বিলুপ্তির পথে কি বেদে সম্প্রদায়!
- সাজেদুল হেকিম জিহাদ
দেশের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী বেদে সম্প্রদায়। নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য এখন কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত এই সম্প্রদায়। এতদিন তারা জীবিকার সন্ধানে যাযাবরের মতো নৌকায় করে এঘাট-ওঘাট ঘুরে বেড়াত। এখন যেন সেই জীবন হয়ে উঠেছে আরো দুঃসহ।
বেদে নামটির অবজ্ঞাসূচক ডাক বাইদ্যা (হাতুড়ে ডাক্তার) পরিমার্জিত বৈদ্য (চিকিৎসক) থেকে উৎপত্তি। আরকান রাজ্যের, ‘মনতাং’ থেকে এসেছে বিধায় এদেরকে মনতাং বলা হলেও কালের পরিবর্তনে এরা কবিরাজিতে সম্পৃক্ত হওয়ায় ‘বাইদ্যা’ থেকে তারা বেদে উপাধি পায়! তারা নৌকায় ঘুরে বেড়ায় গ্রাম থেকে গ্রাম, বন্দর থেকে বন্দরে। মাঝে মধ্যে স্থলে নোঙর ফেলে টোড়ী বা তাঁবুতেও বাস করে। বাংলাদেশে বর্তমান বেদে জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কত হতে পারে সেই পরিসংখ্যানও জানা নেই কারো।
১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে শরণার্থী আরাকান রাজ বল্লাল রাজার সঙ্গে ঢাকায় আসে বেদেরা; বাঙালির অতি পরিচিত নৃ-গোষ্ঠী। সাধারণত বাদিয়া বা বাইদ্যা নামে পরিচিত। এরা এক ধরনের পেশাজীবী গোষ্ঠী। পরে এরা ইসলাম ধর্ম দীক্ষা নেয়। তৎকালীন সময়ে ঢাকা থেকে প্রথমে বিক্রমপুর অঞ্চল, পরে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে এরা ছড়িয়ে পড়ে। আবার ভিন্ন মতও আছে।
বেদেদের জীবন বড়ই বিচিত্র। তাদের ধর্মমত, বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান, চলাফেরা, কথাবার্তা- সবকিছুতে এক ধরনের রহস্যময়তা দেখা যায়। যাচাই করে দেখা যায়, সাধারণত বেদেদের ভাষায় অন্য সাধারণরা কথা বলতে পারে না। কারণ তাদের ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার মিল নেই বলা যায়। কেউ সঠিক করে বলতে পারে না- এরা কারা! কোথায় তাদের আদি নিবাস। এটি একটি স্বতন্ত্র ভাষা, যা জটিল ও দুর্বোধ্য। বেদেরা নিজেদের ‘মাঙতা’ বা ‘মানতা’ নামে ডাকে।মাঙতা অর্থ মেগে বা ভিক্ষা করে খাওয়া।
তারা সাধারণত সাপ, বাঁদর, ভাল্লুক ইত্যাদি নাচিয়ে, শারীরিক কসরত ও জাদুর খেলা দেখিয়ে থাকে। পোক-জোঁক ফেলে, শিঙ্গা বসিয়ে, শেকড়-বাকড় ও তাবিজ-কবজ বিক্রি করে পাশাপাশি তন্ত্র-মন্ত্র পড়ে- লোকজনদের থেকে যা পায় তা-ই দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে বলে, তারা নিজেদের কাছে ‘মানতা’ নামে পরিচত। এদের পেশার মধ্যে আরো আছে যেমন, ঝাড়ফুক, সাপের খেলা, যাদু, কবিরাজী, তাবিজ বিক্রি, চুড়ির ব্যবসা ইত্যাদি। আয় রোজগার কমে গেলে তাদের জীবনযাত্রায় নানামুখী পরির্বতন ঘটতে থাকলে কৃষিআবাদ, দিনমজুরির কাজ করে এদেরকে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়।
ঐহিত্যগতভাবেই বেদে সম্প্রদায় মানে ভ্রমণশীল বা ভবঘুরে। তাদের জীবনযাপন, আচার-আচরণ সবকিছু চলে একটি ভিন্ন সংস্কৃতিতে। ভবঘুরে হওয়ায় নদীনির্ভর বাংলাদেশে বেদেদের বাহন তাই হয়ে ওঠে নৌকা। এ সম্প্রদায়ের বাস সাধারণত নদীর পাড় কিংবা কোনো পতিত জায়গায়। নৌকাতেই সংসার আবার নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো দেশ-দেশান্তরে। এর মাধ্যমেই তারা আয় করে জীবিকা নির্বাহ করে। এই সম্প্রদায়ের নারীরা যথেষ্ট শ্রম দেয়। পুরুষরা সন্তানদের লালন-পালন করে। একই সঙ্গে নারীরা যথেষ্ট স্বাধীনতাও ভোগ করে। বলা হয়ে থাকে, বেদে পুরুষরা অলস হয়। কায়িক পরিশ্রমকে তারা পছন্দ করে না। তবে বর্তমান সময়ে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। সওদাগর শ্রেণি নাম দিয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজকাঠামো তৈরি হচ্ছে বেদেদের মধ্যে।
বেদে সম্প্রদায়ের মহল যোগ্য মাদবর, মাতুব্বর রা বলেন, “আমাদের নেই পরিবারের জীবন মান, বাচ্চাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শতকরা ৬০ ভাগ লোকেরই মাথা রাখার বাসস্থান পর্যন্ত নেই। এক বেলা খেতে পেলে অন্য বেলা খাবার জুটবে কি না, সেই দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়েই দিন পোহাতে হয় আমাদের।”
বেদেদের জীবনে আসবে আবার গতিশীলতা, তারা আবার তাদের রঙে ভাসাবে তাদের নৌকা, গাইবে সম্প্রীতির গান, এমনটাই আশা এখন টিকে থাকা বেদে সম্প্রদায়ের মানুষদের। কিংবা কে জানে হয়তো আর কিছু দিন পর দেখা মিলবে না তাদের যাযাবর জীবনের প্রতিচ্ছবি, শুধু রুপকথাতেই মিলবে তাদের অস্তিত্ব।