসবুকে পেজভিত্তিক ব্যবসা শুরু করেন এখলাসুর রহমান। সপ্তাহে কয়েকবার করে পণ্যের পোস্ট দিতেন। সেভাবে সাড়া পেতেন না। একদিন বন্ধুর কাছ থেকে ‘বুস্টিং’ বিষয়ে জানলেন। টাকা খরচ করে সেটি করলেন। লাইক বাড়ায় বেশ সাড়া পেতে থাকলেন। কিন্তু ২০১৮-১৯ সালে এসে আবার বুস্টিংয়েও খুব একটা কাজ হয়নি। এখলাসুর রহমান এই রহস্য সমাধান করেছেন অনেক দৌড়ঝাঁপের পর।
ফেইসবুক পেজ ব্যবহার করে যারা ব্যবসা করছেন, অনেকেই রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা এখলাসুর রহমানের মতো সমস্যায় পড়ে থাকতে পারেন। ফেইসবুকে এ সমস্যাটি আসলেই হচ্ছে। ২০১৯ সালের নভেম্বরে বিজনেস ইনসাইডার একটি জরিপ চালিয়ে দেখেছে, বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ বড় কোম্পানি ফেইসবুক পেজ থেকে সুবিধা আদায় করতে পারছে না। ৩২ শতাংশ প্রতিষ্ঠান এই মাধ্যমে আগের মতো খরচ করে না। ২৭ শতাংশ আবার ফেইসবুককে বিশ্বাস করে না। তাদের ধারণা, বুস্ট করলেও ফেইসবুক ইচ্ছা করে ‘রিচ’ বাড়ায় না। কেন এমন হচ্ছে?
প্রযুক্তিবিষয়ক ওয়েবসাইট সিনেটের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে ফেইসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ায় নিউজফিডে জট লাগার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পেজে এখন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীই আছেন প্রায় ৬৬ মিলিয়ন! সংখ্যা এভাবে বাড়ায় আগের মতো ‘অর্গানিক রিচ’ আর হচ্ছে না। অন্যদিকে বাস্তবতা হলো ফেইসবুক বাদ দিয়ে ব্যবসা করা সহজ নয়; বিশেষ করে বাংলাদেশে তো নয়ই। তাহলে উপায়?
বাজারে টিকে থাকতে হলে ফেইসবুককে গুরুত্ব দিতেই হবে। এখনকার দিনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে গড়ে ৪৬ শতাংশ গ্রাহক আসছে ব্যবসায়ীদের। এর মধ্যে ৪২ শতাংশই ফেইসবুকের! এই মাধ্যম থেকে ফায়দা নিতে হলে কৌশলী হতে হবে। কিছু মৌলিক বিষয়ে ধারণা থাকতে হবে।
অর্গানিক রিচ: কোনো পেইড ডিস্ট্রিবিউশন ছাড়া অর্থাৎ বুস্টের মতো কাজ ছাড়া আপনার পেজ থেকে কত মানুষ আপনার কনটেন্ট দেখছেন, সেটিকে বলা হয় অর্গানিক রিচ। পেইড প্রমোশন করলে আপনি তাৎক্ষণিকভাবে সুবিধা পেতে পারেন। একই সঙ্গে এটি আপনার অর্গানিক রিচে প্রভাবও ফেলতে পারে।
এই অর্গানিক রিচ অনেক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। একটি পোস্ট দেওয়ার পর কত মানুষ ক্লিক করছেন, লাইক করছেন, কমেন্ট করছেন সেটির অনুপাতে ওই পোস্টটি ছড়াতে থাকে। পেজ বাড়ার কারণে ২০১৬ সাল নাগাদ অর্গানিক রিচ ৫২ শতাংশ কমে গেছে।
কমার কারণ: ফেসবুকে প্রতি মাসে ৩০ বিলিয়নের বেশি সংখ্যক কনটেন্ট প্রকাশিত হচ্ছে। আপনার পেজে যাদের লাইক আছে, তাদের আগ্রহ বুঝে ফেইসবুক তাদের ফিডে কনটেন্ট পৌঁছায়। অর্থাৎ ওই ব্যক্তি কোন পেজে কত সময় কাটান, কী সার্চ দেন, অনলাইনে কী খোঁজেন- বিশেষ অ্যালগরিদমের মাধ্যমে ফেইসবুক সেটি নোট করে, এরপর সেই অনুযায়ী কনটেন্ট পৌঁছায়। আশার কথা হলো ‘অর্গানিক রিচ’ কমার এই যুগেও আপনি সফল হতে পারবেন।
অর্গানিক রিচ যত বাড়বে আপনার পেজ তত সাবলীল থাকবে। আপনার কনটেন্ট অনুযায়ী ক্রেতা বা গ্রাহক পেজে আসবে। অর্গানিক রিচ বাড়লে আপনার ক্যাম্পেইন মানুষের কাছে দ্রুত পৌঁছাবে। একটা সময় পেইড ক্যাম্পেইনেও ক্লিকপ্রতি আপনার খরচ কমে যাবে।
ফেইসবুকের এই ক্লিকপ্রতি খরচের বিষয়টি নিলামের মতো। ক্লিকপ্রতি খরচ সব সময় পরিবর্তন হয়, যেটি আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। সম্ভাব্য একটি হিসাব সেট করতে পারবেন।
আপনি যখন কোনো ক্যাম্পেইন শুরু করেন, তখন ফেইসবুক অটোমেটিক হিসাব করে আপনার বাজেট এবং সময় অনুযায়ী একটি বিড নির্ধারণ করে দেয়।
যেহেতু বিষয়টি নিলামের মতো তাই আপনাকে লাখ লাখ পেজের সঙ্গে ‘লড়াই’ করতে হয়। এই ‘লড়াই’ অনেক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে।
টাইমিং: বছরের কোন মাস, সপ্তাহের কোন দিন, দিনের কোন সময় আপনি বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন সেটির ওপর খরচের বিষয়টি নির্ভর করে। যে বিষয়ে, যে মাসে, যে দিনে, যে দেশে, যে শহরে, যে এলাকায় বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন সেখানে সেই সময় ব্যবহারকারীদের আনাগোনা এবং অন্য পেজের পেইড ক্যাম্পেইন বেশি থাকলে আপনার খরচও বেড়ে যাবে।
এভাবে তিনটি বিষয় বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে কাজ করে: এনগেজমেন্ট র্যাংকিং, কোয়ালিটি র্যাংকিং ও কনভারসেশন র্যাংকিং। তিনটির একটিতে কম স্কোর থাকলে খরচ বেড়ে যাবে।
যেভাবে ফেইসবুক নিউজ ফিডে পোস্ট পাঠায়: ফেইসবুকের নিউজ ফিডের প্রধান অ্যাডাম মোসেসির ব্লগ পোস্ট থেকে এ বিষয়ে ধারণা নিতে পারেন। তিনি জানান, চারটি বিষয়ের প্রতি নজর রেখে এটি করা হয়। বিষয়টি খাবারের মেন্যুর সঙ্গে তুলনা করতে পারেন।
ইনভেন্টরি- মেন্যুতে কী আছে? সিগনালস-এখন লাঞ্চ নাকি ডিনার টাইম? প্রেডিকশন- এই খাবার তিনি পছন্দ করবেন কি না? স্কোর-নির্দেশ দেওয়া।
অ্যাডাম জানান, একজন ব্যবহারকারী যখন লগইন করেন, তখন আরও চারটি বিষয় দেখা হয়: ১. আপনার বন্ধু ও প্রকাশক (পেজ) কী পোস্ট করছেন? ২. কে বা কোন পেজ থেকে করছেন? ৩. আপনার মন্তব্য করার সম্ভাবনা কতটুকু? ৪ প্রাসঙ্গিক স্কোর কেমন?
এসবের সঙ্গে আরও যা দেখা হয়: সম্প্রতি পোস্টটি কীভাবে পোস্ট করা হয়েছে? প্রকাশক কত সময় পরপর কনটেন্ট পোস্ট করেন? কনটেন্টে কত লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার আছে? ব্যবহারকারীরা কেমন হারে পোস্টে ক্লিক করছেন? একই ধরনের পোস্টে অতীতে ব্যবহারকারীরা কীভাবে রিঅ্যাক্ট করেছেন? পোস্ট সম্পর্কে নেগেটিভ প্রতিক্রিয়া আছে কি না? পোস্টটি কতখানি গুরুত্বপূর্ণ? এসব প্রশ্নের উত্তর যত ইতিবাচক হবে, আপনার পোস্টের অর্গানিক রিচ তত বাড়বে। যদি রিচ কারও কমে যায়, তাহলে সতর্ক হতে হবে।
এখন প্রশ্ন হলো সার্বিকভাবে অর্গানিক রিচ কমার এই যুগে ঠিক কীভাবে ফেইসবুক থেকে আরও সুবিধা পাওয়া যেতে পারে। সোজা কথায় আপনার টাকা থাকলে বাজফিডের মতো বিনিয়োগ করতে পারেন। তাদের প্রায় অর্ধেক ভিজিটরই আসে ফেইসবুক থেকে। আকর্ষণীয় কনটেন্টের পাশাপাশি তারা লাখ লাখ টাকার বুস্ট করে। আর যাদের এত টাকা নেই?
যারা কম খরচে ফায়দা লুটতে চান তাদের কিছু বিষয় এড়িয়ে যেতে হবে।
১. সবকিছু স্বয়ংক্রিয় করা: শুধু পোস্ট শিডিউল করে দিলেই হবে না। প্রতিদিন মিনিটে মিনিটে শুধু শেয়ার দিলে হবে না। স্বয়ংক্রিয় করার এই অভ্যাসের পাশাপাশি পাঠক কিংবা গ্রাহককে ‘হিউম্যান টাচ’ দিতে হবে। আপনার প্রতিষ্ঠানে কারা কাজ করছেন, প্রতিদিন তাদের সময় কীভাবে কাটছে সে বিষয়ে ছবি এবং ভিডিও পোস্ট করতে হবে। টিমের সদস্যদের ট্যাগ করে ভিডিও আপলোড করতে হবে। মানুষ সব সময় এমন ‘হিউম্যান টাচ’ চায়। এতে পেজের প্রতি লাইকারদের বিশ্বাস বাড়ে। আস্থা বাড়ে। তারা বেশি সময় কাটায়।
২. শুধু প্রোডাক্ট ও সার্ভিস প্রোমোট: ফেইসবুক আগ্রহের ভিত্তিতে চলে; উদ্দেশ্য নয়। তাই শুধু গতানুগতিক প্রোডাক্ট ও সার্ভিস পোস্ট করে গেলে হবে না। ৮০ শতাংশ পোস্ট হতে হবে সামাজিক। না হলে পোস্টপ্রতি ক্লিক বাড়বে না। এ জন্য সুন্দর সুন্দর গ্রাফিকসে নান্দনিক মন্তব্য পোস্ট করতে পারেন। ছোট ভিডিও পোস্ট করতে পারেন, যেটি হবে শৈল্পিক। মাঝে মাঝে লাইভ করতে হবে। পেজের অডিয়েন্সের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। তাদের মন্তব্য নিতে হবে।
৩. ইকোসিস্টেমের সঙ্গে প্রতারণা: চটকদার শিরোনামে ৫ ডলারের বিনিময়ে ৫ হাজার ‘ভুয়া’ লাইক কেনার অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। এক ঘণ্টায় ১০টি নিম্নমানের আপডেট দিয়ে গ্রাহকদের ঠকানো যাবে না। এতে টাকা এবং সময়ের অপচয় হয়। ফেইসবুক বিশেষ অ্যালগরিদম দিয়ে এসব ধরে ফেলে। তখন রিচ তো কমেই, গ্রাহকদের কাছে পেজের সুনামও নষ্ট হয়।
অ্যাডএক্সপ্রেসো তিনটি পেজ নিয়ে একটি জরিপ চালিয়ে এ বিষয়ে প্রমাণ পেয়েছে। নিজেদের তিনটি ফ্যান পেজে তারা অভিন্ন ভিডিও পোস্ট করে সবগুলো বুস্ট করে।
এর মধ্যে তাদের দুটি পেজের লাইক ছিল কেনা। যাদের মধ্যে অনেকগুলো ভুয়া। দেখা গেছে, ওই দুই পেজের ভিডিওতে অর্গানিক এনগেজমেন্ট নেই বললেই চলে।
৪. ফ্যান বেজে নজর দেওয়া: আপনার ফ্যান গ্রুপে শুধু অনুসারী বাড়াতে থাকলে কোনো লাভ হবে না। কনটেন্ট ভালো না হলে বরং রিচ কমতে থাকবে। এর মানে হলো, আপনার প্রাসঙ্গিক পোস্ট দিতে হবে। কনটেন্ট তৈরিতে পরিশ্রম করতে হবে। এমন কনটেন্ট দিতে হবে যা মানুষের জন্য উপকারী।
৫. অর্গানিক রিচ বিশ্লেষণ: পেজের অবস্থা বুঝতে আপনাকে প্রতিনিয়ত অর্গানিক রিচ বিশ্লেষণ করে যেতে হবে। এ জন্য পেজে গিয়ে ‘Export Data’ থেকে ডেটা দেখতে হবে। পেজের ওপরের দিকে ‘Insights’ অপশনে ক্লিক করলে একদম ডানদিকে ‘Export Data’ দেখতে পাবেন। এই অপশনে গেলে ‘Page data’ এবং ‘Post Data’ অপশন পাবেন।
এখান থেকে পোস্ট ডেটা দেখাটা বেশি দরকারি। পেজ ডেটা থেকে পাবেন আপনার পারফরম্যান্সের অবস্থা। অন্যদিকে পোস্ট ডেটা থেকে বুঝতে পারবেন কোন ধরনের পোস্ট বেশি মানুষ দেখেছে কিংবা বেশি পছন্দ করেছে। আর এটাই মূলত পার্থক্য গড়ে দেয়।
সূত্র: দেশ রূপান্তর