সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স কি ৩৫ করা উচিৎ

সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স কি ৩৫ করা উচিৎ

  • নিউজ ডেস্ক

বাংলাদেশে সরকারি চাকরি শুরুর করার বয়স-সীমা বাড়ানোর দাবিতে গত ছ’বছর ধরে আন্দোলন করে আসছে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র পরিষদ নামের একটি সংগঠন। তাদের দাবি বর্তমানে বেঁধে দেওয়া বয়স ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৩৫ করতে হবে। তাদের এই আন্দোলনের কারণে সম্প্রতি এই বয়স-সীমা নিয়ে প্রচুর কথাবার্তাও হচ্ছে।

কেউ কেউ এই সীমা না বাড়ানোর পক্ষে। আবার কেউ কেউ শুধু বাড়ানোই হয়, তারা এই সীমা তুলে দেওয়ারই কথা বলছেন।

চাকরির বয়স ৩৫ বছর করার জন্যে তাদের যে দাবী তার পেছনে যুক্তি কী- জানতে চাইলে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র পরিষদের আহবায়ক সঞ্জয় দাস বলেন, “আমরা বিশ্বের ১০৭টি দেশে চাকরির বয়সের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে দেখেছি। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপসহ এসব দেশে চাকরির বয়স হচ্ছে ৩৫ থেকে ৫৯ পর্যন্ত। ভারতেরও বিভিন্ন রাজ্যে চাকরির বয়স সীমা ৩৫ থেকে ৪৫।”

বাংলাদেশে কেন ৩৫?

“যেহেতু এসব দেশে চাকরিতে ঢোকার জন্যে সর্বনিম্ন বয়স ৩৫ তাই আমরা বাংলাদেশেও এই বয়স-সীমা নির্ধারণের দাবি জানাচ্ছি।”

মি. দাসের কথা হলো যোগ্যতা প্রমাণ করতে বয়স কোন বাধা হতে পারে না। তিনি বলেন, “আসলে চাকরির জন্যে কোন বয়স-সীমাই রাখা উচিত নয়।”

বয়সের জন্যে কোন সীমা বেঁধে দেওয়া না হলে তো সরকারি চাকরিতে অল্প কিছু পদের জন্যে হাজার হাজার চাকরি-প্রার্থী আবেদন করতে পারেন, তখন?

এই প্রশ্নের জবাবে সঞ্জয় দাস বলেন, সেজন্যে সরকার একটা নীতিমালা তৈরি করতে পারে। একেক শ্রেণির চাকরির জন্যে একেকটা বয়স-সীমা বেঁধে দেওয়া যেতে পারে। যেমন প্রথম শ্রেণির জন্যে ৩৫, দ্বিতীয় শ্রেণির জন্যে ৪০, তৃতীয় শ্রেণির জন্যে ৪৫ এরকম।”

‘চাই তারুণ্য’

কিন্তু সরকারি চাকরি শুরু করার বয়স বাড়ানোর দাবির সাথে একমত নন সরকারের সাবেক একজন শীর্ষস্থানীয় আমলা আলী ইমাম মজুমদার। মন্ত্রীপরিষদের সচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।

মি. মজুমদার বিবিসি বাংলাকে বলেন, “নতুনদেরকে তো জায়গা করে দিতে হবে। সরকারি কাজে তারুণ্যকে কাজে লাগাতে হবে। চাকরিতে প্রবেশের বয়স যদি ৩৫ করা হয় তাহলে তরুণদের মেধাকে কাজে লাগানো যাবে না। তরুণরা যে অনেক দক্ষতার সাথে কাজ করতে পারে সেটা কি কেউ অস্বীকার করতে পারবেন?”

“দুঃখজনকভাবে সরকারি চাকরির জন্যে কেউ আবেদন করার পর লিখিত পরীক্ষা, মৌখিক পরীক্ষা, পুলিশ ভেরিফিকেশন ইত্যাদি আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে চাকরি হতে হতে ৩/৪ বছর কেটে যায়। এখন যদি বয়স ৩৫ করা হয় তাহলে তো চাকরি শুরু করতে করতে তার বয়স ৪০ এর কাছাকাছি হয়ে যাবে,” বলেন তিনি।

তিনি বলেন, “তাদের বয়স যতো কম হবে তারা ততো বেশি রিসিভ করতে পারবে, দেশ ও দেশের মানুষকে দিতে পারবে।”

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পর সরকারি চাকরিতে যোগ দেন মি. মজুমদার। তিনি জানান, “পাকিস্তান আমলে চাকরি শুরুর বয়স ছিল ২৫ বছর। নতুন দেশে সরকারি চাকরি করার জন্যে দক্ষ লোক পাওয়া যাবে না বলে সেটা বাড়িয়ে ২৭ করা হয়েছিল। পরে ১৯৯১ সালে সেটাও তো বাড়িয়ে ৩০ করা হয়েছে। এখন তো সেশন জটও নেই। তারপরেও এই বয়স-সীমা বাড়ানোর পেছনে তো আমি কোন যুক্তি দেখি না।”

সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্যে বর্তমানে চাকরি শুরু করার বয়স ৩০ হলেও মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবন্ধী, উপজাতি কোটায় এই বয়স ৩২, নার্সের চাকরির জন্যে ৩৬ আর বিভাগীয় প্রার্থীর কোটায় ৩৫ বছর।

অন্যদিকে চাকরিতে প্রবেশের বয়স-সীমা বাড়ানোর যুক্তি হিসেবে সঞ্জয় দাস বলেছেন, বাংলাদেশের বাস্তবতা ও শিক্ষা ব্যবস্থার কথাও বিবেচনা করতে হবে।

পড়া শেষ করতে করতে…

তিনি বলেন, “পড়াশোনা শেষ করতে করতেই তো অনেক বয়স হয়ে যায়। তখন আর চাকরি খোঁজার জন্যে পর্যাপ্ত সময় থাকে না।”

তার একটি হিসেবও দিয়েছেন তিনি। হিসেবটা এরকম:

“আগে ছেলেমেয়েরা যে কোন সময়ে লেখাপড়া শুরু করতে পারতো। তখন জন্ম নিবন্ধনের কোন বিষয় ছিল না। কিন্তু এখন জন্ম নিবন্ধন সার্টিফিকেটে কমপক্ষে ৬ বছর দেখিয়ে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হতে হয়।”

ছয় বছর বয়সে কোন শিক্ষার্থী প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হলে স্কুল শেষ করতে করতে তার বয়স হবে ১৬ বছর। কলেজ শেষ করবে ১৮ বছর বয়সে। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করতে যদি আরও চার থেকে পাঁচ বছর সময় লাগে তাহলেও তার বয়স দাঁড়াবে ২৩ বছর। তাহলে চাকরি খুঁজতে কি আরো সাত বছরের বেশি সময় লাগবে?

এই প্রশ্নের জবাবে মি. দাস বলেন, “সেশনজটও একটি বড় ইস্যু। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের প্রকাশিত তথ্য থেকে আমরা দেখেছি সারা দেশে যতো শিক্ষার্থী অনার্স কিম্বা মাস্টার্স করে থাকেন তার ৮০ শতাংশই করেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আমরা গত সাত বছরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর গবেষণা করে দেখেছি সেখানে সেশনজট আছে তিন বছরের মতো। এটাও তো হিসেবে নেওয়া দরকার।”

এছাড়াও তার মতে আরো একটি কারণ হচ্ছে- চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার বয়স বৃদ্ধি। ২০১১ সালে সরকারি চাকরিতে সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবসরের বয়স দুই বছর বাড়িয়ে ৫৯ বছর করা হয়। আর মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্যে করা হয় ৬০ বছর।

সঞ্জয় দাসের প্রশ্ন:”তাহলে চাকরি শুরু করার বয়স বাড়ানো হবে না কেন? এছাড়াও মানুষের গড় আয়ুও তো বৃদ্ধি পেয়েছে।”

পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোতে সরকারি চাকরির জন্যে তো কোন বয়স-সীমা বেঁধে দেওয়া হয়নি, বাংলাদেশে এর প্রয়োজন কেন? – এই প্রশ্নের জবাবে সাবেক আমলা আলী ইমাম মজুমদার বলেন, “ওসব দেশে তো সরকারি চাকরি আকর্ষণীয় কোন চাকরি নয়। বহু দেশেই সরকারি চাকরি করার জন্যে যথেষ্ট সংখ্যায় দক্ষ লোক খুঁজে পাওয়া যায় না। বাংলাদেশের বাস্তবতা তো আলাদা।”

তিনি বলেন, প্রয়োজনে রাষ্ট্রপতি চাইলে তো যে কোন বয়সের যোগ্য ব্যক্তিকে সচিবসহ যেকোনো পদে নিয়োগ দিতে পারেন। এই সংখ্যা ১০ শতাংশ।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলন

চাকরি শুরুর করার বয়স সীমা বাড়ানোর দাবিতে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র পরিষদ সারা দেশে মানব বন্ধন, সেমিনার, সভা সমাবেশের আয়োজন করে আসছে। পালন করেছে অনশন কর্মসূচিও। ফেসবুকে তাদের পেজের অনুসারীর সংখ্যা পাঁচ লাখেরও বেশি।

সঞ্জয় দাস বলছেন, “সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তার সাথেও তাদের এবিষয়ে কথা হয়েছে। তিনি দাবি করেছেন, তারাও তাদের দাবির সাথে একমত হয়ে চাকরির বয়স-সীমা বাড়ানোর ব্যাপারে তাদেরকে আশ্বস্ত করেছেন।

আন্দোলনকারীরা বলছেন, বর্তমানে তারা প্রেসিডেন্টের সাথে সাক্ষাৎ করে তাদের দাবী তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। ব্যর্থ হলে তারা তাদের আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করবেন।

নেতার অভিজ্ঞতা

এই আন্দোলনের নেতা সঞ্জয় দাস নিজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছেন ২০১৪ সালে। তখন থেকেই সরকারি চাকরির জন্যে চেষ্টা করে আসছিলেন তিনি। ১০ থেকে ১২টি মৌখিক পরীক্ষাতেও অংশ নিয়েছেন। কিন্তু সফল হননি এবং চাকরি খুঁজতে খুঁজতে তার বয়স এখন ৩৩ ছাড়িয়ে গেছে। ফলে সরকারি চাকরির আর কোন সুযোগও নেই তার সামনে।

শুধু সরকারি চাকরিই করতে হবে কেন- এই প্রশ্নের জবাবে মি. দাস বলেন যে বেসরকারি চাকরির জন্যেও তিনি চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। এখন টিউশনিসহ নানা কাজ করে তার জীবন চালাতে হয়।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

Sharing is caring!

Leave a Comment