সেনাপতির যুদ্ধ নয়, জনহিতকর কাজেই মুকুট বিহীন সম্রাট “খান জাহান আলী”
- আহমাদ উল্লাহ মাহফুজ
পারস্য দেশ থেকে আসা উলুখ খান বা খানে আজম ,বাংলাদেশে এসে হয়ে গেলেন,খান জাহান আলী। ইতিহাস থেকে পাওয়া যায় খান জাহান আলী ছিলেন সাওদাগর, কিন্তু ইসলাম প্রচারের কাজে আসেন ‘হিন্দু স্থান” ভারতে। দিল্লিতে এসে তিনি হয়ে জান সুলতান মোহাম্মাদ বিন তুঘলকের প্রধানমন্ত্রী। বিদ্রোহ দমেনে সেনাপ্রতি করে তাকে জৈনপুর পাঠানো হয়।কিন্তু জৈনপুর এসে তিনি আধ্যাতিক জ্ঞান লাভ করেন। এসময় তিনি মানব সেবা ও ইসলাম প্রচারের জন্য রাজার দরবার হতে অনেক দূরে চলে যাবার ইচ্ছা প্রশন করেন। তিনি ৩৬০ জন আওলীয়া নিয়ে দক্ষিণ বঙ্গে চলে অবস্থান নেয়। তারপর তিনি জনহিতকর কাজের মাধ্যমে এবং মানুষের দুঃখ দুর্দশা দুর করার জন্য কাজ করতে থাকেন।
ইতিহাস থেকে জানা যায় যে ১৩৫৮ খ্রি.ইলিয়াস শাহের মৃত্যুর পর তার পুত্র সিকান্দর শাহ সিংহাসনে বসেন। সিকান্দর শাহ আবার তার প্রথমা স্ত্রীর একমাত্র পুত্র গিয়াস উদ্দিনকে রাজ্যের র্পূবাঞ্চল শাসন ভার দেন। সোনারগায়ে রাজধানী করে তিনি সাফল্যের সাথে র্পূবাঞ্চল শাসন করতে থাকেন। কিন্তু রাজধানী পানডুয়ায় বিমাতার প্ররোচণায় পিতা সুলতান সিকান্দার শাহ তার অনুগত্যের প্রতি সন্দেহ পোষণ কারায় পিতা পুত্রের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি হয়। বিপদ এক সময় যুদ্ধে রুপ নেয়।যুদ্ধে সিকান্দর শাহ পরাজিত হয় এবং মুত্যু বরণ করলে গিয়াস উদ্দিনের সেনা দক্ষ আজম খান সুলতানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। গিয়াস উদ্দিনের সে দিনের প্রধানমন্ত্রী আজম খানই আজকের খান জাহান আলী।
পরবর্তীতে রাজা গণেশ নামক এক উচ্চ পদস্থ শাসক শাসক সুলতানকে হত্যা করে সৈফুদ্দিন হামজা শাহ নামে গিয়াস উদ্দিনের এক পুত্রকে সিংহাসনে বসান। ষড়যন্ত্রে টিকতে না পেরে নিহত সুলতানের প্রধান উজির খান জাহান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহের অপর পুত্র নাসির উদ্দিন মাহমুদ শাহ ও তার পরিবারের লোকজন নিয়ে রাজ্যের দক্ষিণাঞ্চল সুন্দর বন এলাকায় আশ্রয় নেন।
খান জাহান আলী তার শাসন কেন্দ্রের নাম রেখেছিলেন খলিফাবাদ। খান জাহান কখনো স্বাধীন সুলতান হিসাবে অঞ্চল শাসন করেননি। তিনি সকলের সাথে সামান ভাবে মিলা মিশা করেছেন। তার কাছে বড় -ছোট ধনী-গরিব সাদা-কালো ভেদা ভেদ করেনি। অন্যান্য শাসকদের মতো নিজের নামে কোন মুদ্রার প্রচলন করেননি। নিজের নামে খুৎবার ও চালু করেনি।
তিনি অন্য ধর্মের লোকদের সাথে ও ছিলেন ন্যায় পরায়ণ।ধর্মের নামে কোন যুদ্ধ বাধিয়ে অন্য ধর্মে মানুষের প্রতি কোন অবিচার করতেন না। সকল সম্প্রদায়ের মানুষের জন্যই তিনি কল্যাণকামী ছিলেন। সকল জাত পাতের মানুষের জন্যই তিনি নিরাপ্তার ব্যবস্থা করতেন। সবার দুঃখ, দুর্দশায় এগিয়ে যেতেন। তিনি রাস্তা র্নিমাণের মাধ্যমে মানুষের যোগাযোগের সুব্যবস্থা করতেন। মানুষের খাবার পানি এবং সেচের পানির জন্য তিনি ৩৬০ টি দীঘি খনন করেছিলেন। বিশেষত তিনি ছিলেন সূফিসাধক। ধর্মের কাজেই তার কাছে বড় ছিল। তাই তিনি ৩৬০টি মসজিদ ও নির্মাণ করেছিলেন।
খান জাহান আলীর এসব কাজ করা হয়েছিল যশোরের বারো বাজার হতে শুরু করে গোটা ভাটি অঞ্চলে। তার স্থাপত্য র্কীতি উনিশ শতকের দিকে ধ্বংস পরিনত হয়েছে।ফলে তার সকল স্থাপত্য কীর্তি সংরক্ষণ করা হয়নি যার কারণে তার অনেক কীর্তি ধ্বংস হয়ে গেছে , আজ আর অবশিষ্ট নেই। আর যে সকল কীর্তি দৃশ্যমান আকারে আছে সে গুলোর সংখ্যা নেহাত কম। তবে এখনো যে কীর্তিগুলো অবশিষ্ট আছে সে গুলো সঠিক দেখভাল করে রাখলে সৃতিতে একজন ভালো মানুষের কীর্তি দেখে আজকের মানুষ কিছু শিখতে পারে।
খান জাহান আলীর কীর্তির মাঝে আজও যেগুলো দৃশ্যমান তার মাঝে “ষাট গম্বুজ মসজিদ” অন্যতম।মসজিদটি খান জাহান আলীর এক অন্যান্য সৃষ্টি। এটি অবিভক্ত বাংলার তৃতীয় বৃহত্তম এবং আজকের সময়ে বাংলাদেশের সব থেকে পুরোনো মসজিদ। মসজিদটি বিশ্বের জন্য গুত্বর্পূণ হওয়ায় প্রত্নতাত্ত্বিক র্নিদশন বিবেচিত হওয়ার কারণে ইউনেস্কো প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় সংরক্ষণের্ উদ্যোগ নিয়েছে।
ষাট গম্বুজ মসজিদ ছাড়াও খান জাহানের করা আরো অনেক মসজিদ আছে, তবে সেগুলোতে পরিচিতি মুলক তেমন কোন শিলালিপি পাওয়া যায়নি। কিন্তু মসজিদগুলো নামানুসারে বোঝা যায় যে সেগুলো তার হাতে গড়া, যেমন বিবি বেগনী মসজিদ, সিংগাইর মসজিদ, চুনাখোল মসজিদ, হোসেন শাহী মসজিদ.নয় গম্বুজ মসজিদসহ আরো অনেক মসজিদ আছে যেগুলোতে খান জাহান আলী করার প্রমাণ পাওয়া যায়।
খাঞ্জেলীর দীঘি,মনে করা হয় ১৪৫০খ্রি. তিনি বিশাল প্রায় ২০০০ আয়োতনের একটি পুকুর খনন করেন। যার মাঝে আছে অনেক কুমির। মানুষের বিশ্বাস খান জাহান আলীর ছেড়ে দেওয়া কালা পাহাড় এবং ধলা পাহাড় (নামের দুটি কুমির) তাদের বাচ্চা এগুলা। খান জাহান আলী সৃতিসৌধ ছাড়াও এখনো অনেক স্থাপনার দেখা যায় বাগেরহাটে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে খান জাহান আলীর নাম সোনার অক্ষরে জ্বল জ্বল করছে। ১৪৫৯ খ্রি. ইন্তিকাল করার আগে তিনি মানুষের মাঝে ছড়িয়েছেন উন্নত সভ্যতা ও সংস্কৃতি। বিশেষ করে তিনি বাগের হাটের জন্য একটি আর্শিবাদ এবং বাংলাদেশের জন্য আর্শিবাদ।
প্রতিবেদক: শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা, মিডিয়া ও যোগাযোগ বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি