ইলিশে নতুন আশা
- এস এম মুকুল
ইলিশ রক্ষায় বাংলাদেশ এক যুগের প্রচেষ্টার সুফল পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশে ইলিশের আকৃতি বড় হওয়া এমনকি বড় আকৃতির ইলিশের পরিমাণ বেড়েছে। মৎস্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশ বাংলাদেশে ধরা পড়া ১৭ হাজার ইলিশের ওপর গবেষণা চালিয়ে বলছে, বাংলাদেশের সীমানার ভেতরে ধরা পড়া ইলিশের আকৃতি ও ওজন বাড়ছে। ওয়ার্ল্ড ফিশের তিন বছর ধরে চলা গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশে ধরা পড়া ইলিশের আকৃতি ও সংখ্যার এই বদল ২০১৩ সালে গড়ে ৫১০ গ্রাম, ২০১৪ সালে ৫৩৫ গ্রাম, ২০১৫ সালে ৬২৮ গ্রামের অধিকহারে ইলিশ ধরা পড়েছে। এটি আশার খবর বটে- এক কেজি গড় ওজনের ইলিশ মাছ বাংলাদেশে ফিরতে শুরু করেছে। নদী কেন্দ্রের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ২০১২ সালে ধরা পড়া ইলিশ ২০০ গ্রামের চেয়ে কম ২৫ শতাংশ, ২০১৩ সালে ২৩ শতাংশ, ২০১৪ সালে প্রায় ২০ শতাংশ, ২০১৫ সালে ১৯ শতাংশ, এবং ২০১৬- তে ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ হয়েছে। আরও সুখব হলো- বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের ইলিশ গবেষণা অনুযায়ী ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে জেলেদের জালে জাটকা ওঠার পরিমাণ ৮ দশমিক ৬ শতাংশ কমেছে। এক কেজির বেশি ওজনের ইলিশ ধরা পড়েছে ২০ শতাংশ বেশি।
জাটকা ধরা বন্ধের সুফল পাচ্ছে বাংলাদেশ
২০০২ সাল থেকে ইলিশের ডিম পাড়া ও বিচরণের স্থানগুলো চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ। সে স্থানগুলোতে ইলিশ ধরা এবং বছরের আট মাস জাটকা ধরা নিষিদ্ধ। তাছাড়া ডিম পাড়ার ১৫ দিন সব ধরনের ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ। ইলিশ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে এমন ১৫টি জেলার ২ লাখ ২৪ হাজার ১০২ জেলেকে পরিচয়পত্র দিয়ে তাদেরকে বছরে তিন মাস সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর আওতায় আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছে সরকার। দেশের ইলিশ রক্ষার এই কৌশল খুবই কার্যকর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে অন্য দেশের কাছে। জাটকা নিধন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমর্থ হওয়ায় এই সাফল্য এসেছে। জাটকা নিধন পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব হলে প্রতিবছর ২১ থেকে ২৪ হাজার কোটি নতুন পরিপক্ব ইলিশ আহরণ সম্ভব হবে। যার ফলে বছরে ৭ হাজার কোটি টাকা মূল্যের ইলিশের বাজার সৃষ্টি হবে। আহরিত ইলিশের সামান্য পরিমাণ রফতানি করে প্রতিবছর ১৫০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। জানা গেছে, প্রতিবছর ভারত ও মিয়ানমারে ইলিশ রফতানি হয় ৮ হাজার থেকে ৯ হাজার টন। ৮০০ থেকে ৯০০ টন রফতানি হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে। উল্লেখ্য, ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ছিল প্রায় ৩ লাখ টন, ২০১২-১৩ অর্থবছরে সাড়ে ৩ লাখ টন এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রায় ৪ লাখ টন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিশ্বে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির নেতৃত্বে বাংলাদেশ
বছরে পর পর নিরলস ও শ্রমলব্ধ গবেষণার ফলাফল থেকে পাওয়া তথ্যে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হন যে, ইলিশের পোনা জাটকা অবাধে নিধন এবং ডিমওয়ালা ইলিশসহ নির্বিচারে ইলিশ আহরণই এ মাছের চরম সঙ্কট সৃষ্টির প্রধান কারণ। বিজ্ঞানীরা ইলিশ উন্নয়ন ও সংরক্ষণের জন্য সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি উদ্ভাবন এবং এর ওপর ভিত্তি করে ইলিশ মাছ রক্ষার জন্য সরকারের কাছে প্রয়োজনীয় পরামর্শ উপস্থাপন করেন। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী সরকার আইন করে জাটকা মৌসুমে জাটকা নিধন এবং ডিম ছাড়ার দিনগুলোতে ডিমওয়ালা ইলিশ ধরা বন্ধের নির্দেশ জারি করে। এরপর শুরু হয় জাটকা নিধন বন্ধের অভিযান ও জনসচেতনতা সৃষ্টির পরিকল্পিত কার্যক্রম। জাটকা নিধন ও ডিমওয়ালা ইলিশ ধরা সম্পূর্ণ বন্ধ করা না গেলেও প্রতিবছর ইলিশ আহরণের পরিমাণ বাড়ছে। মাছ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশের পর্যবেক্ষণ অনুযাীয়- ইলিশ পাওয়া যায় বিশ্বের এমন ১১টি দেশের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশেই ইলিশের উৎপাদন ক্রমাগত বাড়ছে বাকি ১০টিতেই ইলিশের উৎপাদন কমছে। বাংলাদেশে ইলিশের উৎপাদন প্রতিবছর ৮ থেকে ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। ওয়ার্ল্ড ফিশের প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বে উৎপাদিত মোট ইলিশের ৬৫ ভাগই বাংলাদেশের। বাদবাকি ১৫ শতাংশ ভারত ও ১০ শতাংশ মিয়ানমার এবং বাকি ১০ শতাংশ আটলান্টিক, প্রশান্ত ও আরব সাগর তীরবর্তী দেশগুলেঅতে উৎপন্ন হয়। নদী গবেষণা কেন্দ্রের এক তথ্যে জানা গেছে, দেশের ১৫টি জেলায় ৮৫টি উপজেলায় ইলিশ উৎপাদনের ভেতর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এসব বৃদ্ধির মূল কারণ হচ্ছে জাটকা রক্ষা কর্মসূচী জোরদার করা ও অভয়াশ্রমগুলোতে মা মাছ আহরণ বন্ধ রাখা। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০০৩-২০০৪ অর্থবছরে ৯ ভাগ। ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরে ১০ ভাগ, ২০০৮ সালে ৩৮ ভাগ, ২০০৯ সালে ১৭ ভাগ, ২০১০ সালে ৩৩ ভাগ, ২০১১ সালে ৩৬ ভাগ, ২০১২-২০১৩ সালে বৃদ্ধি পেয়েছে ৪৪ ভাগ ২০১৩-২০১৪ সালে ৫০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। বরিশাল মৎস্য অধিদফতর সূত্র জানিয়েছে, দেশের ১০০টি নদীতে কমবেশি ইলিশ পাওয়া গেলেও ইলিশের প্রজনন ও পরিপক্বতা দক্ষিণাঞ্চলের নদীতেই হয়। দেশে মোট উৎপাদিত জাটকার ৬০-৭০ ভাগ দক্ষিণের বিষখালী, পায়রা, আগুনমুখা, বুড়িশ্বর, বলেশ্বর ও কীর্তনখোলা নদী থেকে আহরণ করা হয়। জানুয়ারি থেকে এপ্রিল এই ৪ মাসেই মোট জাটকার ৪৫-৬৫ ভাগ নিধন করা হয়।
ইলিশ হতে পারে জাতীয় সমৃদ্ধির হাতিয়ার
বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বলা যায়, একটি মা-ইলিশ একসঙ্গে কমপক্ষে তিন লাখ ও সর্বোচ্চ ২১ লাখ ডিম ছাড়ে। এসব ডিমের ৭০-৮০ শতাংশ ফুটে রেণু ইলিশ হয়। সর্বনিম্ন তিন লাখ পোনার ৭০ ভাগ রেণু ধরলে দুই লাখ ১০ হাজার রেণু উৎপাদন হয়। তাহলে একটি মা-ইলিশ থেকে ১০ শতাংশ হিসেবে দুই লাখ ১০ হাজার জাটকা পাওয়া যায়। সরকার ঘোষিত নিষিদ্ধ আট মাস জাটকা শিকার বন্ধ থাকলে ২১ থেকে ২৪ হাজার কোটি নতুন পরিপক্ব ইলিশ পাওয়া যাবে। এতে অর্জিত লক্ষ্যমাত্রায় বছরে ৭ হাজার কোটি টাকা মূল্যের ইলিশের বাজার সৃষ্টি সম্ভব হবে বাংলাদেশে। মৎস্য বিভাগ সূত্রে, প্রতিবছর গড়ে ১৪ হাজার ১৫০ টন জাটকা নিধন করা হচ্ছে। এই পরিমাণ জাটকার ২০ ভাগও যদি রক্ষা করা সম্ভব হয় তাহলে ১ লাখ ৭০ হাজার টন অতিরিক্ত ইলিশ আহরণ করা যেত। যার বাজারমূল্য ৪ হাজার কোটি টাকার মতো। মৎস্য গবেষণা ও ইলিশ বিশেষজ্ঞরাও বলছেন- ইলিশ মাছ ব্যবস্থাপনার মান উন্নয়ন ও গৃহীত কর্মপরিকল্পনা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে বছরে আরও ৫ থেকে ৬ লাখ টন ইলিশ আহরণ করা সম্ভব। এজন্য সরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি প্রয়োজন বেসরকারী খাতকে উৎসাহিত করা। ইলিশ মাছ ধরার সঙ্গে জড়িত জেলেদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। প্রাকৃতিক পরিবেশ, ডিম ছাড়া ও বেড়ে ওঠা অর্থাৎ প্রজনন এবং বংশ বিস্তারের নিশ্চয়তা পেলেই ইলিশের উৎপাদন বাড়বে। ইলিশের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হলে একদিকে যেমন ইলিশের জোগান বাড়বে, তেমনি মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণ হবে। অন্যদিকে এই মাছ রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রার আয়ও বেড়ে যাবে। এছাড়া দেশের প্রায় সোয়া কোটি মানুষ, যারা জীবিকার জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ইলিশ সম্পদের ওপর নির্ভরশীল, সেই জনগোষ্ঠীর জন্য ইলিশ সংরক্ষণ করার বিষয়ে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে।