যেখানে রোবট, গেম বানাতে শেখে শিশুরা
- বিজ্ঞান প্রযুক্তি ডেস্ক
কম্পিউটারের একটি প্রোগ্রামের কোডের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করছিল নূর (১৩) ও ফাইয়াজ (৯)। বারবার সমাধানের চেষ্টা করছিল তারা, ব্যর্থও হচ্ছিল। পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সাহায্য করছিলেন একজন শিক্ষক। শেষ অবধি শিশু দুটি পারল।
গুলশানের নিকেতনের যে প্রতিষ্ঠানে এই শিশুরা প্রযুক্তির নিত্যনতুন খেলায় মেতে ওঠে, সেটির নাম দ্য টেক ল্যাব। আবাসিক এলাকার একটি ফ্ল্যাটে গড়ে তোলা হয়েছে এটি। এখানে শিশুদের প্রযুক্তিতে হাতেখড়ি হয়। তারা শেখে কীভাবে সার্কিট ও প্রোগ্রামিংয়ের কাজ করতে হয়। শেখে গেম ও অ্যাপ তৈরির নানা কলাকৌশল।
শুধু শেখাতেই শেষ নয়; এরপর চলে নিজেদের উদ্ভাবন। এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এরই মধ্যে কম্পিউটার গেম থেকে রোবট পর্যন্ত তৈরি করে ফেলেছে। সেই রোবট হাঁটেও বেশ।
নূরের পুরো নাম আবু নাফিস মো. নূর। বনানী বিদ্যানিকেতনে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে সে। টেক ল্যাবে এক বছরের গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রাম শেষ করে এখন সেখানেই শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করছে। নতুন শিক্ষার্থীদের শেখাচ্ছে প্রযুক্তির বিভিন্ন দিক।
সামিনা সুলতানা লালমাটিয়ায় থাকেন। একটি কলেজের শিক্ষক তিনি। উদ্দীপন স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ে তাঁর ছেলে সৈয়দ সায়ন খালেদ (১৫)। এখন তার স্কুলে পরীক্ষা চলছে। কিন্তু তারপরও টেক ল্যাবে আসা চাই। পড়াশোনার চাপ পাশে রেখে উদ্ভাবনের আনন্দে মেতে উঠতেই ভালো লাগে তার।
টেক ল্যাবে আসার জন্য মায়ের সঙ্গে চুক্তিতে এসেছে সায়ন! এমনিতে দুপুরে পড়তে বসা হয় না কখনো। কিন্তু টেক ল্যাবে আসার জন্য পরীক্ষার পড়া দুপুরেই শেষ করতে রাজি হয়েছে সে। কারণ, বিকেলে যে টেক ল্যাবে আসতে হবে! মা সামিনা সুলতানা বলেন, ‘পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে এখানে আসি। এখানে সমবয়সী অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বেশ আনন্দে থাকে সায়ন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি তার আগ্রহ অনেক। টেক ল্যাবে আসার পর একটি রোবটও বানিয়েছে সে।’
কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পড়াশোনার চাপ ও টেক ল্যাবের প্রযুক্তির শিক্ষা—এ দুটো কি কখনো মুখোমুখি দাঁড়ায়? নেভি অ্যাংকরেজ স্কুলের শিক্ষার্থী নুসরাত রহমান বলে, টেক ল্যাব তাকে হাঁফ ছাড়ার সুযোগ এনে দিয়েছে। পড়াশোনার চাপে কখনো কখনো একটু সমস্যা হয়। এ জন্য সবদিক গুছিয়ে চলতে হয়। সে বড় হয়ে প্রযুক্তি বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে চায়। এরই মধ্যে ফ্ল্যাপি পং নামের একটি কম্পিউটার গেম তৈরি করে ফেলেছে সে।
শুরুর গল্প
টেক ল্যাবের প্রতিষ্ঠাতা নিলয় অনিক। শুরুটা হয়েছিল ২০১৩ সালে পথশিশুদের নিয়ে। পথশিশুদের জন্য একটি স্কুল গড়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন। তাদের পড়াশোনা করাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু ওই কাজটি খুব বেশি দিন চলেনি। টাকাপয়সার অভাবে বন্ধ হয়ে যায় তা।
এরপর নিলয় স্কুলের বাচ্চাদের নিয়ে একটি স্কুল-পরবর্তী প্রতিষ্ঠান তৈরির চেষ্টা করেন। তাতেও ব্যর্থ হয়ে শিশুদের জন্য বিভিন্ন বিষয়ের একটি স্কুল তৈরির উদ্যোগ নেন। সেখানে রোবোটিকস, কম্পিউটার সায়েন্স, মনোবিজ্ঞান প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে পড়ানো হতো। এই উদ্যোগও একসময় থেমে যায়।
২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে শুরু হয় টেক ল্যাব প্রতিষ্ঠার কাজ। এখন মোট ৩০ জন শিক্ষার্থী আছে এখানে। শিক্ষক আছেন তিনজন। বিভিন্ন স্কুলে ওয়ার্কশপ করছে টেক ল্যাব। সেই হিসাবে এই প্রতিষ্ঠান প্রায় এক হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রযুক্তির আলো ছড়িয়ে দিয়েছে। অবশ্য টেক ল্যাবের স্বপ্ন অনেক বড়। এ দেশের প্রতিটি শিশু শিক্ষার্থীকে প্রযুক্তিতে দক্ষ করতে চায় প্রতিষ্ঠানটি, যাতে সবাই প্রযুক্তির উদ্ভাবনে অবদান রাখতে পারে।
নিলয় অনিক বলেন, ‘এখন বেশ সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানদের এখানে নিয়ে আসছেন। আমরা চাই শিশুরা প্রযুক্তি-সম্পর্কিত সমস্যাগুলো নিজেরাই সমাধান করুক। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে থেকে অনেকেই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
২৫ বছরের নিলয়ের পড়াশোনার পাট এখনো শেষ হয়নি। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চতুর্থ বর্ষে পড়ছেন তিনি। এর ফাঁকে ফাঁকে চলছে শিশুদের প্রযুক্তিতে হাতেখড়ি দেওয়ার কাজ।
যেভাবে কাজ করে টেক ল্যাব
টেক ল্যাবে শিশুদের জন্য এক বছরের গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রাম আছে। এতে আছে মোট তিনটি লেভেল। প্রথম লেভেল চলে দুই মাস। এতে সার্কিট ও প্রোগ্রামিং নিয়ে কাজ করে শিশুরা। এর পরের চার মাস চলে দ্বিতীয় লেভেল। তাতে গেম ও অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কাজ করা হয়। আর শেষ ছয় মাসে বাস্তব জীবনের কোনো সমস্যার সমাধান সম্পর্কে নিজেদের ভাবনা নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করে শিশুরা। এ থেকেই তৈরি হয় গেম, রোবট প্রভৃতি।
এক বছর শেষ হওয়ার পর এসব শিশুকে শিক্ষানবিশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শিক্ষানবিশদের জন্য আছে টেক ল্যাবের শিক্ষা এবং গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগে কাজ করার সুযোগ। এরা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কিছু প্রকল্পে যেমন কাজ করে, তেমনি নতুন শিক্ষার্থীদের শেখায় প্রযুক্তির বিভিন্ন দিক। টেক ল্যাবের সাম্প্রতিক গবেষণায় চলছে স্মার্ট ক্লক, স্মার্ট কার, হোম অটোমেশন সিস্টেম, স্পাইডার-বট, ব্লু টুথ নিয়ন্ত্রিত গাড়ি প্রভৃতি তৈরির কাজ।
টেক ল্যাবে ভর্তির সময় ফি দিতে হয় পাঁচ হাজার টাকা। আর প্রতি মাসের টিউশন ফি দুই হাজার টাকা। তবে প্রযুক্তির বিভিন্ন প্রকল্পের যন্ত্রপাতির জন্য বা ল্যাব ব্যবহারের জন্য কোনো ফি দিতে হয় না। এগুলো প্রতিষ্ঠানই সরবরাহ করে। ক্লাস হয় শুক্র ও শনিবার।
পরিশেষে
শেষ করছি টেক ল্যাবের এখনকার একটি প্রকল্পের কথা জানিয়ে। প্রতিষ্ঠানটির শিশু প্রযুক্তিবিদেরা মানুষের মস্তিষ্কের তরঙ্গ চিহ্নিত করতে পারে, এমন একটি বিশেষ যন্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে। এটি ব্যবহার করে মানুষের মস্তিষ্কের বিভিন্ন তরঙ্গের রেখাচিত্র আঁকা যাবে কম্পিউটারে! সাই-ফাই চলচ্চিত্রের কল্যাণে এসব যন্ত্রের ব্যবহার তো কতই দেখা গেছে। এবার এ দেশের খুদে প্রযুক্তিবিদদের তা করে দেখানোর পালা।