ইতিহাসের কালো অধ্যায় ‘ব্ল্যাক ডেথ’
- সব্যসাচী দাস রুদ্র
১৩৪৭ সালে ইতালির সিসিলি বন্দরে ১২টি বণিক জাহাজ আসে। জাহাজ থেকে কাউকে নামতে না দেখে লোকজন জাহাজগুলোতে প্রবেশ করে। ভেতরে গিয়ে তারা দেখে মৃতদেহের স্তুপ জমেছে প্রতিটি জাহাজে। দেহগুলো বীভৎস অবস্থায় রয়েছে। কিছু সংখ্যক মানুষ জীবিত রয়েছে যাদের অবস্থা আরো ভয়ানক। চামড়া পঁচে গিয়েছে, শরীরে দগদগে ফোসকা, সেসব থেকে পুঁজ এবং রক্ত ঝরছে! জাহাজগুলোতে ওঠা লোকজন ভয়ে জাহাজ ত্যাগ করে এবং সেগুলোকে দূরসমুদ্রে পাঠিয়ে দেয়।
এভাবেই ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ানক মহামারী ব্ল্যাক ডেথ। ১৩৪৬ সাল থেকে ১৩৫৩ সাল অব্দি চলতে থাকা এই মহামারীতে নিহত হোন ২০ কোটি মানুষ। বীভৎস ও যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুব্যাধি গ্রাস করে মানবসভ্যতাকে।
ব্ল্যাক ডেথ ঘটেছিলো বুবেনিক প্লেগ নামের একটি মারণঘাতি প্লেগের মাধ্যমে। ইরসিনিয়া পেস্টিস নামের একটি জীবাণু এই রোগটির সূত্রপাত ঘটিয়েছিল। এই জীবাণু পরিবাহী বিশেষ প্রকার মাছি এবং উঁকুনের কাছ থেকে কালো ইঁদুর এই জীবাণুটিতে আক্রান্ত হয় এবং যা ঘটায় ইতিহাসের সর্বোচ্চ মানুষখেকো মহামারী।
রোগটির প্রাথমিক লক্ষণ ছিল শরীরে উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর থাকে, এরপর শুরু হয় এর সবচেয়ে বেদনাদায়ক অংশ। শরীরের বিভিন্ন স্থানে আপেলের সমান রক্ত ও পুঁজভরা ফোসকা উঠতো যেগুলোতে প্রচন্ড ব্যাথা হতো। ৩ থেকে ৭ দিনের মধ্যে অত্যাধিক ব্যাথা এবং শরীরের ভেতরকার অংশের পঁচনে মানুষ মারা যেতো। রোগটিতে আক্রান্ত ৮০ শতাংশ মানুষ মৃত্যুবরণ করত।
রোগটির সম্ভাব্য উৎপত্তিস্থল হিসেবে ধারণা করা হয় চীনের পার্বত্য অঞ্চলে। ‘সিল্ক রোড’ যা কি না তৎকালীন সময়ের বহুল ব্যবহৃত বাণিজ্য পথ, সেখান থেকেই ক্রিমিয়া এবং বণিক জাহাজ ধরে ইতালি আসে রোগটি। সিসিলি থেকে ভাসিয়ে দেয়া জাহাজগুলো পরবর্তীতে গ্রীসসহ অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলোতে এই রোগ ছড়ায় এবং এরপর এই মহামারী মারণ থাবা বসায় আফ্রিকাতে।
ব্ল্যাক ডেথের ফলে ইউরোপের ৬০ শতাংশ মানুষ নিহত হয়। ইউরোপে প্রবেশের আগে এই রোগে এশিয়াতে আড়াই কোটি মানুষ নিহত হয়। মধ্যপ্রাচ্য এই মহামারীতে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বড় বড় শহরগুলোতে ময়লা ফেলা ঝুড়িতে করে রাস্তা থেকে লাশ সরাতে হতো। গোটা ইউরোপে লাশ কবর দেয়ার স্থান সংকট দেখা দেয়। গোটা পৃথিবীর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। শুরু হয় চরম খাদ্যাভাব। মহামারীর সাথে হানা দেয় মানুষে মানুষে দাঙ্গা। ইউরোপের মধ্যযুগীয় কুসংস্কার অনুযায়ী ব্ল্যাক ডেথকে পাপের ফল হিসেবে ধরা হতো। পাপমোচনের নামে ইউরোপজুড়ে শুরু হয় ইহুদি নিধন। স্পেনে গণহারে আরব মুসলিমদের হত্যা করা হতো। প্লেগকে ইউরোপীয়ানরা এতটাই ঘৃণা ও ভয় করতো যে, আক্রান্ত ব্যক্তিকে পরিবারসহ একটি স্থানে বদ্ধ করে রাখা হতো। প্রকাশ্যে আক্রান্ত ব্যক্তিকে পুড়িয়ে ফেলার নির্মম ইতিহাসও আছে এই মহামারীতে।
মধ্যযুগের অনুন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার সময়ে চিকিৎসকদের অবস্থা ছিল প্লেগে আক্রান্ত হওয়ার থেকেও ভয়ানক। সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচার জন্য চিকিৎসকরা লোহার ভারী পোশাক এবং মুখে পাখির ঠোঁট আকৃতির একটি বর্ম পরে থাকতেন। তারা আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের ফোসকা গুলোকে উত্তপ্ত লোহার সাহায্যে পুড়িয়ে ফেলতো। এই নরক যন্ত্রণাতেই অনেকে মৃত্যুবরণ করত। এছাড়াও শরীর থেকে রক্ত নিঃসরণ করে এই রোগের চিকিৎসা দেয়া হতো। মানুষের শিরা কেটে এই কাজটা করা হতো।
ব্ল্যাক ডেথের ছোবলে পৃথিবীর অর্ধেক জনসংখ্যা কমে গিয়েছিল। বড় বড় শহরগুলো মানুষশূন্য হয়ে পড়ে। শ্রমিকের সংকট শুরু হয়। প্লেগের শেষে মানব সভ্যতাকে পুণরায় যাত্রা শুরু করতে হয়। কোয়ারেন্টাইন বা সামাজিক দূরত্ব কঠোর করার মাধ্যমেই এই মহামারী থেকে রক্ষা পায় পৃথিবী। এরপর চিকিৎসা বিজ্ঞানসহ প্রতিটি শাখাতেই ব্যাপক পরিবর্তন আসে। ব্ল্যাক ডেথের থেকে নেয়া শিক্ষা থেকেই পরবর্তী শতাব্দীগুলোর মহামারী থেকে খানিকটা রক্ষা পায় পৃথিবী, যা সর্বশেষ করোনা মহামারীতেও বিদ্যমান।