অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল যেভাবে
- রাজিয়া সুলতানা ঈশিতা
পৃথিবীর সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয় মরক্কোর ফেজ নামক স্থানে ৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে ‘আল-কারাউন’ নামে। এটি ছিলো আধ্যাত্মিক ধর্ম শিক্ষা বিষয়ক একটি বিশ্ববিদ্যালয়। পশ্চিমা বিশ্বের প্রথম বড় কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো ইতালির বলোগনা বিশ্ববিদ্যালয়। পৃথিবীর প্রাচীন ও বৃহৎ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ‘ইউনিভার্সিটি অফ বলোগনা’। প্রায় ২০০ বছর পর ১০৮৮ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত হয় এটি। দশম শতকের পর প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় একযোগে (১০৯৬) গড়ে উঠে। আর ইংল্যান্ডের প্রাচীন দুটি বিশ্ববিদ্যালয় হলো ‘অক্সফোর্ড’ ও ‘কেমব্রিজ’। এই যুগের অধিকাংশ প্রতিভাবান কবি, সাহিত্যিক, পদার্থবিদ, রসায়নবিদ, চিকিৎসক, জীববিজ্ঞানী সকলে এ দুটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করেছেন।
এ দুটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ইতিহাসের দিকে যদি যাই, দ্বাদশ শতাব্দীর পূর্বে ইউরোপের সাধারণ মানুষের ধারণা ছিল যে, শিক্ষা লাভ ব্যাপারটা গির্জার মানুষদের একচেটিয়া বিষয়। তাই সাধারণ মানুষদের এর সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা নেই। কিন্তু চিকিৎসা ও আইন সংক্রান্ত বিষয়ে বৈজ্ঞানিক উন্নতির শ্রী বৃদ্ধিতে ইতালি এবং ফ্রান্সে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন ও জ্ঞান আহরণের দিকে ধাবিত হতে থাকে সবাই। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব বিভাগে শিক্ষাদান করা হতো- ধর্মতত্ত্ব, গির্জার আইন-কানুন, চিকিৎসা, জ্যামিতি, পাটিগণিত, সঙ্গীত, ব্যাকরণ, তর্কশাস্ত্র, জোতিষশাস্ত্র, অলঙ্কারশাস্ত্র, যুক্তিবিদ্যা। কিন্তু দর্শনশাস্ত্র শিক্ষা দেয়া হত না। শিক্ষার্থীদের জ্ঞানগত কোনো স্বাধীনতা ছিল না তখন।
ইংরেজি ভাষাভাষীদের জন্য সবচেয়ে প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় হলো অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। একাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্ব মেলে, ১০৯৬ খ্রিস্টাব্দের লিখিত আকারের দলিল পাওয়া যায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের। তখনকার সময়ে ইংরেজ ছাত্রদের উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র ছিল প্যারিস নগরী। ১১৬৭ খ্রিস্টাব্দে রাজা দ্বিতীয় হেনরি ইংরেজ ছাত্রদের প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করলে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রিয়তা দ্রুত বাড়তে থাকে। প্রথম দিকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মতত্ত্ব, আইন, চিকিৎসা এসব বিষয়ে শিক্ষা দেয়া হত। প্রথমদিকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো নিজস্ব কোনো ভবন ছিলো না। হল বা চার্চ ভাড়া করে ক্লাস নেয়া হত শিক্ষার্থীদের। পরবর্তীতে রাজার আদেশে ১৩৫৫ সালে অক্সফোর্ড শহরে স্থানান্তরিত করা হয়। ল্যাটিন ভাষায় ‘Dominus Illuminatio Mea’- প্রভুই আমার আলো এ নীতিবাক্যটি ধারণ করে আজ অব্ধি স্বগর্বে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে ইংরেজদের প্রথম প্রাচীন এ বিশ্ববিদ্যালয়টি। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, জুলফিকার আলী ভুট্টো, অং সান সু চিসহ বিশ্বের ৩০ জন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নেতা এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি অর্জনসহ নানারকম পুরস্কার ও অভিধায় ভূষিত হয়েছেন। ৪ জন ইংরেজ রাজা, ৮ জন বিদেশী রাজা, ৪৭ জন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী, ২৫ জন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী, ১৮ জন কার্ডিনাল ও একজন পোপও এ বিশ্ববিদ্যালয় হতে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন।
প্রাচীন নথিপত্র অনুসারে ১২০৯ সালে অক্সফোর্ডের কিছু পণ্ডিতব্যক্তি স্থানীয় লোকদের সঙ্গে বিবাদের জের ধরে শহর ছেড়ে চলে যান এবং ক্যামব্রিজ শহরে এসে নিজেদের সংগঠন গড়ে তোলেন। এটিই পরে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়।
আবার জানা যায় দ্বাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে তর্কবিজ্ঞান শিক্ষার বিষয় নিয়ে অধ্যাপকদের মধ্যে এক দারুণ বিরোধ সৃষ্টি হয়। ফলে একদল অধ্যাপক তাদের ছাত্রসহ শহর ছেড়ে ব্রিটেনে চলে আসেন। ১২০৯ সালে কেমব্রিজ শহরে তৃতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয় এবং অক্সফোর্ডের কিছু ছাত্র এখানে চলে আসে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর অব সাইন্স, মাস্টার অব আর্টস এবং ডক্টর ডিগ্রি দেওয়া হত স্নাতকদের।
ইংরেজদের ২য় প্রাচীন এ বিশ্ববিদ্যালয়টি লাতিন ‘Hinc Lucem et Pocula Sacra’- এই স্থান থেকে আমরা আলো ও মূল্যবান জ্ঞান আহরণ করি এই নীতিবাক্যটি ধারণ করে আছে অদ্যাবধি। অক্সফোর্ডের মত কেমব্রিজও বহু প্রথিতযশা ব্যক্তিবর্গের জ্ঞান কোলাহলে প্রাঞ্জল হয়ে আছে।
কম্পিউটারের জনক চার্লস ব্যাবেজ, ফ্রান্সিস বেকন, নীলস বোর (পদার্থবিজ্ঞান’ নোবেল ১৯২২), জে জে টমসন ( পদার্থবিজ্ঞান, নোবেল ১৯০৬) ছিলেন কেমব্রিজের শিক্ষার্থী।
স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু, জামাল নজরুল ইসলাম (পদার্থ ও গণিত, বাংলাদেশ), চিকিৎসা বিজ্ঞানে ফ্রান্সিস ক্রিক ( নোবেল ১৯৬২), অমর্ত্য সেন (অর্থনীতিতে নোবেল ১৯৯৮) প্রমুখ।
সাহিত্যে লর্ড বায়রন, জন মিল্টন, আল্লামা ইকবালসহ অনেকে।
অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় দুটিকে অনেক সময় একত্রে Oxbridge ‘অক্সব্রিজ’ নামে ডাকা হয়। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সংশ্লিষ্টদের Cantabrigian ‘ক্যান্টাব্রিজিয়ান’ নামে অভিহিত করা হয়। এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাইদের অক্সানিয়ান বলা হয়৷ এটি বিশ্বের একটি নামকরা প্রকাশনাও বটে।
সূত্র: বইচারিতা