আফসোসের আরেক নাম কানাডা ও কেনিয়া
- দিবাকার চৌধুরী
পুরো বিশ্বে যখন ক্রিকেট উন্মাদনায় ভাসছে তখনও যেন কোন এক অপূর্ণতা রয়েছে ক্রিকেটাঙ্গনে। ১৯ দশকের শেষের দিকে যাদের জন্ম ও ক্রিকেটের টুকটাক খোঁজখবর রাখতেন তাদের হয়তোবা জানার বাকি নেই কেনিয়া ও কানাডা বীরত্ব-গাথা সেই ক্রিকেট ইতিহাসের কথা। এক দশক আগেও ক্রিকেট পাড়ায় ভালোই ছড়ি ঘোরাতো কানাডা, কেনিয়া সহ আইসিসির সহযোগী দলগুলো। বিশ্বমঞ্চে বড় দলগুলোর বিপক্ষে হরহামেশা অঘটন জন্ম দেওয়া এই দলগুলো এখন যেন অস্তিত্বহীনতার শঙ্কায় ভুগছে।
১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে এসেই কেনিয়ার ক্রিকেটে ধরা দেয় এক অবিশ্বাস্য সাফল্য। নবাগত কেনিয়ার বিষাক্ত ছোবলে সেদিন নীল হয়েছিল ব্রায়ান লারার ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সাফল্যের এই ধারা কেনিয়াকে বয়ে নিয়ে যায় ২০০৩ বিশ্বকাপে। সেখানে সফলতার চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছায় পূর্ব আফ্রিকার এই দলটি, ঘায়েল করে শ্রীলংকা, বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়েকে; যার বদৌলতে দলটি পৌঁছে যায় সেমিফাইনালে। যা কেনিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসে সর্বোচ্চ সফলতা। বিশ্বকাপে বাইরে ও এই দলটি দুই বার করে হারের স্বাদ দিয়েছে তৎকালীন পরাক্রমশালী ভারতকে। লাখো ক্রিকেট ভক্তের মনের অন্ধকার কোটরে আজও এক আজব প্রশ্ন হয়ে ঘুরে বেড়ায় যে, বিশ্বকাপের শেষ চারে পৌঁছানো সেই দলটি আজ কোথায়?
ক্রিকেট পাড়ায় কেনিয়া যদি হয় এক হতাশার নাম তবে আরেক আফসোসের নাম তবে কানাডা। এই দেশটির রয়েছে গৌরব উজ্জ্বল এক ক্রিকেটীয় উপাখ্যান। ক্রিকেট ঐতিহ্যে কানাডা যেন এক সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবারের সদস্য। এতটাই সম্ভ্রান্ত যে আপনি হয়তোবা প্রথম বলায় বিশ্বাসই করতে চাইবেন না!
উত্তর আমেরিকার এই দেশে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে ক্রিকেটের প্রচলন ঘটে। ১৮৬৭ সালে ক্রিকেটকে জাতীয় খেলা হিসেবে ঘোষণা করে কানাডার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জন এ ম্যাকডোনাল্ড। আশ্চর্য হলেও সত্য, দুই দেশের মধ্যে প্রথম কোন আন্তর্জাতিক ম্যাচও ছিল কানাডায়। সফরকারী কানাডাকে সেদিন আতিথেয়তা দিয়েছিলেন আরেক বিস্ময় জাগানিয়া দল আমেরিকা। ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম সফরটিও হয়েছিল কানাডায়। ১৮৫৯ সালে ইংল্যান্ডকে আতিথেয়তা দিয়েছিল কানাডিয়ানরা। ইংল্যান্ডের হয়ে সেই বার কানাডা সফরে গিয়েছিলেন লিজেন্ড স্যার ডন ব্র্যাডম্যান, আর্থার মেইলি ও চ্যাপেল ব্রাদার্স এর মত সব কিংবদন্তিরা।
পুরানো কাসুন্দির সাথে রয়েছে নতুন কিছুও ২০০১ সালে আইসিসি ট্রফি বাধা টপকে সেই বার কানাডা ২৪ বছর পর দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ আসরে জায়গা করে নেয়। ২০০৩ বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচেই বাংলাদেশকে হারিয়ে চমক জাগানিয়া এক দলে পরিণত হয় কানাডা। ওই বিশ্বকাপেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে এক কীর্তি করে বসেন কানাডার ওপেনার জন ডেভিসন ৬৭ বলে করেন দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি, যা ২০০৩ সালের আগে করতে পারেনি কেউই। গোটা আসর জুড়ে রেকর্ডের ফুলঝুরি যেন বিশ্বকাপে স্মরণীয় করে রেখেছিল কানাডাকে।
জায়েন্ট কিলারের তকমা লাগানো এই দলগুলো হারিয়ে যাওয়ার পিছনে রয়েছে ক্রিকেটের অপরাজনীতি ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব রয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। শুধুমাত্র পরিকল্পনার অভাবে যে একটি দেশের সম্ভাবনার ধ্বংস হতে পারে তার জলজ্যান্ত উদাহরণ হতভাগা এই কেনিয়া। কেনিয়ার ক্রিকেটের আজকের এই দুরবস্থার মূল কারণ, দেশেটির ক্রিকেট প্রশাসকদের বিশৃঙ্খল কর্মকাণ্ড ও অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত। একসময়ের যে দলটিকে নিয়ে ভীত থাকতো ক্রিকেট পরাশক্তিরা এখন যেন সেই দলটি নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।
২০০৩ বিশ্বকাপের কানাডা দলে ছিল না কোন পেশাদার ক্রিকেটার, সবাই সারা সপ্তাহ ধরে কাজ করে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ক্রিকেট খেলে। ছাত্র-শিক্ষক সেলস-ম্যান ইঞ্জিনিয়ার এ সমস্ত পেশার লোকদের নিয়ে গঠিত হয় ২০০৩ বিশ্বকাপের কানাডা দল। একেকজন খেলোয়াড় কে ছুটি নিয়ে আসতে হয় বিশ্বমঞ্চে। একটি দেশের ক্রিকেট কাঠামো কতটুকু পরিকল্পনাহীন হলে এরকম একটি সিদ্ধান্ত সে দেশের ক্রিকেট বোর্ড নিতে পারে।
আর এভাবেই কানাডা কেনিয়ার মত দুটি সম্ভাবনাময় দলের সলিল সমাধি ঘটে। আইসিসির সহযোগী সদস্য দলগুলো নিজেদের সামর্থ্য প্রমাণের যথেষ্ট সুযোগ পায়না। দুই-একটি সিরিজ খেলা ছাড়া তেমন কোনও অংশগ্রহণের কোন সুযোগই নেই এই দলগুলোর। বড় দলগুলোর সাথে দেখা হয় শুধু বিশ্বকাপের মঞ্চে, তাও আবার বিশ্বকাপ খেলতে পাড়ি দিতে হয় নানান চড়াই-উৎরাই।
খেলাধুলার এই বিশ্বায়নের যুগে ফিফা যখন ৩০ থেকে ৩২ টি দল নিয়ে বিশ্বকাপ আয়োজন কর, সেখানে আইসিসি কেবল ১০ থেকে ১২ টি দল নিয়ে আয়োজন করে ওয়ানডে বিশ্বকাপ। টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়া দশটি দলের মধ্যে আটটি দল সরাসরি বিশ্বকাপ খেলতে পারলেও বাকি চারটি দল বাছাইপর্ব খেলে সুযোগ পায় বিশ্বকাপে। এভাবে ছোট দলগুলোর উন্নতি সম্ভব কিনা; প্রশ্ন তো থেকেই যায়!