হাসন রাজার বাড়িতে একদিন
- সিদরাতুল মুরসালিন ভাষা
” লোকে বলে বলেরে ঘরবাড়ি ভালা নায় আমার,
কি ঘর বানাইমু আমি শূণ্যের মাঝার
লোকে বলে বলেরে-
ভালা কইরা ঘর বানাইয়া কয়দিন থাকবো আর,
আয়না দিয়া চাইয়া দেখি পাকনা চুল আমার
লোকে বলে বলেরে-” -হাসন রাজার গান
সুনামগঞ্জের মানুষ হলেও দীর্ঘদিন কক্সবাজার থাকার কারনে নিজের জেলা শহর সুনামগঞ্জ তেমন দেখা হয়নি। ২০১৯ সালে ৪/৫ দিনের এক সফরে যাই এবং স্পিডবোটে করে বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চল পরিদর্শণ করি। কিন্তু সুনামগঞ্জ শহরটি তখন ভাল করে দেখা হয়নি।
অনেকদিন পর আবার সুনামগঞ্জ যাওয়ার প্রোগ্রাম হয়। এক চাচার ছোট ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে সেখানে যেতে হয়। সিলেট শহর থেকে সুনামগঞ্জের দূরত্ব ৬২ কিলোমিটার। বরযাত্রী হিসাবে আমরা মাইক্রোবাসে করে সুনামগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। যওয়ার পথে রাস্তার দুই পাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য আমাকে মুগ্ধ করে তুলে। বৃহত্তর সিলেটের প্রাকৃতিক দৃশ্য যে কত সুন্দর তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায়না।
আমাদের গাড়ি যখন সিলেট জেলার সীমানা ত্যাগ করে সুনামগঞ্জ জেলায় ঢুকলো তখন রাস্তার দুই পাশে দেখতে পেলাম দিগন্ত বিস্তৃত হাওর আর হাওর। এসব হাওরে ধানের ফসল দেখে মনে হচ্ছিল যে ধান ক্ষেতের সোনালী সমুদ্র। আর তারই মধ্য দিয়ে সাঁতার কেটে চলছে আমাদের সাদা মাইক্রোবাসটি।
হওর পাড়ি দিয়ে সুনামগঞ্জ শহরের কাছাকাছি যেতেই রাস্তার দুই পাশে দুইটি বিশাল স্তম্ভ চোখে পড়লো। বদ্যযন্ত্র দো’তারার আদলে তৈরী করা স্তম্ভ দুইটি হচ্ছে সুনামগঞ্জ পৌরসভার তোরণ। আর দো’তারা আকৃতির তোরণ দেখেই মনে পড়ে যায় যে, আমরা হাসন রাজার দেশে এসে পড়েছি। আর তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম এই সুযোগে মরমী কবি হাসন রাজার বাড়িটি দেখে যাবো।
এই এলাকায় প্রবাদ আছে- ” হাওর ভরা ধান আর প্রাণ ভরা গান, এই দুইয়ে ধরে আছে সুনামগঞ্জের মান।” কথাটি একদম সত্যি। ভাটি অঞ্চলের একটি জেলা সুনামগঞ্জ। অথচ এখানে জন্ম নিয়েছেন যুগসৃষ্টিকারী মরমী কবি আর সংগীত সাধকেরা।
হাওর-বাওর নালা-নদী ঘেরা ভাটি অঞ্চলের আউল বাউল পীর ফকির সূফী সাধক ও অসংখ্য চারণ কবি শিল্পীদের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য যাদের নাম মনে পড়ছে তাদের মধ্যে রয়েছেন হাসন রাজা, রাধারমণ, সিতালংশাহ্, আরকুমশাহ্, সৈয়দ শাহনুর শাহ্, শাহ্ আব্দুল করিম, দুরবীন শাহ্ প্রমুখ। তাদের আধ্যাত্মিক সংগীত, মরমী গান, জারী সারী, ধামাইল গান, প্রেম বিরহ ও লোক সংগীত বর্তমানে দেশ বিদেশের বিখ্যাত শিল্পী সাধক ও সংগীতানুরাগীদের মধ্যে ছড়িয়ে আছে।
সুনামগঞ্জ শহর বলতে প্রথমেই আসে হাসন রাজার নাম। রামপাশা আর লক্ষণশ্রী দুইটি বিশাল জমিদারীর ভূপতি হাসন রাজার বাড়ি দেখার কৌতুহল প্রায় সবারই। শহরের মধ্যখানে হাসন নগরে হাসন রাজার বাড়ি ভিটা বিদ্যমান। আমাদের মাইক্রোবাসটি কমিউনিটি সেন্টারে পৌছার সাথে সাথেই গাড়ি থেকে নেমে রিক্সাযোগে চললাম হাসন নগরে হাসন রাজার বাড়ির উদ্দেশ্যে।
সুনামগঞ্জে হাসন রাজার বাড়িতেই তার নামে মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দর্শনার্থী ও পর্যটকদের কৌতুহল নিবৃত্ত কল্পে হাসন রাজার ব্যবহৃত দ্রব্যাদি, বংশ লতিকা ও অন্যান্য তথ্য সংবলিত দলিল মিউজিয়ামে প্রদর্শিত হচ্ছে। অবশ্য সিলেট শহরের জিন্দাবাজারে হাসনরাজার পরিবারের ব্যবহৃত দ্রব্যাদি প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে “রজার্স মিউজিয়াম” নামে ছোট একটি মিউজিয়াম রয়েছে।
হাসন রাজার পুরো নাম দেওয়ান হাছন রাজা চৌধুরী। জন্ম ২১ ডিসেম্বর ১৮৫৪ সাল। মৃত্যু ৬ ডিসেম্বর ১৯২২ সাল। তার পিতার নাম দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী এবং মায়ের নাম হুরমতজান বিবি। পিতার মৃত্যুর পর মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি ভাটি অঞ্চলের বিশাল জমিদারীর উত্তরাধিকারী হন। তৎকালীন পরিবেশ পরিস্থিতি ও বাস্তবতার কারনে অল্প আরবী ও বাংলা ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে তিনি তেমন বেশিদূর এগুতে পারেননি। কিন্তু স্বশিক্ষিত এই রাজা ছিলেন একজন শিক্ষানুরীগী। সুনামগঞ্জের প্রধান প্রধান অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরিতে তার মূখ্য অবদান রয়েছে।
আমাদের ইতিহাসে তিনিই বোধ বয় একমাত্র রাজা যিনি সব সময় প্রজা পরিবেষ্ঠিত হয়ে থাকতেন। কারন তলোয়ার দিয়ে তিনি রাজা হননি। সুর আর সংগীতের শক্তিতে তিনি জয় করেছিলেন প্রজা সাধারণের হৃদয় রাজ্য। যদিও বংশানুক্রমে তিনি ছিলেন রাজ বংশের উত্তরাধিকার কিন্তু সুর আর গানের জন্য তিনি বেঁচে আছেন সংগীতানুরাগী ও সর্বসাধারণের মধ্যে। বেঁচে থাকবেন অনাদিকাল গানের রাজা হয়ে।
একতারা আর দো’তারা ছিল হাসন রাজার প্রিয় বাদ্যযন্ত্র। কিন্তু তিনি দক্ষ ঢোল বাদকও ছিলেন। মাঝে মধ্যে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে নিজের কোলে টেনে নিতেন প্রিয় ঢোলটি এবং স্বতস্ফুর্ত হয়ে বাজাতে থাকতেন। তার প্রিয় ঢোলটি তার বাড়ির মিউজিয়ামে শোভা পাচ্ছে। এছাড়াও তার অন্যান্য বাদ্য যন্ত্রের মধ্যে শোভা পাচ্ছে বাঁশি, মন্দিরা, বড় করতাল, খঞ্জনি, মৃদঙ্গ, সারিন্দা ইত্যাদি।
খুবই সুপুরুষ হাসন রাজা যেমন ছিলেন বিলাসী তেমনি ছিলেন বৈরাগীও। তিনি অত্যন্ত দামি চামড়ার আসন লাগানো বড় ও উঁচু ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতেন। আবার মুক্ত হস্তে দান খয়রাতও করতেন। তিনি পশুপাখি ভালবাসতেন। বিশেষ করে কুড়া ( ডাহুক জাতীয় শিকারী পাখি ) ও ঘোড়া ছিল তার শখের পশুপাখি। এই দুইটি পোষার ব্যাপারে তার আসক্তি ছিল বেশি। কথায় আছে হাতিশালে হাতী আর ঘোড়াশালে ঘোড়া। হাসন রাজারও তেমনি ছিল। তাই তার সংরক্ষিত ১১৮ টি কুড়া পাখির নাম, ৮০ টি ঘোড়া ও ৯ টি হাতীর নাম বর্তমানে হাসন রাজা মিউজিয়ামে শোভা পাচ্ছে। তিনি পোষা শিকারী কুড়া দিয়ে যেমন বন্য কুড়া শিকার করতেন তেমনি দামি ঘোড়া নিয়ে সিলেট, হবিগঞ্জ, ঢাকা এমনকি কোলকাতার বড় বড় ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করতেন। তার ঘোড়ার আসন গুলো মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে।
এছাড়াও হাসন রাজার ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিস পত্র মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে। মিউজিয়ামটি সেমিপাকা বিল্ডিং এবং তার পাশেই অন্য একটি আধাপাকা ঘরে বাড়ির লোকজন বাস করেন। তবে তার বংশধরদের বেশির ভাগই দূর দূরান্তে অবস্থান করে উন্নত জীবন যাপন করছেন। তাদের অনেকে সিলেট, ঢাকা, ভারতের আসাম, কোলকাতা, ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও কানাডায় স্থায়ী ভাবে বসবাস করছেন। সুনামগঞ্জ শহরে যারা অবস্থান করছেন তাদের প্রায় সবাই সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবে উচ্চ পর্যায়ে রয়েছেন। হাসন রাজার এক পৌত্র দেওয়ান তৈমুর রাজা জিয়াউর রহমান শাসন আমলে প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। আরেক পৌত্র দেওয়ান শামসুল আবেদীন সংসদ সদস্য ছিলেন। একজন প্রপৌত্র বিশিষ্ট কবি দেওয়ান মমিনুল মওজুদ্দিন দীর্ঘদিন সুনামগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। কিছুদিন আগে মর্মান্তিক এক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি প্রাণ হারান।
মিউজিয়ামের অনতি দূরে মরমী কবি হাসন রাজার সদামাটা ও সাধারণ কবরস্থান রয়েছে। এই কবরস্থানকেই তিনি তার আসল বাড়ি মনে করতেন। পর্যটক ও দর্শনার্ধীরা খুবই আগ্রহ ভরে কবরটি দেখেন এবং তখন সবারই মনে পড়ে হাসন রাজার লেখা সেই গনটি- “একদিন তোর হইবেরে মরন রে হাসন রাজা, একদিন তোর হইবেরে মরন…।।”