কুর্মিটেলায় এ যেন গলফারদের এক মিলনমেলা!
- নিজস্ব প্রতিবেদক
কেউ এসেছেন ব্রাজিল থেকে, কেউ এসেছেন দক্ষিণ কোরিয়া থেকে। কেউ বা এসেছেন ভারত থেকে, আবার কেউ কেউ এসেছেন পাকিস্তান, তুরষ্ক কিংবা যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এঁদের সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে যোগ হয়েছেন প্রায় ৬০০ গলফার। এদের মধ্যে আবার বেশ কয়েকজন নারী গলফারও রয়েছেন । মাথায় ক্যাপ, গায়ে জার্সি, হাতে লম্বা একটি দণ্ড। দণ্ডটি দিয়ে সজোরে আঘাত করছেন সবুজ ঘাসের উপর পড়ে থাকা সাদা ডিমের মতো একটি বলকে। মুহূর্তে বলটি উড়ে যাচ্ছে দূরে… অনেক দূরে। আবার অনেকের নিশানা এমন সঠিক যে একেবারে নির্ধারিত গর্তে গিয়ে পড়ছে সাদা বলটি।
দৃশ্যটি রাজধানীর কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবের। গত ৩ থেকে ৫ নভেম্বর কুর্মিটোলা গলফ কোর্সে দেখা গেছে এমন দৃশ্য। তিন দিনব্যাপী ‘৪র্থ ড্যাফোডিল ক্যাপ্টেন কাপ গলফ টুর্নামেন্ট’ খেলতে জড়ো হয়েছিলেন তাঁরা। দেশ বিদেশ থেকে প্রায় ৬০০ জন গলফার অংশ নিয়েছিলেন এ টূর্নামেন্টে।
দেশের সবচেয়ে বড় এ গলফ টুর্নামেন্টটি গত চার বছর ধরে নিয়মিত আয়োজন করছে ড্যাফোডিল ফ্যামিলি। এ বছর ছিল টুর্নামেন্টটির চতুর্থ আয়োজন। ৪র্থ ড্যাফোডিল ক্যাপ্টেন কাপ গলফ টুর্নামেন্ট উপলক্ষ্যে সবুজ কুর্মিটোলা গলফ ক্লাব সেজেছিল বর্ণাঢ্য সাজে নান্দনিকরূপে। ক্লাবের রীতি অনুযায়ী প্রধান অতিথি একই দিনে সকালে উদ্বোধন করেন এবং সন্ধ্যায় সমাপনী অনুষ্ঠানে যোগদান করেন এবং বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করেন। তাই ৫ নভেম্বর সমাপনী দিবসে গলফ ক্লাব যেন ভেসে যাচ্ছিল আলোকসজ্জার ঝর্ণাধারায়। করোনা অতিমারীর কারণে দীর্ঘ দেড় বছরের ও বেশী সময় বিরতির পর ২০২১-২০২২ সেশনের গলফ সেশন শুরু হয় ৪র্থ ড্যাফোডিল ক্যাপ্টেন কাপ গলফ টুর্নামেন্ট এর মাধ্যমে । ফলে এ টূর্নামেন্টের প্রতি গলফারদের আগ্রহ ছিল অনেক বেশী ।
প্রথাগত নিয়মানুযায়ী বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান এবং কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবের প্রেসিডেন্ট জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ প্রধান অতিথি হিসেবে সকাল সাড়ে ৮ টায় আনুষ্ঠানিকভাবে এই টুর্নামেন্টের উদ্বোধন করেন। যদিও টূর্নামেন্ট শুরু হয়ে গিয়েছিল ৩রা নভেম্বর থেকে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণকারী সদস্য ছাড়াও কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও এরিয়া কমান্ডার, লজিষ্টক্স্ এরিয়া মেজর জেনারেল মো. জহিরুল ইসলাম, ক্লাব ক্যাপ্টেন ব্রিগেয়িার জেনারেল মো. তাজুল ইসলাম ঠাকুর, টুর্নামেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবিদুর রেজা খান (অবঃ), ড্যাফোডিল ফ্যামিলির চেয়ারম্যান ড. মো. সবুর খান, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপ-উপাচার্য প্রফেসর ড. এস এম মাহাবুব-উল-হক মজুমদার, ক্লাবের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জিএসএম হামিদুর রহমান (অব.), ক্লাবের জেনারেল ম্যানেজার, গলফ অপারেশনস লে. কর্নেল এম এম গোলাম মোহায়মেন (অবঃ) এবং উভয় সংস্থার উর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ ও সংশ্লি¬ষ্ট পদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। সারাদিন চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা শেষে সন্ধ্যায় আসে সেই মন্দ্রেক্ষণ- সমাপনী ও পুরস্কার বিতরণী, র্যাফেল ড্র, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও গালা ডিনার । ইতিমধ্যে খেলোযাড়রা তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে সদলবলে হাজির হয়েছেন ব্যাঙ্কুুয়েট হলে।
মুহূর্তেই ক্লাব মিলনায়তন যেন গলফারদের এক মিলনমেলায় পরিণত হয়। কানায় কানায় পূর্ন হয়ে যায় ব্যাঙ্কুয়েট হল। পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। দীর্ঘ করোনাকালীন বন্দীদশার পর এভাবে একত্রিত হতে পেরে সবার মনেই খেলে যায় স্বস্তির হাওয়া।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই স্বাগত বক্তব্য নিয়ে আসেন ড্যাফোডিল ফ্যামিলির চেয়ারম্যান ড. মো. সবুর খান। তিনি দেশ-জাতির উন্নয়নে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সেই ১৯৯০ সাল থেকে ড্যাফোডিল ফ্যামিলির অবদানের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতসহ ৫৪ টি সিস্টার কনসার্নের সমন্বয়ে দেশের উন্নয়নে পরিচালিত ড্যাফোডিল ফ্যামিলির সামগ্রিক কর্মকান্ড তুলে ধরেন। বক্তৃতায় তিনি বলেন, করোনা অতিমারী আমাদের শিখিয়ে দিয়ে গেছে করোনা থেকে রক্ষা পেতে ফিজিক্যাল ইমিউনিটি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই এবং সেজন্য প্রাত্যহিক জীবনে খেলাধুলার নিয়মিত চর্চা কতটা অপরিহার্য। তাই আগামী দিনগুলিতেও ড্যাফোডিলের এ প্রয়াস অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন তিনি।
পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠানে সেনা প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ বলেন, এতজন গলফারকে একসঙ্গে দেখার সৌভাগ্য সাধারণত হয় না। ড্যাফোডিল ক্যাপ্টেন কাপ গলফ টুর্নামেন্টের কল্যাণে আমরা সবাইকে দেখতে পাই। সারা দেশের গলফাররা একত্রিত হওয়ার সুযোগ পাই। শুধু তাই নয়, বিদেশি গলফারদের সঙ্গেও পরিচিত হওয়ার সুযোগ মেলে এই টুর্নামেন্টের কারণে। ক্লাব মেম্বাররাই হচ্ছেন ক্লাবের প্রাণ। ড্যাফোডিল সত্যিই এক দারুণ সুযোগ তৈরি করেছে গলফারদের জন্য। তিনি আারো বলেন, আজকের এই অনুষ্ঠান তিনটি বিশেষ কারণে আমার কাছে তাৎপর্যপূর্ণ প্রথমতঃ আমরা এ বছর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপন করছি। পাশাপাশি আমরা এবছর আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছি এবং সর্বশেষ এ মাসেই সশস্ত্রবাহিনী দিবস পালন করছি। পাশপাশি তিনি মাননীয় প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিও তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তাকে এ মর্যাদাপূর্ন পদে নিয়োগ দানের জন্য।
ড্যাফোডিল পরিবার সম্পর্কে উচ্ছসিত প্রশংসা ঝরে পড়ে ব্রিগেয়িার জেনারেল মোঃ তাজুল ইসলাম ঠাকুরের কণ্ঠেও। তিনি বলেন, ড্যাফোডিলের এই উদ্যোগ সত্যিকার অর্থেই এক অনন্য উদ্যোগ। গলফাররা সারা বছর অপেক্ষা করে থাকে এই টুর্নামেন্টের জন্য।
কিন্তু এই টুর্নামেন্ট আয়োজনের উদ্দেশ্য শুধু গলফারদের একত্রিত করা নয়, এর উদ্দেশ্য আরও ব্যাপক ও বৃহৎ। অন্তত তেমনটাই শোনা গেল ড্যাফোডিল পরিবারের চেয়ারম্যান ড. মো. সবুর খানের কণ্ঠে। তিনি বলেন, আমরা একটা সমৃদ্ধ জাতি গড়তে চাই। এজন্য ড্যাফোডিল পরিবার তার জায়গা থেকে সাধ্যমতো সবকিছু করে যাচ্ছে। এই ক্যাপ্টেন কাপ গলফ টুর্নামেন্ট আয়োজন সেই চেষ্টারই অংশ।
বক্তৃতা পর্ব শেষে বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন সেনা প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ। বিজয়ী গলফাররা পুরস্কার হাতে পেয়ে উচ্ছাস প্রকাশ করেন। তারা চান এই আনন্দের উপলক্ষ তাদের জীবনে বারবার ফিরে আসুক। এরই মধ্যে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সাংষ্কৃতিক দল মঞ্চে হাজির হয় তাদের মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নিয়ে। তাদের মনোমুগ্ধকর সাংস্কৃতিক পরিবেশনা সবাইকে মুগ্ধ করে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শেষে রাতের খাবারের ঘোষণা আসে ঘোষণা মঞ্চের উপস্থাপিকা তাহসিনা ইয়াসমিনের কন্ঠে।
রাতের খাবার শেষেও সবার বাড়তি আগ্রহ থেকে যায় আকর্ষণীয় র্যাফেল ড্র অনুষ্ঠানের প্রতি। র্যাফেলে স্কোর কার্ডস বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করেন ড্যাফোডিল পরিবারের ভাইস চেয়ারম্যান সাহানা খান। অনুষ্ঠানে আগত অতিথিও স্পাউজদের জন্য ড্যাফোডিল পরিবার আয়োজিত বিশেষ র্যাফেল ড্র বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করেন সেনা প্রধান পত্নী মিসেস নূরজাহান আহমেদ। র্যাফেল অনুষ্ঠানের সমাপ্তির মধ্য দিয়ে পর্দা নামে ৪র্থ ড্যাফোডিল ক্যাপ্টেন কাপ গলফ টুর্নামেন্টের। দেশে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করলে হয়তো আবার এক বছর পর এমন মিলন মেলারআয়োজন ঘটবে ৫ম ড্যাফোডিল ক্যাপ্টেন কাপ গলফ টুর্নামেন্ট। এ প্রত্যাশায় সবাই বিদায় নেন।