বাঙালি কারিগরের বিশ্বের শীর্ষ স্টার্টআপ তৈরির গল্প
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
বিশ্বের সর্ববৃহৎ স্টার্টআপের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশি তরুন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এ উদ্যোগের কার্যক্রম চালাচ্ছেন ঢাকার কর্মীদের নিয়ে। স্বাস্থ্যসেবায় গুগল গ্লাস ব্যবহার করে চমকে দিয়েছেন চিকিৎসকদের। উদ্যোগটির বিস্তারিত জানাচ্ছেন ইমরান হোসেন মিলন।
গুগল গ্লাসের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী রোগী এবং ডাক্তারদের সমন্বয় করে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার উদ্যোগ অগমেডিক্স। দারুণ এ উদ্ভাবন মার্কিন চিকিৎসা সেবায় বলার মতো ভূমিকা রাখছে এখন। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের ইয়ান শাকিল ও সহ-প্রতিষ্ঠাতা পেলু ট্র্যানের স্বপ্নের এ উদ্যোগের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে। তাদের এ উদ্যোগ ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বড় পাঁচটি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রায় ১৭ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ পেয়েছে। এটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ স্টার্টআপ হিসেবেও পুরস্কৃত হয়েছে। স্টার্টআপ হলেও এখন এটি প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলারের প্রতিষ্ঠান।
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। সালটি ২০১২। একজন ইয়ান শাকিল ও তার বন্ধু পেলু ট্র্যান যখন স্বাস্যসেবায় গুগল গ্লাস ব্যবহার করার চিন্তা করছেন তখন মার্কিন মুলুকের চিকিৎসকরা যেন রোবট বনে গেছেন টানা কাজ করতে গিয়ে। হাজার রকম থিসিস, পরীক্ষা, রোগী দেখা সবকিছু তাদের একেবারে আবদ্ধ করে ফেলেছে। জরুরি স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার কাজটিও তাদের কাছে একঘেয়ে হয়ে পড়েছিল। সেই দমবদ্ধ অবস্থা থেকে তারা মুক্তির পথ খুঁজছিলেন। এমনই সময় যেন দেবদূতের মতো গুগল গ্লাস নিয়ে হাজির হন বায়োটেকনোলজির গ্যাজুয়েট শাকিল। মার্কিন চিকিৎসকদের কাছে যা ছিল প্রায় রূপকথার সমতূল্য।
একদিন শাকিল তার বন্ধুর সঙ্গে কাজ করছিলেন গুগল গ্লাস নিয়ে। চোখে গ্লাস পরা থাকা অবস্থায় তিনি দেখলেন এটি ব্যবহার করে চমৎকার কিছু কাজ করা যায়। যেই কথা, সেই কাজ। দুই বন্ধু আরও ভাবতে থাকলেন গুগল গ্লাস ব্যবহার করে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার উপায় নিয়ে। বায়োমেডিক্যালের ক্ষেত্রে এটি সহজ হবে বলে তারা সিদ্ধান্তে আসলেন। এমন ধারণাই থেকে শুরু অগমেডিক্সের। নিবিড়ভাবে কাজে লেগে থাকলেন তরুন এ দুই উদ্যোক্তা। প্রাথমিক ধারণাগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার ডেভলপমেন্ট, কর্মীদের প্রশিক্ষণ সবকিছু পর্যায়ক্রমে শুরু করেন তারা। প্রস্তুতিতেই কেটে যায় বছর দুয়েক।
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক কাজের জায়গা হিসেবে বেছে নিলেন নিজের পিতৃভূমিকে। ২০১৪ সালে অগমেডিক্স পুরোদমে কাজ শুরু করে। এর অপারেশনের পুরোটাই পরিচালিত হয় ঢাকা থেকে বলে জানালেন অগমেডিক্স বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমাদুল হক ববি। আহমাদুল বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ চিকিৎসক তাদের কাজ নিয়ে হতাশায় ভোগেন। এত বেশি ব্যস্ত থাকতে হয় বলে রোগীদের ঠিকভাবে সময়ও দিতে পারেন না। ফলে ওই চিকিৎসক রোগী দেখবেন, নাকি রোগীর ইতিহাস জানবেন সেই ধৈর্য্য থাকে না তার।
শাকিল খেয়াল করলেন এসব চিকিৎসকে গুগল গ্লাস পরিয়ে দিয়ে ডকুমেন্টেশনের কাজটা আরেকজনকে দিয়ে করানো গেলে তারা আগের চেয়ে বেশি রোগী দেখতে পারেন। তাদের কাজটাও সহজ হয়। বাংলাদেশে যেমন রোগীর হিস্ট্ররি লেখার কাজটি করেন তার সহকারীরা। যুক্তরাষ্ট্রে সহকারী রাখার বিষয়টি ব্যয়বহুল হওয়ায় বিকল্প চিন্তা নিয়ে এগোলেন শাকিল। সেই চিন্তা থেকেই শুরু অগমেডিক্সের। সফল এ উদ্যোগ চিকিৎসকদের রোবট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেছে বলে মন্তব্য আহমাদুলের। শাকিল তার চিন্তাকে কাজে রূপ দেওয়ার আগে প্রথমেই সেটি শেয়ার করেন বাংলাদেশে বসবাসকারী তার বাবার সঙ্গে। তিনি কিভাবে কাজ করতে চান সেগুলো জানার পর তারা বাবা এ দেশ থেকে কাজটি পরিচালনার জন্য অনুপ্রাণিত করেন। এরপরই শাকিল ঢাকায় কিছু ছেলে-মেয়েদের নিয়ে অগমেডিক্সের পুরো অ্যাপ্লিকেশন উন্নয়ন করেন। এটির ফ্রন্ট ও ব্যাক এন্ডের কাজও উন্নয়ন করা হয়েছে এদেশে। বর্তমান বিশ্বে অগমেডিক্স স্বাস্থ্যসেবায় গুগল গ্লাস ব্যবহার করে নেওয়া সবচেয়ে বড় স্টার্টআপ উদ্যোগ বলে জানান আহমাদুল।
যেভাবে কাজ করে
অগমেডিক্স কাজ করে গুগল গ্লাসের মাধ্যমে। একজন মার্কিন চিকিৎসক বাংলাদেশে অবস্থানরত এক সহকারীর মাধ্যমে রোগীর ইতিহাস লেখার কাজটি করিয়ে নেন। ওই চিকিৎসক ও এখানে কল সেন্টারে কর্মরত একজন অপারেটর গুগল গ্লাস পড়েন। চিকিৎসকের সঙ্গে রোগী কথা বলেন তখন ডেটা অপারেটর তাদের কথোপকথগুলো শুনে লিপিবদ্ধ করেন। রোগের ইতিহাস লেখার পর চিকিৎসক রোগীকে যেসব গাইডলাইন দেন সেগুলোও তিনি ব্যবস্থাপত্র আকারে লিখে ফেলেন।
এসব তথ্য কল সেন্টারের দায়িত্বরত অপারেটর একটি নির্দিষ্ট ডেটাবেজে ডকুমেন্ট আকারে সেইভ করে রাখেন। ফলে তা যে কোন সময় অগমেডিক্স অ্যাপ্লিকেশনের সাহায্যে রোগী বা চিকিৎসকরা দেখতে পাবেন। মোট কথা, গুগল গ্লাস ব্যবহার করে একজন চিকিৎসক রোগীকে পরামর্শ, ব্যবস্থাপত্র সবই দিতে পারেন অডিওর মাধ্যমে। এটি একটি পদ্ধতির মধ্য দিয়ে ডকুমেন্টেশন আকারেও পাওয়া যায়।
বর্তমান অবস্থা
অগমেডিক্স স্যান ফ্রান্সিসকোভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হলেও পুরো কার্যক্রম পরিচালনা হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে। ভারতেও বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিংয়ের (বিপিও) মাধ্যমেও কিছু করা হচ্ছে। দেশে বেসরকারি খাতে দ্বিতীয় হাইটেক পার্ক হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলা হচ্ছে, যা সরকারের স্বীকৃতিও পেয়েছে।
প্রতিবন্ধকতা
বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বিপিওর মাধ্যমে অগমেডিক্স পরিচালনা করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে ইন্টারনেট কানেকটিভিটির সমস্যায় পড়তে হয়। যেহেতু ২৪/৭ সময় ধরে কাজ করতে হয় এবং চিকিৎসকদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত থাকতে হয়- তাই নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ প্রয়োজন। এর বিকল্প কোনো ব্যবস্থা দেশে নাই।
এ ছাড়া এ খাতে কাজ করার মতো যোগ্য কর্মীর অভাব থাকায় চাহিদা থাকলেও কর্মী নেওয়া যাচ্ছে না বলে জানান আহমাদুল হক।
পরিকল্পনা
অগমেডিক্স সুনির্দিষ্ট কিছু পরিবকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। দেশের চিকিৎসকদেরও উদ্যোগটির সঙ্গে যুক্ত করে বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা অর্জন করাতেও সচেষ্ট এ স্টার্টআপ । দক্ষ কর্মী গড়ে তুলতে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের সঙ্গেও কাজ করছে অগমেডিক্স বাংলাদেশ।
দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি
অগমেডিক্স দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বড় ধরনের কর্মসংস্থান তৈরির লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। উদ্যোগটি আগামী এক বছরে ছয় হাজার দক্ষ কর্মী নিয়োগ দেবে। আহমাদুল বলেন, দক্ষ কর্মী গড়ে তোলা প্রয়োজন, যারা পড়াশোনা ও প্রশিক্ষণ শেষে এ কাজ করার উপযুক্ত হবেন। অগমেডিক্সে কর্মী সরবরাহ করতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অধীনে শুরু হওয়া লিভারেজিং আইসিটি ফর গ্রোথ, এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (এলআইসিটি) প্রকল্পে বিভিন্ন সরকারি-বেসকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে বলে জানান বাংলাদেশের দায়িত্বে থাকা এ উদ্যোক্তা।
যোগাযোগ
১৭/সি, পান্থপথ, ঢাকা-১২০৫।
ওয়েবসাইট : http://www.augmedix.com/