প্রযুক্তি যেভাবে স্মৃতিশক্তি নষ্ট করছে
মোস্তাফিজুর রহমান : একবার ভাবুন তো, সর্বশেষ কবে আপনি কারো ফোন নাম্বার মুখস্থ করেছেন? সম্ভবত সেটা ২০০১ সালের আগে! এবার ভাবুন তো, সর্বশেষ কবে কোন ডিনার পার্টি বা বন্ধুদের আড্ডার দাওয়াত পেয়েছেন ফেসবুকে? সম্ভবত গত সপ্তাহে!
এভাবেই প্রযুক্তি পাল্টে দিয়েছে আমাদের দৈনন্দিন জীবন, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, এমন কি আামদের সৃজনশীলতা, আমাদের মনোযোগের বিষয়গুলোও। গবেষকরা বলছেন, এই প্রযুক্তি আসক্তির একটা গভীর প্রভাব পড়ছে আমাদের স্মৃতিশক্তি, তথা মস্তিষ্কের উপর। আমাদের মস্তিষ্কের সামগ্রিক ক্রিয়াকলাপের উপর এর প্রভাব পড়ছে ব্যপক ভাবে। ফলে কারো বুদ্ধিমত্তা নিরুপন করা কঠিন হয়ে পড়ছে। আর বুদ্ধিমত্তার বিশৃঙ্খলতা, কর্মক্ষম মস্তিষ্কের তথ্য আদান প্রদান, চেতনার উদ্বেগ, দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতি রক্ষা, মনের অনুভূতি প্রক্রিয়া বিশৃঙ্খল করে দেয়।
প্রযুক্তি বিষয়ক লেখক নিকোলাস কার মনে করেন, যখন কোন ঘটনা বা অভিজ্ঞতা আমার স্মৃতিতে দীর্ঘস্থায়িভাবে ধারণ করি, তখন সে বিষয়ে জটিল ধারণাগুলোর বুনন আমরা ধরতে পারি যা আামদের চিন্তাকে শানিত করে। যদিও আামদের মস্তিষ্কের স্মৃতি ভান্ডারের সীমাহীন ক্ষতদা আছে। তবে হালকা ভাবে গ্রহন করা তথ্যের ক্ষেত্রে এর ক্ষমতা খুবই দুর্বল! আমাদের মনোযোগের সামান্য বিরতি মস্তিষ্ক তার ভাবনারত বিষয়বস্তু হঠাৎ হারিয়ে ফেলে।
এদিকে নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের ক্রমবর্ধমান সর্বব্যাপি স্মার্টফোন সংস্কৃতিতে কেবল ছবি তোলা বিষয়েই, আমরা প্রায় ভুলে যায় কোন ছবিটি কোথায় তোলা।
আপনারও কি এমন হচ্ছে? আপনি কি অকাল স্মৃতিভ্রমের কারনে উদ্বিগ্ন? তাহলে জেনে নিন প্রযুক্তি কিভাবে আপানর মস্তিষ্কের স্মৃতিকে প্রভাবিত করছে তার পাঁচটি কারন:
অধিক তথ্য, তথ্য ধারণ ক্ষমতা নষ্ট করে :
সুইডেন কে টি এইচ রয়েল ইনস্টিটিউট এর কম্পিউটার প্রকৌশলের অধ্যাপক এরিক ফ্রান্সিন মনে করেন, ইদানিং সল্প সময় ইন্টারনেট ব্যবহারও মস্তিষ্কে তথ্য ধারণ করায় পক্ষে কঠিন বাধা হয়ে দাড়াচ্ছে। এদিকে উৎপাদন বিশেষজ্ঞ ও লেখক টনি শোয়ার্জ এর মতে, আমাদের বেশির ভাগই অতিরিক্ত তথ্যের চাপে প্রতিনিয়ত বোমার আঘাতের মত জরজরিত হচ্ছে।
যখন একটা কর্মক্ষম মস্তিষ্ক ডিজিটাল ওভারলোড মোকাবেলা করে, তখন তা অনেকটা পানি পূর্ণ গ্লাসের মত কাজ করে। একটা গ্লাসে ক্রমাগত পানি ঢালতে থাকলে, এক সময় তা পূর্ণ হয়ে উপচে পড়তে শুরু করে। ঠিক তেমনি আমরা প্রতিনিয়ত অসংখ্য তথ্য আমাদের মস্তিষ্কে ঢুকাচ্ছি এবং তা এত দ্রুত হচ্ছে যে মস্তিষ্ক তার ধারণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। এবং পানি উপচে পড়ার মত এক সময় অতিরিক্ত তথ্য হারিয়ে যাচ্ছে।
ইন্টারনেট মস্তিষ্কের বিকল্প স্মৃতি ভান্ডার :
এক গবেষণা বলছে, যখনই আমরা কোন ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করতে শুরু করি, তখনি মনে হয়, আমরা ক্রমশ আমাদের স্বরণ রাখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছি। সম্প্রতি এক আমেরিকান নিবন্ধে দাবি করা হয়, স্বরণ রাখা বা মুখস্ত করা ক্রমশ ডিজিটাল যন্ত্রের হাতে চলে যাচ্ছে।
ঐতিহাসিক ভাবে মুখস্ত করা বহু পুরনো সামাজিক পদ্ধতি। আমরা কোন কিছু মনে রাখি, তা অন্যের সাথে শেয়ার করি, এভাবেই সমসাময়িক তথ্য ঘাটতি পুরণ করি। কিন্তু বর্তমানে সে কাজটি ইন্টানেটের হাতে চলে গেছে। ফলে মস্তিষ্ক ধারণ ক্ষমতা হারাচ্ছে।
চিত্ত উন্মত্ততা স্মৃতি রক্ষার পরিপন্থি :
মনোযোগ হচ্ছে কোন কিছু আত্মস্থ করার প্রধান চাবিকাঠি। গত রাতে আপনি কোনো মুভি সমন্ধে ফেসবুকে লিখেছেন, বা টুইটারে টুইট করেছেন! কিন্তু কয়েক দিন পর সে সম্পর্কে আপনার কোন বন্ধু জানতে চাইলে আপনি খুব বেশি বিস্তারিত বলতে পারবেন না। কারণ আপনি তা হালকা ভাবে নিয়েছেন।
কোন কিছু ভুলে যাওয়াই প্রমান করে আপনি কতটা ব্যস্ত! গভীর ভাবে মনোযোগ না দেওয়ার ফলে তথ্যগুলো মস্তিষ্কে শক্তপোক্তভাবে বদ্ধমুল হয় না। আর তাই পরে তথ্যগুলো খুজেতে মস্তিষ্কের বেগ পেতে হয়। গত বছর এমআইটি-র গবেষকেরা মস্তিষ্কে একটি নিউরাল সার্কিট চিহ্নিত করেন যা মস্তিষ্কে স্মৃতি দীর্ঘস্থায়ী করতে সহায়তো করে এবং সে সার্কিটটি খুবই কার্যকর ভাবে কাজ করে যখন কেউ গভীর মনোযোগের সাথে কিছু দেখে।
তথ্যআধিক্য জ্ঞনকে ছোট করে ফেলে :
হার্ভার্ড পদার্থবিদ অধ্যাপক জন এডওয়ার্ড হোত নিউইয়র্ক টাইমসে এক নিবন্ধে লেখেন, আমরা যতটুকু বুঝতে পারি তার চেয় ইন্টারনেট আামদের ইন্দ্রিয়ের উপর অনেক বেশি প্রভাব ফেলে। তিনি আরও উল্লেখ করেন, ইন্টারনেটের উপর অধিক নির্ভরতা কোন বিয়য়ে সম্পুর্ণ জ্ঞান অর্জনের চেয়ে টুকরো টুকরো তথ্য জানতে বেশি উৎসাহিত করে। দুঃখজনক হল, কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা না করে আমরা শিক্ষা, জ্ঞান বা তথ্যকে পরমানুর মত টুকরো টুকরো করে ফেলি এবং তখনই ঐ সুনির্দিষ্ট জ্ঞান, শিক্ষা বা তথ্য তার স্বকীয়তা হারায়।
স্মৃতি ভান্ডারের অধঃপতন :
অত্যাধিক প্রযুক্তি আসক্তি তথা ইন্টারনেটে আসক্তির কারনে, আমাদের তরুণ তরুনীরা তাদের সময়ের সবচেয়ে বড় অংশ ব্যায় করে অনলাইনে ‘ডাটা সেন্ড এবং রিসিভ’ করে। যার বেশির ভাগই খুব বেশি দরকারি নয়। আমেরিকার জাতীয় পরিসংখ্যান বলছে, ৫৫ উর্ধ ব্যাক্তিদের তুলনায়, ১৮ থেকে ৩৪ বছর বয়সি তরুন তরুনীরা সংখ্যায় বেশি, যারা প্রত্যাহিক দিনের নাম মনে করতে পারে না। তরুণদের মধ্যে এমন কি অনেকে স্বাভাবিক সাবলিল কথা বার্তা বলতেও ভুলে যায়।
সুতরাং সাবধান। ইন্টারনেটকে আপনি আসক্ত করে রাখবেন, ইন্টারনেট যেন আপনাকে আসক্ত করে না ফেলে। ইন্টরনেট আসক্তি থেকে নিজেকে রক্ষা করুন। নিজেকে সুস্থ স্বাভাবিক রাখুন।
হাফিংটোন পোষ্ট এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা অবলম্বনে রচনা: মোস্তাফিজুর রহমান
মডেল: সোহেল, জিতু, বিপ্লব, আল-আমিন, পৃথা
ফটোগ্রাফি: এস এম রাসেল