পিস্তল পিটের ক্লে কথন: ক্রিপ্টোনাইটের রঙ যখন লাল!

পিস্তল পিটের ক্লে কথন: ক্রিপ্টোনাইটের রঙ যখন লাল!

  • মেহেরাবুল হক রাফি

সুপারম্যান!

শৈশবকালে টিভির পর্দায় কিংবা কমিক্সের পাতায় সুপারম্যানের নাম শোনেননি এমন লোক হয়তো খুব কমই আছেন। ক্রিপ্টন গ্রহের কাল-এল নীলাভ পৃথিবীতে এসে পরিচিত হয়েছেন ক্লার্ক কেন্ট নামে। আপাতদৃষ্টিতে দুনিয়ার সবকিছুর সামনে সুপারম্যানকে অপ্রতিরোধ্য মনে হলেও অন্য সব সুপারহিরোর মতন তারও দুর্বলতার জায়গা রয়েছে। আর সেই দুর্বলতার নাম ক্রিপ্টোনাইট।

বিগ থ্রি’র আবির্ভাবের পূর্বে ১৪ বারের গ্র্যান্ড স্ল্যামজয়ী পিট সাম্প্রাসকে টেনিসের সুপারম্যান বললেও অত্যুক্তি করা হবে না। এমনকি ফেদেরার ও জোকোভিচ পূর্ববর্তী-যুগের সেরা গ্রাস-কোর্টার ও হার্ড-কোর্টার হিসেবে বিবেচনা করা হয় সাম্প্রাসকে। সেই সময়ে কার্পেট কোর্টেও সমানভাবে দাপট দেখিয়ে গিয়েছেন এই আমেরিকান। কিন্তু সব গোলমালটা বাঁধলো ক্লে কোর্টে।

ক্যারিয়ারে ৬৪ টা টাইটেল জেতা সাম্প্রাস লাল মাটিতে জিতেছেন সর্বসাকুল্যে মাত্র ৩ টি টাইটেল; যার মধ্যে ১ টি মাস্টার্স। আর ফ্রেঞ্চ ওপেনে সর্বোচ্চ দৌড় ‘৯৬ সালের সেমিফাইনাল। এর মধ্যে তিনটা কোয়ার্টার ফাইনাল বাদ দিলে বাকি সব ফ্রেঞ্চ ওপেনে তৃতীয়/দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই বিদায় নিতে হয়েছে তাঁকে। বাকি তিন সার্ফেসের সুপারম্যান সাম্প্রাসের কাছে ক্লে কোর্ট কিভাবে ক্রিপ্টোনাইটে পরিণত হলো তার পেছনের কারণগুলোই চলুন আজকে খোঁজা যাক।

টেনিস ইতিহাসের সবচাইতে নিখুঁত কয়েকজন সার্ভ এন্ড ভলি টেকনিক সমৃদ্ধ খেলোয়াড়দের তালিকা করা হলে সেখানে একদম উপরের দিকেই সাম্প্রাসের নাম থাকবে। নব্বইয়ের দশকের গ্রাস এবং হার্ড কোর্টের পেইসের সাথে সাম্প্রাসের প্লেয়িং স্টাইল ছিলো যেনো ম্যাচ মেইড ইন হেভেন। এমনি এমনিই তো আর ট্যুরের সকলের কাছে পিস্তল পিট উপাধি পাননি! সেই সময় গ্রাসে সাম্প্রাস অধিকাংশ ম্যাচই জিতে নিতেন সার্ভ এবং অতি দ্রুত গতিতে নেটের কাছে এসে পয়েন্ট শেষ করার মাধ্যমে। হার্ডেও সেইম ট্যাক্টিক্স ফলো করে সাফল্য পেয়ে আসছিলেন। কিন্তু বিপত্তির শুরু লাল মাটিতে।

বাকি অন্যসব কোর্টের চাইতে স্বাভাবিকভাবেই ক্লে অনেক স্লো সার্ফেস। এছাড়া ক্লে’তে বলের বাউন্স অনেক বেশি হওয়ায় গ্রাস/হার্ডের মতন শর্ট র‍্যালি এখানে খেলা প্রায় অসম্ভব। থ্যালাসেমিয়াতে আক্রান্ত সাম্প্রাসের পক্ষে বেসলাইন থেকে টানা লংগার র‍্যালি খেলা দুরূহ ব্যাপার ছিলো৷ এছাড়া ক্লে’তে তার ফুটওয়ার্ক এবং বডি মুভমেন্টও সমসাময়িক অন্যান্য ক্লে-কোর্টারদের চাইতে অনেকাংশে পিছিয়ে ছিলো। ক্লে’র ফোরহ্যান্ড কিংবা গ্রাউন্ডস্ট্রোকের জন্য টপস্পিন অপরিহার্য অস্ত্র। কিন্তু পিটের এই দিকটাতেও অন্য ক্লে-স্পেশালিস্টদের চাইতে বেশ ভালো রকমের ঘাটতি ছিলো। তখনকার কার্লোস ময়া কিংবা গুস্তাভো কুয়ের্তেনের খেলার সাথে ক্লে’তে সাম্প্রাসের খেলার তুলনা করলেই ব্যাপারগুলা আরো পরিষ্কার হয়ে ধরা দেয়। নিজ দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্লে-কোর্টের অপ্রতুলতাও তাঁর ব্যর্থতার অন্যতম কারণ। এজন্য ক্লে-স্পেশালিস্টদের লিস্টের দিকে তাকালে দেখা যাবে সেখানে ইউরোপিয়ানদের আধিপত্যই বেশি।

ক্লে সার্ফেসে স্লাইডিং করা অন্যান্য সার্ফেসের চাইতে অনেক সহজ হলেও তা করতেও প্রচন্ড অনীহা ছিলো সাম্প্রাসের৷ ফলে লংগার র‍্যালিতে প্রায়শই ডিফেন্ড করতে বেগ পেতে হতো তাঁকে। এছাড়া ক্লে সিজনের ক্যালেন্ডারেরও বড় ভূমিকা ছিলো সাম্প্রাসের এই দৈন দশার পেছনে। ১৯৯৬ সালের ফ্রেঞ্চ ওপেনে নিজের সবটুকু উজাড় করে দেওয়ার পরও সেমি থেকে বাদ পড়তে হয়। ফলশ্রুতিতে ফ্রেঞ্চ ওপেনের মাত্র দুই সপ্তাহ পর শুরু হওয়া উইম্বলডনের কোয়ার্টার থেকেই বিদায় নিতে হয় ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন সাম্প্রাসকে। এরপর থেকে গ্রাস সিজনকে গুরুত্ব দিয়ে নিজের ক্যালেন্ডার সাজাতে শুরু করেন তিনি। এর ফলে ‘৯৬ এর পর আর একবারো ফ্রেঞ্চ ওপেনের শেষ আটে উঠতে পারেননি সাম্প্রাস।

নিজের প্রিয় ট্রফি হাতে সাম্প্রাস!

বর্তমানে বিগ থ্রি’র বদৌলতে ক্যারিয়ার স্ল্যামকে খুব সহজ বিষয় মনে হলেও বিশ-ত্রিশ বছর আগের চিত্র ছিলো একেবারেই ভিন্ন। সাম্প্রাসের সমসাময়িক একমাত্র আগাসিই ক্যারিয়ার স্ল্যাম জিততে পেরেছিলো; যদিও ওভারল স্ল্যাম কাউন্টের দিক থেকে আগাসি অনেক পিছিয়ে থাকবে।

অবসরের পর বিভিন্ন ইন্টার্ভিউতে ক্লে’তে নিজের দুরবস্থা নিয়ে বেশ কয়েকবার পিস্তল পিটকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো। উত্তরে বলেছিলেন যে, নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে তাঁর আর কোনো আফসোস নেই। টেনিস-ঈশ্বর তাঁকে দু’হাত উজাড় করে দিয়েছে। এমন সৌভাগ্যই বা কয়জনের হয়?

প্রতিবেদক- শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগ,  ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

Sharing is caring!

Leave a Comment