ঈদে মানুষ কেন বাড়ি যায়
- ফিচার ডেস্ক
ঈদে নগরবাসী, বিশেষ করে ঢাকার বাসিন্দারা গ্রামের বাড়ি যান। এই যাত্রায় যত ভোগান্তিই থাকুক, সবাই তা মেনে নেন। এ বছর ভোগান্তি অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি। কারণ করোনা সংক্রমণ রোধকল্পে সরকারিভাবে দূরপাল্লার যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। তারপরও ফেরিঘাটে দেখা দিয়েছে লাখো মানুষের ঢল। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই তারা গ্রামে ফিরছেন।
ঈদে কত লোক ঢাকা ছাড়েন তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই৷ তবে কমপক্ষে অর্ধেক নগরবাসী যে ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে যান সে বিষয়ে কারো সন্দেহ নেই৷ সেই হিসেবে ১ কোটি ৭০ লাখ জনসংখ্যার এই শহরের ৮০-৮৫ লাখ মানুষ প্রতিবছর ঈদের সময় ঢাকা ছাড়েন।
লম্বা ছুটি!
ঈদের সরকারি ছুটি থাকে সাধারণত তিন দিন। এরসঙ্গে কখনো সাপ্তাহিক ছুটি যোগ হয়। এছাড়া অবৈতনিক ছুটি কিংবা ঐচ্ছিক ছুটিও নেন অনেক কর্মী এ সময়। সবমিলিয়ে পাঁচ থেকে সাত দিনের টানা ছুটি কাটান মানুষ। আর এ পুরো সময় পরিবারের সঙ্গে কাটাতেই সবাই ছোটেন গ্রামে। কারণ বছরের অন্যান্য সময় এ রকম লম্বা ছুটি কোনো প্রতিষ্ঠানই দিতে চায় না।
কেন সবাই গ্রামে যান?
ঢাকার বেসরকারি চাকরিজীবী জামাল উদ্দিন। তাঁর গ্রামের বাড়ি ফেনী। তিনি বলেন, ‘‘গত দুই ঈদ করোনার কারণে বাড়ি যেতে পারিনি। কিন্তু এবার আর না গেলেই নয়। মা বাবা অস্থির হয়ে আছেন আমার জন্য। তাছাড়া পারিবারিক কিছু জমিজমা সংক্রান্ত ঝামেলাও মেটাতে চাই এ সময়। অন্য সময় তো পরিবারের সবাইকে একসঙ্গে পাওয়া যায় না। সবার ছুটি একসঙ্গে মেলে না। এসব কারণে বাড়ি যাচ্ছি।’’
ফওজিয়া সুলতানা একাই ঢাকায় থাকেন। কাজ করেন একটি সংবাদ মাধ্যমে। গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনা। তিনি যে করেই হোক প্রতি ঈদেই গ্রামের বাড়ি যান। কারণ জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমার ভাই-বোন বিভিন্ন জায়গায় চাকরি করেন। দেশের বাইরেও আত্মীয়-স্বজন আছেন। তাঁরা সবাই ঈদে গ্রামে আসেন। আর কোনো জায়গায় আমরা একসাথে এভাবে মিলিত হওয়ার সুযোগ পাই না। তাই আমি ঈদে সব সময় বাড়ি যাওয়ার চেষ্টা করি। এ পর্যন্ত আমার কোনো ঈদই মিস হয়নি। এটা আমার নাড়ির টান।’’
কারা বাড়ি যান?
ঈদ শুধু উৎসব নয়। নগরবাসীর কাছে নাড়ির টানে গ্রামে ফেরার এক আয়োজন। আর ওই গ্রামে ফিরে আসেন পরিবারের সবাই। অনেকেই এই মিলনমেলা মিস করতে চান না।
এছাড়াও নিম্নি শ্রেণীর মানুষ সবচেয়ে বেশি গ্রামে যান ঈদ করতে। এদের বেশিরভাগই থাকেন ঢাকা শহরের বিভিন্ন বস্তিতে। ইউনিসেফ এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ঢাকা শহরে প্রায় পাঁচ হাজার বস্তি রয়েছে। এসব বস্তিতে অন্তত চার মিলিয়ন মানুষ থাকেন। অর্থাৎ ৪০ লাখ। এরা প্রায় সবাই দিনমজুর, রিকশা চালানো, ফেরি করে ছোট ছোট জিনিসপত্র বিক্রি করা, হকারি করা, বাদাম চানাচুর বিক্রি করা, অন্যের বাসায় বুয়ার কাজ করা, দারোয়ানের চাকরি করা, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করা ইত্যাদি কর্মের সঙ্গে জড়িত। এই বিপুল সংখ্যক শ্রমজীবীর অর্ধেকের বেশি ঈদের সময় গ্রামে যান।
নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘‘এই উৎসব আয়োজনে গগরবাসীর গ্রামমুখী হওয়ার নানা কারণ আছে। এখনো ঢাকার ৬০ ভাগ পরিবার প্রধানের জন্ম গ্রামে। আবার ঢাকায় যাঁরা মাইগ্র্যান্ট, তাঁদের অধিকাংশের শহরে বাড়ি নেই। তাঁদের পরিবারের একটি অংশ নিজ গ্রামে বা অন্য এলাকায় কাজের জন্য থাকেন। কেউ আছেন, যিনি শুধু নিজেই ঢাকায় থাকেন, পরিবার গ্রামে থাকেন। এসব কারণে উৎসব আয়োজনে তাঁরা গ্রামে যান।’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘মধ্যবিত্তের একটি অংশ আছে যাদের গ্রাম ও শহর উভয় জায়গায় বাড়ি আছে। তাঁরাও গ্রামে তাঁদের পরিবার নিয়ে যান গ্রাম দেখা। কিন্তু যাঁদের গ্রামে বা শহরে কোথাও বাড়ি নেই, তাঁরা আসলে যান না। এঁরা ভাসমান মানুষ। গ্রামে কোনো আশ্রয় নেই। সে কারণেই শহরে এসেছেন।’’
এই নগর বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ‘‘ঢাকার ৪০-৫০ ভাগ মানুষ ঈদে গ্রামে যান। তবে কোনো জরিপ নেই। এটার একটি জরিপ হলে আরো অনেক তথ্য পাওয়া যাবে।’’
সারাদেশে কত লোক ঈদে গ্রামে যান?
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মতে, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ঈদের সময়ে সারাদেশে কমপক্ষে দ্বিগুন মানুষ যানবাহনে চলাচল করেন। ঢাকা থেকে এই সংখ্যা প্রায় ১ কোটি। আর অন্যান্য এলাকা থেকে সাড়ে ৩ কোটি। বাংলাদেশের সড়ক এবং যানবাহন এমনিতেই যাত্রীবান্ধব নয়। যানবাহন প্রয়োজনের তুলনায় কম। সড়কগুলোও ভালো না। ফলে দ্বিগুন চাপে পারিস্থিতি স্বাভাবিক কারণেই ঈদ বা কোরবানির সময় খারাপ হয়।
সম্প্রতি দৈনিক প্রথম আলো একটি খবর প্রকাশ করেছে। সেই খবর থেকে জানা যায়, গত দুই দিনে প্রায় ২৮ লাখ মানুষ ঢাকা ছেড়েছেন।
তথ্যঋণ: ডয়চে ভেলে ও প্রথম আলো।