চাকরিটা যখন নতুন
- রবিউল কমল
চাকরি মানেই সোনার হরিণ। চাকরি পাওয়া বর্তমান সময়ের সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর একটি। আর আপনি নিশ্চয় চাইবেন না, অনেক পরিশ্রম করে পাওয়া চাকরিটির প্রথম দিনেই আপনার সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা জন্মে যাক সবার মনে। প্রথম দিনেই যদি কারো মনে আপনার সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা জন্মে যায় তবে পরবর্তীতে যতই চেষ্টা করুন না কেন সেটা পরিবর্তন করা কঠিন হয়ে পড়ে। ইংরেজিতে একটা কথা YOU NEVER GET A SECOND CHANCE TO MAKE A FIRST IMPRESSION তাই কর্মক্ষেত্রের প্রথম দিকের দিনগুলোতে কিছু বিষয় আপনাকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে। পাশাপাশি বাদ দিতে হবে অনেক পুরাতন অভ্যাস।
সঠিক সময়ে অফিসে যান
চাকরির প্রথম দিনই যদি আপনি ১৫ মিনিট দেরি করে অফিসে পৌঁছান তবে এরপর থেকে সবার প্রথমে আসলেও আপনার সম্পর্কে কারো ধারণা বদলানো যাবে না। তাই সময়ের দিকে লক্ষ্য রাখুন, যথাসময়ে অফিসে পৌঁছান। যেদিন আপনাকে কাজে যোগদান করতে হবে তার আগেই অফিসের রাস্তা, যাওয়ার সময় কি পরিমাণ ট্রাফিক রাস্তায় থাকে, কোন ধরনের পরিবহনে আপনি অফিসে যাবেন তার সম্পর্কে সঠিক ধারণা নিয়ে নিন। সম্ভব হলে কাজে যোগদান করার কয়েকদিন আগে থেকেই নির্ধারিত সময়ে কর্মস্থলের সামনে থেকে ঘুরে আসুন।
মার্জিত পোশাক পরুন
যদি কর্মক্ষেত্রের নির্ধারিত কোনো পোশাক থাকে তবে তা পরুন আর যদি না থাকে তাহলে যতটুকু সম্ভব শালীন এবং দৃষ্টিনন্দন পোশাক পড়ে যান। কারণ কেউ আপনার সাথে কথা বলার আগেই তাকাবে আপনি কেমন পোশাক পরেছেন তার দিকে। যদি বুঝতে না পারেন কী ধরনের পোশাক পড়া উচিত সে ক্ষেত্রে আপনার প্রতিষ্ঠানের হিউম্যান রিসোর্স রিপ্রেজেন্টেটিভের সাথে যোগাযোগ করে জেনে নিন।
আত্মবিশ্বাসী হোন
অফিসের প্রথম দিন খুব স্বাভাবিকভাবেই অনেকে নার্ভাস হয়ে পড়েন। দেখা যায় আপনি খুব ভালো জানেন এমন অনেক কাজেও ভুল হয়ে যাচ্ছে। তাই আত্মবিশ্বাসী হওয়াটা খুব জরুরি। যে কাজটি আপনাকে দেওয়া হয়েছে বা যেসব কথা আপনি বলছেন তা সাহসের সাথে বলুন। আপনার নতুন সহকর্মীরা আপনাকে সাহায্য করবে।
নোট রাখুন
প্রথম দিন আপনাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো সহকর্মীদের সাথে। বাসায় এসেই সবার নাম ভুলে গেলেন। পরদিন এ নিয়ে আপনাকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হতে পারে। তাই লিখে রাখতে পারেন সবার নামগুলো। আপনাকে যেসব কাজ দেওয়া হচ্ছে সেগুলোও নোট করে রাখতে পারেন। তাতে সবচেয়ে জটিল কাজগুলো চিহ্নিত করা সহজ হবে এবং কোনো কাজ ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না।
প্রশ্ন করুন
আপনি নতুন, অবশ্যই এমন অনেক কাজ আপনাকে দেওয়া হবে যার সম্বন্ধে আপনার স্বচ্ছ ধারণা নেই। তাই আপনার সহকর্মী বা ঊর্ধ্বতন যিনি আছেন তার কাছে জিজ্ঞেস করে জেনে নিন। কারণ একবার ভুল কাজ করার চেয়ে কয়েকবার জেনে নিয়ে সঠিক কাজটি করা উচিত। আপনাকে কি বলা হচ্ছে তা মন দিয়ে শুনুন। সিনিয়র বা জুনিয়র যে কথাই বলুক না কেন তা মন দিয়ে শুনুন এবং বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করুন। কারণ তাদের কথায় এমন অনেক কিছুই লুকিয়ে থাকতে পারে যা আপনাকে পরবর্তীতে নিজের অবস্থান দৃঢ় করতে সাহায্য করবে।
প্রথম চাকরিতে যা এড়িয়ে চলবেন
প্রথম সবকিছুর একটা আলাদা গুরুত্ব আছে। প্রথম চাকরিও এগুলোর ব্যতিক্রম নয়। তবে, যেহেতু প্রথম চাকরির ব্যাপারটা ক্যারিয়ার, অর্থাৎ রুটি-রুজির সঙ্গে জড়িত, তাই এই ক্ষেত্রে একটু সিরিয়াস না হলে মুশকিল। তাই প্রথমবার চাকরি পেয়ে যেমন সেলিব্রেট করতে হবে, তেমনই কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখতেই হবে মন্দার বাজারে একটা চাকরি জুটিয়ে ফেলেছেন। হঠাৎ করেই পাড়ার আড্ডা আর সন্ধের টিউশনির রুটিনটায় আমূল বদল। মাসের শেষে একটা নির্দিষ্ট মাইনের হাতছানি। উৎসবে ছুটি আর বোনাস। ব্যক্তিগত ইমেলের পাশাপাশি কর্পোরেট ইমেল আইডি। সঙ্গে আবার বিজনেস কার্ডও। প্রথম চাকরিটা পাওয়ার পর মনে হয়, সবকিছুই যেন বদলে গেল। হাতের মুঠোয় যেন গোটা বিশ্ব। তাই চাকরি পাওয়ার পর পার্টি আর সেলিব্রেশনে দাড়ি দিতে ইচ্ছেই করে না। কিন্তু সাধু সাবধান। প্রথম চাকরি মানে, আপনার ক্যারিয়ারের চৌকাঠ। বাধা বেতন যেমন পাচ্ছেন, তেমন আপনার জীবনে কিছু বাধা রেসপন্সিবিলিটিও এসে জুটল। চাকরি শুরু মানে দুম করে বন্ধুদের সঙ্গে ঝোলা কাঁধে রোমাঞ্চ করতে বেরিয়ে পড়তে পারবেন না। চাকরি মানে আগের দিন রাতভর খেলা দেখে দুপুর দুটোয় ঘুম থেকে উঠতে পারবেন না। চাকরি মানে ফেসবুক বা ট্যুইটারে এক্কেবারে যা-খুশি তাই লিখতেও পারবেন না। বেকার জীবনের বেপরোয়া লাইফস্টাইলে কিঞ্চিত লাগাম পরিয়ে আপনাকে পা-রাখতে হবে কর্পোরেট জগতে। একসময় প্রথম প্রেমের মোহ কাটিয়ে যেমন গার্লফ্রেন্ড বা বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ঝগড়া শুরু হয়ে যায়, তেমনই প্রথম চাকরিতেও ক্রমে আবিষ্কার করতে হয় নানা বঞ্চনা, নানা বেঠিক। তখন মনে হয়, ধ্যাৎ জীবনটা কেমন যেন বদলে গেল। অফিসের লোকগুলো কেন এত খারাপ? বস কেন এমন পক্ষপাতদুষ্ট? আর কেনই বা আমাকে সবার থেকে বেশি খাটতে হয়? এখানে বলে রাখা ভালো, এই সব প্রশ্নের কোনো উত্তর হয় না। উত্তর হলেও, সেগুলো আপনার আমার পছন্দ হওয়ার মতো কোনো কিছু না। প্রথম চাকরিতে অনেক কিছুই অপছন্দ হবে।
বাঘা বস
এতদিন বাড়িতে সময় কাটিয়েছেন। নানা দোষত্রুটি থাকলেও, বাড়ির লোক বা বাবা-মার কাছে পার পেয়ে গেছেন। অফিসে গিয়ে আপনার জীবনে বস নামক ব্যাপারটির অনুপ্রবেশ ঘটবে। আপনি যদি ভেবে থাকেন, এই বস আপনার বাড়ির লোকের মতো, ক্ষমাঘেন্না করে আপনার কমতিগুলো ম্যানেজ করে নেবে, তাহলে বড় ভুল করবেন। এমনটা যে হয় না, তা নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমনটা হয়, কিন্তু সেটা ব্যতিক্রম। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রথম চাকরিতে বসের কাছে লাগাতার বকা খেতে হবে। ডেটলাইনের চাপ আসবে। এটা আমার নতুন চাকরি বা আমাকে স্যার একটু অভ্যস্থ হতে দিন এসব বলে বসের কাছে পার পাবেন না। আর পার যখন পাবেন না, তখন এসব বলবেনও না। একটা জিনিস মাথায় রাখুন, বসও মানুষ। তিনি পারফেক্ট নন। তার জীবনেও নানা রকমের সমস্যা থাকতে পারে। আর সমস্যার কারণে বস যদি জর্জরিত থাকেন, তাহলে সেগুলোর প্রভাব হিসেবে অধস্তনদের ওপর চাপ বাড়তে পারে। তাছাড়া বসের ওপরেও বস থাকে। আপনার ইমিডিয়েট বসকে হয়তো ওপরওলার কাছে নানা কাজের জবাবদিহি করতে হয়। তাই, এটা কখনো আশা করবেন না আপনার বস আপনার ওপর সদয় থাকবেন। সে যতই আপনার এটা প্রথম চাকরি হোক না কেন!
পরিশ্রমের বিকল্প নেই
হয়তো আপনার নতুন চাকরি বলে আপনার সিনিয়ররা বেশি খাঁটিয়ে নিচ্ছেন। আপনি বুঝতেও পারছেন সেটা। কিন্তু আপনার করার কিছু নেই। মুখ বুঝে কাজ করতে-করতে একসময় ভাবছেন এবার দুম করে চাকরিটা ছেড়েই দেবেন কিন্তু না। একটা কথা ভেবে দেখুন, এটা আপনার নতুন চাকরি, প্রথম চাকরি। এখানে যে কাজগুলো আপনি করছেন, সেগুলো আগে করেননি। আপনার প্রত্যেকদিন নতুন-নতুন অভিজ্ঞতা হচ্ছে। নতুন কাজ শিখছেন। যেগুলো শিখছেন, প্রতিদিন সেগুলো প্র্যাকটিস হচ্ছে। আপনার স্কিল বাড়ছে, দক্ষতা অর্জিত হচ্ছে। ক্যারিয়ারে উঠতে হলে, আপনাকে এগুলো করতেই হতো, হয় কিছুদিন আগে, নয়তো কিছুদিন পরে। বেশি পরিশ্রম করে, আগে-ভাগেই যদি কাজের কাজটা সেরে ফেলতে পারেন, আখেরে কিন্তু সুবিধা আপনারই। আর চাকরির ক্ষেত্রে নতুন অবস্থাতেই যদি নিজেকে কাজের মানুষ হিসেবে তুলে ধরতে পারেন, তাহলে অ্যাপ্রেইজাল বা প্রমোশনের সময় মেওয়াটা কিন্তু ফলবে আপনারই জন্য।
ফোন আর ফেসবুক
যতদিন বেকার ছিলেন হাতের মোবাইলটি নিয়ে অনেক খেলা করেছেন। এখন ফোন মানে অ্যান্ড্রয়েড ফোন বা উইন্ডোজ ফোন। হাজার রকম অ্যাপস। সঙ্গে ইন্টারনেট। সর্বক্ষণ হোয়াটস অ্যাপে মেসেজ আসছে বা যাচ্ছে। ফেসবুক বা ট্যুইটারও অন করা থাকে। ফলে বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে সর্বদা কানেকটেড। অফিসে ঢুকে সঙ্গে-সঙ্গে নিজেকে বদলে ফেলা বেশ ঝামেলার। মানুষ তো অভ্যাসের দাস। ফলে বস হয়তো আপনাদের নতুন প্রোজেক্ট বোঝাচ্ছে, অথবা এইচআর এসে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মিটিং করছে, আপনার ইচ্ছে করবে একটা বোর্ডরুম থেকে সেলফি তুলে পোস্ট করে দিই। কিন্তু এসব বিষয়গুলো থেকে বের হয়ে আসতে হবে আপনাকে, তা না হলে কিন্তু ঝামেলায় পড়ে যাবেন আপনি।