নারায়ণগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী নৌকার হাট
- সানজিদা আক্তার
নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। এদেশে রয়েছে অসংখ্য নদী-নালা,খাল-বিল। তাই একসময়ে এদেশের মানুষের যাতায়াতের প্রধান মাধ্যমই ছিল নৌকা। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে গ্রাম অঞ্চলের মানুষ নৌকা ছাড়া যেন ছিল অচল। এখন এই নৌকা প্রায় বিলুপ্তের পথে থাকলেও প্রায় দুইশত বছর ধরে এই ঐতিহ্যকে রক্ষা করে আসছে নারায়ণগঞ্জের কাইকারটেক হাট, যেখানে শতশত নৌকার ক্রেতা বিক্রেতাদের ভীড়ে মুখরিত থাকে প্রতি সপ্তাহে।
এই হাটটিকে কাইকারটেক হাট ডাকা হয় মূলত এলাকার নাম থেকে। আবার অনেকে এটিকে রবিবারের হাটও বলে থাকে, কেননা প্রতি রবিবার শতশত ক্রেতা-বিক্রেতা চলে আসেন নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলার মোগরাপাড়া ইউনিয়নের এই কাইকারটেক এলাকাটিতে। প্রতি রবিবার এই হাটের দেখা পাওয়া গেলেও নৌকার দেখা পাওয়া যায় শুধুমাত্র আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র ও আশ্বিন মাসে এবং এই হাটটি কার্যক্রম চালু থাকে সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত।
কাইকারটেক হাটের নৌকাগুলো সুলভ মূল্য ও ভাল মানের হওয়ায় এগুলো কেনার উদ্দেশ্য দূরদূরান্ত থেকে অনেকেই আসে এখানে। হাটে নানা ধরনের নৌকা থাকলেও সব থেকে বেশি বেচা-কেনা হয় ছোট নৌকাগুলো। বিশেষ করে জেলেরা এই ছোট নৌকাগুলো কিনে থাকে মাছ ধরার জন্যে। আর এই ছোট নৌকাগুলো পাওয়া যায় তিন থেকে আট হাজার টাকার মধ্যে। হাটটিতে নৌকা ছাড়াও রয়েছে হাড়ি-পাতিল, দা,বটি, কাস্তে, মাছ ধরার জাল, জামাকাপড়সহ নানা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস। কাঁচা সবজি থেকে শুরু করে মাছ-মাংস সবই পাওয়া যায় এই বাজারটিতে।
এখানকার গরু-ছাগল, হাস-মুরগি, পাখি, মাছ সুলভ মূল্যের হওয়ায় ক্রেতাদের ভিড়ে মুখর থাকে এই কাইকারটেক হাটটি। এমনকি মাঝেমধ্যে ঘোড়ারও দেখা পাওয়া যায় এখানে। মৌসুমি ফল ও সবজি যেমনঃ আম, জাম, কাঠাঁল, লিচু, পেয়াজ, মরিচ, আলু, ধনিয়া পাতা, লাউ, গাজর, টমেটো, ফুলকপিসহ সবই দেখা মেলে বাজারটিতে।
হাটটির আরেকটি বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে মুখোরচক খাবার। খাবারের সুঘ্রাণ ছড়িয়ে থাকে পুরো হাটজুড়ে। মুখোরোচক খাবারের মধ্যে রয়েছে দই, মিষ্টি ,জিলাপি, হরেক রকম বিস্কুট, চানাচুর, ছোলা, ঝালমুড়ি, লাচ্ছি, পেয়াজু, নিমকিসহ আরো নানা খাবার। এখানকার ঐতিহ্যবাহী একটি খাবার হচ্ছে “পুতা মিষ্টি”। এই মিষ্টিটি সাধারণ মিষ্টি থেকে আকারে বড় হওয়ায় এটিকে”পুতা মিষ্টি” বলা হয়। প্রতিটি মিষ্টি এক কেজি থেকে শুরু করে দুই কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে এবং মিষ্টিগুলো প্রতি কেজি বিক্রি করা হয় ১২০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত। মিষ্টিটি পরোটা দিয়ে খাওয়ার জন্য বেশ জনপ্রিয়। “পুতা মিষ্টি” ছাড়াও এখানকার কালোজাম, রসগোল্লা এবং দইও বেশ জনপ্রিয়। শুধুমাত্র এখানকার মিঠাই এর শরবত খাওয়ার জন্যেও অনেকের আগমন ঘটে এই হাটে।
ঐতিহ্যবাহী এই কাইকারটেক হাটের সঠিক প্রতিষ্ঠাকাল জানা থাকলেও এখানকার ঐতিহ্যের যেন কোন কমতি নেই। দেখে মনে হবে সব কিছুতেই যেন ঐতিহ্যের ছোয়া। ঐতিহ্যবাহী খাবার থেকে শুরু করে গ্রাম বাংলার সংস্কৃতি মিলে এ যেন এক বিচিত্র হাট!