‘নূরজাহান’ স্রষ্টাঃ বাংলা সাহিত্যের জীবন্ত পথিকৃৎ
- আবু রিফাত জাহান
অষ্টাদশী কিশোরী নূরজাহানের প্রেমে পাগল হয়ে গ্রামের মধ্যবয়সী মাওলানা বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসেন। আর বিয়ের প্রস্তাবে প্রত্যাখান হয়েই পাগলাটে মাওলানা সুযোগ পেয়ে দিয়ে বসেন ফতোয়া, নূরজাহানের দ্বিতীয় বিয়ে জায়েজ না। এমন ফতোয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত হয় নূরজাহানকে আরবীয় নির্যাতনের কায়দায় মাটিতে অর্ধ শরীর পুঁতে রেখে মারা হবে ১০১ পাথর। বিখ্যাত ‘নূরজাহান’ উপন্যাসে এভাবেই ধর্মের দোহাই দিয়ে বাংলার সমাজে অশিক্ষা, কুসংস্কার আর ফতোয়াবাজদের দাপটে নারীদের অবহেলা, নির্যাতন এবং প্রতিবাদের চিত্র তুলে ধরেছেন কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন। সুদীর্ঘ এই উপন্যাসে ধর্ম, নারীর অধিকার, পারিবারিক আইন, নিরপেক্ষতা, মানবিকবৃত্তি, কূট-কৌশল, গ্রাম ও শহরের জীবনচিত্রের প্রভেদ, প্রেম-হিংসা-লোভ-প্রতিশোধ, দারিদ্র্য, সরলতা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি-হতাশা আর আশাবাদের এক বিরাট মিলনমেলা ঘটিয়েছেন চিরতরুণ এই ঔপন্যাসিক। যিনি কলমে এঁকেছেন একই সাথে বাংলাদেশের শহুরে ও গ্রামীন জীবনের চিত্র; দিয়েছেন বাংলার কথাসাহিত্য শাখার পরিপূর্ণতার স্বাদ।
ইমদাদুল হক মিলন ১৯৫৫ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর বিক্রমপুরের মেদিনীমণ্ডল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস একই জেলার পয়সা গ্রামে। তার পিতার নাম গিয়াসুদ্দিন খান ও মাতার নাম আনোয়ারা বেগম। তার লেখা প্রথম উপন্যাস ‘যাবজ্জীবন’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৬ সালে। আর এই লেখা দিয়েই প্রখ্যাত এই লেখক নিজের জাত চিনিয়েছিলেন। তিনি একাধারে লেখক, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, গল্পকার ও সফল কথাসাহিত্যিক। তিনি সাহিত্যজগতে প্রবেশ করেন ‘কিশোর বাংলা’ নামের পত্রিকায় শিশুতোষ গল্প লিখে। এছাড়া ১৯৭৭ সালে ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’ পত্রিকায় ‘সজনী’ নামের ছোট গল্প লিখে পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেন।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ২০১৯ সালে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করে। কিন্তু এর আগেই, ২০১৩ সালের ৩০ আগস্ট তার অসাধারণ সৃষ্টি ‘নূরজাহান’ উপন্যাসের জন্য তিনি সাহিত্য পুরস্কার ‘আইআইপিএম-সুরমা চৌধুরী স্মৃতি আন্তর্জাতিক পুরস্কার’ পেয়েছেন; যা এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্য পুরস্কারগুলোর অন্যতম। ‘নূরজাহান’ উপন্যাসটি একাধিক ভাষায়ও অনূদিত হয়েছিল।
অমর একুশে গ্রন্থমেলার সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া বইয়ের তালিকায় সবসময়ই জায়গা করে নিয়েছে প্রখ্যাত সাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের বই। ১৯৯৩ সালের বইমেলায় তার এক বই সর্বোচ্চ ৬৩ হাজার কপি বিক্রি হয়েছিল। ২০০৫ সালে তিনি জাপান ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘তাকেশি কায়েকো মেমোরিয়াল এশিয়ান রাইটারস লেকচার সিরিজে’ বাংলা ভাষার একমাত্র লেখক হিসেবে জাপানের চারটি ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে বাংলাদেশের সাহিত্য এবং তার নিজের লেখা নিয়ে বক্তৃতা করেন।
লেখক ইমদাদুল হক মিলন অসামান্য সব লেখা বাংলা সাহিত্যকে উপহার দিয়েছেন। তার মধ্যে অধিবাস, পরাধীনতা, কালাকাল, বাঁকা জল, নিরন্নের কাল, পরবাস, কালোঘোড়া, নেতা যে রাতে নিহত হলেন, মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস সমগ্র, একাত্তর, সুতোয় বাঁধা প্রজাপতি, যাবজ্জীবন, মাটি ও মানুষের উপাখ্যান, পর, কেমন আছ সবুজপাতা, জীবনপুর প্রভৃতি তার বিখ্যাত বই। বাংলাদেশের জীবনমূলক ও প্রেমময় ভালোবাসার সাহিত্যে পাঠক সৃষ্টিতে তার ভূমিকা ব্যাপক।
তার লেখা দুই শতাধিক নাটকের মধ্যে কোন কাননের ফুল, বারো রকম মানুষ, রূপনগর, যত দূরে যাই, যুবরাজ, কোথায় সে জন, আলতা, একজনা, নীলু, তোমাকেই, আঁচল, খুঁজে বেড়াই তারে, কোন গ্রামের মেয়ে, মেয়েটি এখন কোথায় যাবে বিপুল দর্শকপ্রিয়তা পায়।
দুই বাংলার জনপ্রিয় এই কথাসাহিত্যিক লেখালেখির স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা একাডেমি পুরস্কার, হুমায়ুন কাদির সাহিত্য পুরস্কার, এসএম সুলতান পদক, ঢাকা যুব ফাউন্ডেশন পদক, শেরেবাংলা পদক, টেনাশিনাস পুরস্কার, জাপান বিবেক সাহিত্য পুরস্কার, কলকাতা চোখ সাহিত্য পুরস্কার, জাপান রাইটার্স অ্যাওয়ার্ড, মাদার তেরেসা পদক, বাচসাস পুরস্কারসহ বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
লেখালেখির পাশাপাশি ইমদাদুল হক মিলন সাংবাদিকতাতেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তিনি বর্তমানে ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের পরিচালক ও দৈনিক কালের কন্ঠ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত আছেন।