বিখ্যাতদের বই ভাবনা
- শুভদীপ বিশ্বাস
‘আমরা কি টাকা জমানোর জন্য বাঁচি?’
বিখ্যাত মানুষ, কিংবা এখনকার ভাষায় সেলেব্রিটিদের মনে এ ধরনের প্রশ্ন কখনো-কখনো আসাটা খুব বিচিত্র কি? মনে হয় না। এ ধরনের জীবনমুখী প্রশ্ন মাথায় খেলে যায় বলেই বিখ্যাতরা এখনো মানুষ, তাঁরা কেবলই কাজে ডুবে থাকতে পারেন না, এর বাইরেও জীবনের রসাস্বাদন করার জন্য তাদের কিছু না কিছু করতে হয়। আর জীবনের রসাস্বাদন করার জন্য একখানা বইয়ের চেয়ে বেশি উপযুক্ত আর কী হতে পারে?
বিখ্যাতরাও সময়ে সময়ে বইয়ের প্রেমে পড়েছেন। তেমনি কয়েকজন বিখ্যাত মানুষের বই-ভাবনা নিয়ে আমাদের আজকের এই আলোচনা।
কাকে দিয়ে শুরু করা যায়? পৃথিবীর সাবেক ‘সবচেয়ে ক্ষমতাধর’ লোকটির কথা দিয়েই শুরু করা যাক; অর্থাৎ বারাক ওবামা, আমেরিকার সাবেক রাষ্ট্রপতি, একজন বইপোকা। তিনি একজন উল্লেখযোগ্য লেখকও বটে। ‘ড্রিমস ফ্রম মাই ফাদার’ নামে একটি বইও লিখেছেন তিনি। সে বইয়েই তিনি উল্লেখ করেছেন তার বই-ভাবনার কথা, ‘যখন আমার হাতে তেমন কোনো কাজ থাকত না, বিশেষ করে সপ্তাহান্তে, তখন সাধারণত আমাকে আমার অ্যাপার্টমেন্টেই কোনো না কোনো বই হাতে পাওয়া যেত!’
সবচেয়ে ক্ষমতাধর মানুষটির কথা যখন বলা হলো, তখন সবচেয়ে ধনী মানুষটির কথাও বলা দরকার। উইলিয়াম হেনরি গেটস, ওরফে বিল গেটস (যদিও সত্যি বলতে বর্তমানে তিনি আর সবচেয়ে ধনী মানুষ নন, তবে ধনী মানুষদের তালিকায় একদম ওপরের দিকে আছেন), নিজেও একজন বেশ বড়সড় মাপের বইপোকা। তাঁকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে বই পড়ার প্রভাব আছে কি না। বিল গেটসের উত্তরটা ছিল এ রকম—অবশ্যই বাস্তব দুনিয়া সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসা বাড়াতে বই অত্যন্ত সহায়ক যা তাঁকে তাঁর ব্যক্তি এবং কর্মজীবনে সাহায্য করেছে এবং বর্তমানে তাঁর নিজস্ব ফাউন্ডেশনের কর্মপদ্ধতিতেও যথেষ্ট প্রভাব ফেলছে।
আরেকজন বিজনেস টাইকুন বা ধনকুবেরের কথা বলা যাক। বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের সিইও, বিলিয়নিয়ার ওয়ারেন বাফেট। তাঁর ভাষ্যমতে, তাঁর সাফল্যের সবচেয়ে বড় চাবিকাঠি ছিল বই। কর্মজীবনের শুরুর দিকে তিনি রোজ ছ’শো থেকে এক হাজার পৃষ্ঠা পড়তেন, এমনকি এখনো তিনি দিনের একটা বিশাল সময় কাটান বই পড়ে।
এবার একটু উপমহাদেশের দিকে নজর দেওয়া যাক। এপিজে আব্দুল কালাম, ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি, প্রতিভাবান বিজ্ঞানী ও লেখক। তিনি বলেন, ‘বই আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। আমার কাছে আমার ঘরটিই একটি লাইব্রেরি, কারণ এখানে হাজার হাজার বই আছে, আর এরাই আমার শ্রেষ্ঠ সম্পদ। একেকটি নতুন বই একেকরকম ভাবে আমাকে অনুপ্রাণিত করে, নতুনভাবে আমাকে চিন্তা করতে শেখায়।’
শাহরুখ খান নামটা বলার পর এই লোক কীসের জন্য বিখ্যাত, এমন প্রশ্ন করার মতো মানুষ অন্তত এই গোটা উপমহাদেশে মনে হয় না একজনও পাওয়া যাবে। হ্যাঁ, এই অভিনেতাও একজন বইপোকা। বই সম্পর্কে তাঁর ভাষ্য এইরকম, ‘বইয়ের ব্যাপারে আমি সর্বভুক, আমি এক বসায় তিন থেকে চারটি বই পড়ে শেষ করি। যখন আমি লন্ডন বা আমেরিকায় থাকি, আমি যেকোনো বইয়ের দোকানে গিয়ে এক কাপ কফি কিনে নিয়ে বই পড়ি। দুর্ভাগ্যবশত, ভারতে এমনটা করা সম্ভব হয় না। আমি ভারতে ফিরি ব্যাগভর্তি বই নিয়ে, এবং প্রত্যেকবারই আমার ব্যাগে ভারী ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি আছে ভেবে আমাকে কাস্টমসে থামানো হয়!’
বই সম্পর্কে ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও মার্ক জাকারবার্গ তাঁর ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘কোনো একটি বিষয়কে পুরোপুরিভাবে জানার জন্য বইয়ের কোনো বিকল্প নেই। বই আপনার চিন্তাশক্তিকে গভীরভাবে বিস্তৃত করে।’
বিখ্যাত কিশোরসাহিত্য হ্যারি পটারের লেখিকা জোয়ান ক্যাথলিন রোওলিং ওরফে জে কে রোওলিং বলেন, ‘আমি সব সময় বইয়ের জন্যই বেঁচে ছিলাম!’
‘হ্যারি পটার’ বলতেই মনে পড়ে এমা ওয়াটসনের কথা, যিনি হ্যারি পটার সিনেমায় পড়ুয়া হারমাওনি গ্রেঞ্জার চরিত্রে অভিনয় করেছেন। পর্দার জীবন নয় শুধু, বাস্তব জীবনেও বইপোকা এই অভিনেত্রী বলেন, ‘আমার প্রিয় বইগুলো শুধুমাত্র আনন্দদায়কই নয়, এগুলোর প্রত্যেকটিরই কিছু না কিছু স্মৃতি আছে। যেমন, হয়তো কখনো আমি কোনো একটা গান শুনছি, হঠাৎ ইচ্ছে হলেই তেমন একটা বই তুলে নিয়ে পড়তে পড়তে হারিয়ে যেতে পারি অন্য যেকোনো সময়ে কিংবা জায়গায়…’
বিখ্যাত ফ্যান্টাসি জনরার বই ‘দ্য সং অব আইস অ্যান্ড ফায়ার’-এর লেখক জর্জ আর আর মার্টিন বলেন, তিনি একজন তুমুল বইপোকা, এবং তাঁর প্রিয় বই হচ্ছে টলকিনের লেখা ‘লর্ড অব দ্য রিংস’ ত্রয়ী।
বিখ্যাত লেখক ফ্রানজ কাফকা, বই সম্পর্কে বলেন, ‘আমাদের আত্মার মধ্যে যে জমাট বাঁধা সমুদ্র, সেই সমুদ্রের বরফ ভাঙার কুঠার হচ্ছে বই।’ তাঁর এ কথার মিল পাই জার্মান কবি ও শিল্পী গ্যেটের কথার সঙ্গে, ‘কতকগুলো বই সৃষ্টি হয় কেবল আমাদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য নয়, বরং তাদের উদ্দেশ্য হলো আমাদের এ কথা জানানো যে, বইগুলোর স্রষ্টারা কিছু জানতেন।’
লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী বই এবং বই পড়ার গুরুত্বের ব্যাপারটিকে খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন তার ভাবনায়, ‘পৃথিবীর আর সব সভ্যজাত যতই চোখের সংখ্যা বাড়াতে ব্যস্ত, আমরা ততই আরব্য উপন্যাসের একচোখা দৈত্যের মতো ঘোঁত ঘোঁত করি, আর চোখ বাড়াবার কথা তুলতেই চোখ রাঙাই। চোখ বাড়াবার পন্থাটা কী? প্রথমত-বই পড়া, এবং তার জন্য দরকার বই পড়ার প্রবৃত্তি।’
বই নিয়ে শেষ উক্তিটা তাহলে বিশ্বকবির কাছ থেকেই নেওয়া যাক। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বইয়ের বর্ণনা পাই আরও নতুন, আরও চমৎকারভাবে, ‘বই হচ্ছে অতীত আর বর্তমানের মধ্যে বেঁধে দেওয়া সাঁকো।’
অতএব, দেখাই যাচ্ছে, বই কিংবা বই পড়াটা শুধুই অলসের বিলাস নয়। আজকের দিনে যারা বিখ্যাত, যারা প্রতিষ্ঠিত, তাদের মধ্যে অনেকেই অতীতে বইপোকা ছিলেন, এবং এখনো আছেন। শুধু আজকের দিনে কেন, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিখ্যাত মানুষেরা বই পড়ে আসছেন, বইয়ের পক্ষে কথা বলে আসছেন। বিশ্বজয়ী নেপোলিয়ন বোনাপার্ট তো বলেছিলেন, ‘অন্তত ষাট হাজার বই সঙ্গে না থাকলে জীবন অচল।’ মুঘল সম্রাট হুমায়ূন যুদ্ধযাত্রার সময়ও সঙ্গে গোটা একটি ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগার সঙ্গে নিয়ে যেতেন। এমনকি তাঁর মৃত্যুও হয় বই পড়া শেষ করে গ্রন্থাগারের সিঁড়ি দিয়ে নামার সময়। কাজেই, বিখ্যাতদের বই-ভাবনা মোটেও অস্বাভাবিক কিছু নয়, উপরন্তু সাধারণ লোকদের বই পড়তে উৎসাহিত করার জন্য তাঁদের এই বই ভাবনার অপরিসীম গুরুত্বও রয়েছে।
শুভদীপ বিশ্বাস: শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
সূত্র: ফিন্যানসিয়াল এক্সপ্রেস