নির্বাণ লাভের আশায় ঘর ছেড়ে ছিলেন যিনি
- সুরাইয়া সুলতানা রিয়া
হিমালয়ের পাদদেশে ছিল কোশল রাজ্য। সেই রাজ্যের রাজধানী কপিলাবস্তু। রাজ্যের অধিপতি ছিলেন রাজা শুদ্ধোধন। রাজা শুদ্ধোধনের ছিল সোনার মতো সংসার। সুখের কোনো কমতি ছিল না সংসারে। কিন্তু রাজার ভীষণ আফসোস ছিলো তার একটি পুত্র সন্তান না থাকায়। তবে এ আফসোস আর বেশিদিন রইলো না।
রাজা শুদ্ধোধন এবং রানী মায়াদেবীর ঘর আলো করে আসতে চলেছে এক সন্তান। রাজা শুদ্ধোধনের আনন্দের সীমা নেই। তবে রাজা শুদ্ধোধন কোনোভাবেই তার দুশ্চিন্তা এড়াতে পারছেন না। এই দুশ্চিন্তার কারণ হচ্ছে তিনি এই সুখের সময়ে তার স্ত্রীর পাশে থাকতে পারছেন না। ঐতিহ্যগতভাবে এবং সেকালের রীতি অনুযায়ী নারীদের প্রথম সন্তান প্রসব করতে তারা পিতৃগৃহে যায়, এজন্যই রাজা শুদ্ধোধন তার পাশে থাকতে পারছেন না। মায়াদেবীর মনেও একইরকম দুশ্চিন্তা কাজ করছে। তিনি চেয়েছিলেন এমন খুশির একটা মুহুর্তে রাজা মশাই যেন তার পাশে থাকেন। রানী মায়াদেবী রাজবহর নিয়ে পিত্রালয়ের পথে রওনা দিয়েছেন। মায়াদেবীর মনে হচ্ছে এই দীর্ঘ পথ যেন আরো দীর্ঘতর হয়ে যাচ্ছে। তার শরীর ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। তিনি তার তলপেটে ব্যথা অনুভব করতে শুরু করেছেন।
গভীর রাত। এই রাতের বেলাও চারদিক আলোতে ভরে উঠেছে। আকাশে ভরা পূর্ণিমা থাকলেও সেই পূর্ণিমার আলো ভেদ করে আরো আলো ছড়িয়ে পড়ছে সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুটি থেকে। চাঁদের আলো যার কাছে হার মেনে যাচ্ছে সেই শিশুটি হাত পা নেড়ে জানান দিচ্ছে তার অস্তিত্বের কথা। সময়টা ৫৬৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। কপিলাবস্তুর লুম্বিনীর শালবনের বিশ্রাম শিবিরেই সেদিন জন্ম নিয়েছিলো ফুটফুটে সিদ্ধার্ত গৌতম। কে জানতো এই ছোট্ট শিশুটিই হয়ে উঠবে গৌতম বুদ্ধ!
মায়াদেবী ঠিক করলেন তিনি পিত্রালয়ে যাবেন না। নবজাতককে নিয়ে তিনি রওনা দিলেন রাজপ্রাসাদের উদ্দেশ্যে। ফুটফুটে শিশুটির নামকরণ করা হলো। তার নাম রাখা হলো সিদ্ধার্থ গৌতম। সিদ্ধার্থ নামের অর্থ হলো সিদ্ধি লাভ করেছেন যিনি।
ফুটফুটে সন্তানকে পেয়ে রাজার আনন্দের সীমা রইলো না। একই সাথে তিনি প্রচণ্ড দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়লেন। এই দুশ্চিন্তার অবশ্য কারণ ছিল অনেক। রাজপ্রাসাদের জ্যোতিষী সিদ্ধার্থর শরীরে খুঁজে পায় ৩২টি সুলক্ষণ চিহ্ন। তবে এটা মোটেই রাজার চিন্তার কারণ নয়। বরং এটা আনন্দের খবর। রাজা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়লেন যখন জ্যোতিষী বলল, এই পুত্রের রাজ্য শাসন অপেক্ষা জ্ঞান চর্চাতে বেশি আগ্রহ থাকবে এবং মানবতার মুক্তির জন্য এই শিশু একদিন গৃহত্যাগী হবে। এসকল ভবিষ্যৎবানী রাজাকে ক্রমশই দুশ্চিন্তাগ্রস্থ করে তুলছিল।
এদিকে সিদ্ধার্থর সাতদিন বয়সেই তার মায়ের মৃত্যু হলো। এই ঘটনা রাজাকে আরো চিন্তাগ্রস্থ করে তুলল। এই ছোট্ট সন্তান করে সঠিকভাবে বড় করার জন্য মায়ের বিকল্প নেই। তিনি কি করবেন তা নিয়ে দিশাহীনতায় ভুগতে লাগলেন। মায়াদেবীর ছোট বোন কুমারী মহাপ্রজাপতীর সাথে বিবাহের মাধ্যমে রাজার এই দুশ্চিন্তার অবশন ঘটলো। এদিকে অন্য চিন্তা বেড়েই চলেছে। সিদ্ধার্থ যত বড় হচ্ছেন, জ্যোতিষীর করা ভবিষ্যৎবাণীও মিলতে শুরু করেছে। রাজা ঠিক করলেন এই পুত্রকে রাজপ্রসাদের বাইরে বের হতে দেওয়া যাবে না। রাজা মশাই পুত্র সিদ্ধার্থের জন্য আরো অনেকগুলো প্রসাদ নির্মাণ করলেন। যুবক সিদ্ধার্থ তার সঙ্গী ছন্দককে নিয়ে বিভিন্ন প্রাসাদ পরিক্রমায় বের হন। পথে তার দেখা মেলে এক বৃদ্ধা এবং একদল শবযাত্রীর। সিদ্ধার্থ আগ্রহ সহকারে তাদের জীবন সম্পর্কে জানতে চান তার সঙ্গী ছন্দকের কাছে। সিদ্ধার্থের মনে প্রশ্ন জাগতে শুরু করল। মানুষ কেন জন্ম নেয়? কেন রোগাক্রান্ত হয়? কেনই বা মানুষের মৃত্যু ঘটে? কিন্তু নাহ, কোনো উত্তর মেলে না। এভাবেই একদিন সিদ্ধার্থ দেখা পেলেন এক সন্ন্যাসীর।
এ থেকেই শুরু হলো সিদ্ধার্থের নিজের কাছে প্রশ্ন করা এবং সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলা। এদিকে পুত্রের এসব কর্মকাণ্ড দেখে রাজা খুবই চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়লেন। তিনি ঠিক করলেন পুত্রের বিবাহ দিবেন। রাজ্যের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির কন্যা যশোধরার সাথে বিবাহ হলো সিদ্ধার্থের। তাদের ঘরে এলো ফুটফুটে এক পুত্র রাহুল। কিন্তু নাহ, এত কিছুও সিদ্ধার্থকে সংসারের মায়ায় বাঁধতে পারলো না। তিনি যে মানবতার মুক্তির দায়িত্ব নিয়েছেন এবং সেই দায়িত্ব তাকে পালন করতেই হবে।
এক বৈশাখী পূর্ণিমার রাতে সিদ্ধার্থের জন্ম হয়ে ছিল। তেমনি এক আষাঢ়ী পূর্ণিমার রাতে মাত্র ২৯ বছর বয়সে তিনি সংসারত্যাগী হন। শুরু হলো তার নতুন সন্ন্যাসজীবন। নিজের রাজ্য ছেড়ে ভিন্ন রাজ্যে পাড়ি জমালেন। আলার কালম নামে এক যোগীর কাছে শুরু করলেন ৬ বছরের যোগসাধনা। যোগসাধনা শেষে তার চিন্তা চেতনার মাত্রা আরো বাড়তে লাগলো।
একসময় তিনি ধ্যানমগ্ন হয়ে উঠলেন। লাভ করলেন দিব্যজ্ঞান। সিদ্ধার্থ থেকে হয়ে উঠলেন বুদ্ধ। বুদ্ধ শব্দের অর্থ হলো মহাজ্ঞানী। এভাবে ধ্যানমগ্ন থাকতে থাকতে তিনি কৃষ্ণকায় এবং কঙ্কালের ন্যায় হয়ে গেলেন। ধ্যান ভাঙার পর তিনি নীরঞ্জনা নদীতে স্নান সেরে ভিক্ষা পাত্র হাতে নিয়ে পথে বের হলেন। তিনি মানুষকে পথিমধ্যে উপদেশ দেওয়া শুরু করলেন। তার মতে মধ্যমার্গের উপায় হচ্ছে ৮টি৷ যেগুলোকে তিনি অষ্টমার্গ বলে বর্ণনা করে গেছেন। তা হলো- সৎ সংকল্প, সৎ চিন্তা, সৎ বাক্য, সৎ ব্যবহার, সৎ জীবনযাপন, সৎ চেষ্টা, সৎ দর্শন এবং সম্যক সমাধি।
ছত্রিশ বছর বয়সে গৌতম বুদ্ধ বুদ্ধত্ব লাভ করেন। বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেন মানবতার মুক্তি সাধন, দর্শনের প্রচার, ধর্মাপদেশ দান করে। তিনি ছিলেন একাহারী, চলাফেরা করতেন খালি পায়ে।
গৌতম বুদ্ধ সারাজীবন অহিংসার কথা বলে গেছেন। মানুষকে দিয়েছেন ত্যাগের শিক্ষা। তিনি ছিলেন বাস্তবধর্মী সংস্কারক। বুদ্ধের মতে জন্মই দুঃখের কারণ। মানবজাতির দুঃখমুক্তির পথনির্দেশ করাই ছিলো বুদ্ধের একান্ত কামনা।
একসময় বুদ্ধ দুঃখ মুক্তির পথও খুঁজে পেলেন। যার নাম দিলেন নির্বাণ। তিনি বলে গেছেন, ‘কাম তৃষ্ণা, ভব তৃষ্ণা ও বৈভব তৃষ্ণা অতিক্রম করতে পারলেই নির্বাণ লাভ করা সম্ভব’। এদের থেকে মুক্তিলাভের জন্য বুদ্ধ অষ্টাঙ্গিক মার্গের নির্দেশ দিয়েছেন।
বুদ্ধ পরকাল নিয়ে অনেক কিছুই বলে গেছেন। তার মতে, পরকাল হচ্ছে ইহজন্মের করা কর্মের ফলাফলের ওপর নির্ভর করে। তিনি মনে করতেন, মৃত্যুর পর পুণরায় মানুষের আত্মা দেহলাভ করে।
বোধিলাভের পর গৌতম বুদ্ধ শুরু করেন ধর্ম প্রচার। বৌদ্ধ ধর্ম মূলত জীবনাদর্শন। সবার আগে তিনি তার ধর্ম প্রচার করেন তার পাঁচজন শিষ্যের কাছে। এরপর আস্তে আস্তে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে বুদ্ধের প্রচারিত বাণী।
এভাবেই তিনি কালের পরিক্রমায় সিদ্ধার্থ থেকে হয়ে উঠলেন গৌতম বুদ্ধ। তার বাণীর মূল অর্থ হলো ‘অহিংসা’।
এক বৈশাখী পূর্ণিমার তিথিতে জন্ম নিয়েছিলেন গৌতম বুদ্ধ। ঠিক তেমনি ৪৮৩ খ্রীস্টপূর্বাব্দে এক বৈশাখী পূর্ণিমার তিথিতেই তিনি দেহত্যাগ করেন এবং চিরনির্বাণ লাভ করেন। পয়তাল্লিশ বছর ধরে প্রচার করা বুদ্ধ দর্শন রেখে গেছেন তিনি। সবরকম তৃষ্ণাকে অতিক্রম করে লাভ করেছেন নির্বাণ।