সাক্ষাৎকার : প্রযুক্তি ক্ষেত্রে কাজের সুযোগ বেশি
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
শুরুটা হয়েছিল ছাত্রজীবন থেকেই। বুয়েটে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুবাদে প্রত্যাশার চাপ ছিল সব সময়ই। যেমন অন্য সবার মতো ইঞ্জিনিয়ার হয়েই দেশের বাইরে পাড়ি জমাতে হবে, নতুবা বড় কোনো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করতে হবে! কিন্তু তিনি শুরু থেকেই ভাবতেন দেশে থেকেই নিজে কিছু করার কারণ তার একটা বিশ্বাস ছিল, এই দেশে যেহেতু আইটি সেক্টর এখনও দুর্বল, সুতরাং এখানে কাজ করার সুযোগও বেশি। বুয়েটের আহসানুল্লাহ হলে নিজের কক্ষেই যাত্রা শুরু করে সুমিত সাহার নিজের অনলাইন প্রতিষ্ঠান এনালাইজেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি শুনিয়েছেন তার উদ্যোগ ও সম্ভাবনার কথা।
: আপনার শুরুর গল্পটা জানতে চাই
আবাসিক হোস্টেলে থাকার কারণে বেশ কিছু মেধাবী বড় ভাইদের সান্নিধ্য পেয়েছি। তাদের কাছেই প্রথম আউটসোর্সিং ব্যাপারটি সম্পর্কে জানতে পারি। দেশে বসেই বাইরের ক্লায়েন্টদের কাজ করা – পুরো ব্যাপারটিই আমাকে অনেক আকৃষ্ট করে। ওয়েব-বেসড প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ পিএইচপি শেখা শুরু করি। যদিও ওয়েব-বেসড প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ সম্পর্কে আমাদের একাডেমিক কোর্সে তেমন কিছু শেখানো হতনা, তাই শুরুতে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু পিএইচপি একটি ওপেনসোর্স ল্যাঙ্গুয়েজ হওয়ায় ইন্টারনেটে অনেক রিসোর্স পেয়েছি এবং যেহেতু বিষয়টিতে আমার আগ্রহ অনেক বেশি ছিল, তাই সকল সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠে বিষয়টি আস্তে আস্তে নিজের আয়ত্তে আনতে সক্ষম হই। এরপর অনলাইনে ফ্রিল্যান্সার সাইট গুলোতে বিড করতে শুরু করি। প্রথমে কাজের পোর্টফোলিও না থাকায়, ক্লায়েন্ট কাজ দিতে চাইত না। অন্যান্যদের চাইতে অনেক কম টাকায় বিড করতাম। কিন্তু হাল ছাড়িনাই। লেগে থাকতে থাকতে এভাবেই আস্তে আস্তে কাজ পেতে শুরু করি। এটা আমার উৎসাহ বাড়িয়ে দেয়। ছোট ছোট কাজ পেতে পেতে ধীরে ধীরে বড় কাজ পেতে শুরু করি। এভাবেই চলল বেশ কিছুদিন। তারপর একদিন প্রিয় বন্ধুর সাথে বসে সিদ্ধান্ত নেই একটি কোম্পানি চালু করার। এভাবেই বুয়েটের আহসানুল্লাহ হলের ৩৪৭ নং রুমে জন্ম হয় আমার নিজের কোম্পানি এনালাইজেনের। সেটা ছিল ২০০৮ সালের ১৩ই আগস্ট।
আমরা প্রচুর কাজ পেতে শুরু করি অনলাইনেই। ওই সময় আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কানাডা, চায়না, ইন্ডিয়া, দুবাই, নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া এরকম আরো বেশ কিছু দেশে আমাদের ক্লায়েন্ট বেস তৈরী হয়। সাধারণ ওয়েবসাইট থেকে শুরু করে, জটিল বিভন্ন ওয়েব এপ্লিকেশন্স বানানো শুরু করি আমরা। বুয়েটে থাকার সুবাদে অনেক বুয়েটের ছোট ভাইরা আমার কোম্পানিতে যোগ দেয় এবং পার্ট-টাইম কাজ করতে শুরু করে। তারপরে আর থেমে থাকতে হয়নি।
দেশের বাইরের মার্কেটে আমাদের ফিক্সড ক্লায়েন্ট বেস তৈরী হয়ে গেলেও শুরু থেকেই দেশের ভিতরে কিছু করার ইচ্ছা ছিল। সেই ইচ্ছা থেকেই আমরা লোকাল মার্কেট নিয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু করি। ফেসবুক তখন বাংলাদেশে অনেক জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব এর জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। আমি আর আমার বন্ধু মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম এই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমটিকে কাজে লাগাতে। আমরা দেখতাম দেশের বড় বড় ব্র্যান্ড গুলো টিভি মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া এসব মাধ্যম গুলোকে নিজেদের পণ্যের প্রমোশনের জন্য ব্যবহার করছে। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করছে টিভি এবং প্রিন্ট মিডিয়া গুলোতে বিজ্ঞাপন দিতে। আমরা তখন চিন্তা করে দেখি যে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম অর্থাৎ সোসাল মিডিয়া আরেকটি বিজ্ঞাপনের মাধ্যম হতে পারে। আমরা কাজ শুরু করে দেই। শুরুর কাজটা অনেক জটিল ছিল। কারণ বাংলাদেশের কোম্পানি গুলো পরিবর্তন এর ব্যাপারে অনেক সাবধান থাকে সবসময়। তাই তাদের কাছে এই মিডিয়াকে তুলে ধরা এবং বুঝানো অনেক জটিল একটি ব্যাপার ছিল। পাশাপাশি আমরা তখনও ছাত্র থাকায় এবং বয়সে অনেক ছোট হওয়ায় এরকম একটি নতুন মিডিয়াকে ব্র্যান্ড গুলোর কাছে তুলে ধরার কাজটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। আমরা তখন বিভিন্ন কোম্পানি তে যেতাম এবং তাদের কাছে আমাদের আইডিয়া গুলো তুলে ধরতাম। অনেক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। শুরুতে সেভাবে সহযোগিতা পাইনি। তবে কখনও হাল ছাড়িনি। আমরা ব্র্যান্ড গুলোকে বুঝাতে চেষ্টা করতাম সোসাল মিডিয়াই একমাত্র মাধ্যম যেখানে ব্র্যান্ড এবং তাদের সাবস্ক্রাইবারদের ভিতর উভমুখী যোগাযোগ করা সম্ভব। আমরা টিভিতে অথবা পেপার পত্রিকায় যে বিজ্ঞাপন গুলো দেখি সেগুলোতে সাধারণ সাবস্ক্রাইবারদের পক্ষে তাদের মতামত জানানোর সুযোগ থাকেনা। কিন্তু সোসাল মিডিয়াতে সেটা সম্ভব। পাশাপাশি সোসাল মিডিয়াতে একটা কোন বিষয়কে একটি নির্দিষ্ট নেটওয়ার্কে ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব।
ধীরে ধীরে আমরা সাফল্যের মুখ দেখি। আমরা কিছু স্মার্ট ব্র্যান্ড কে বুঝাতে সক্ষম হই যে সোসাল মিডিয়া এবং ইন্টারনেট মার্কেটিং তাদের পণ্যের বিপণনের জন্য একটা বড় মাধ্যম হতে পারে। আস্তে আস্তে আমরা সোসাল মিডিয়া যেমন ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউবে কিছু ব্র্যান্ডের প্রমোশনের কাজ শুরু করি। ফেসবুক পেইজ, টুইটার ব্র্যান্ড প্রোফাইল, ইউটিউব পেইজে আমরা আমাদের ক্লায়েন্টের পণ্যের অনলাইন মার্কেটিং শুরু করি। ব্র্যান্ড গুলো কিছুদিন পর ধীরে ধীরে বুঝতে পারে তাদের পণ্যের বিপনণে সোসাল মিডিয়া মার্কেটিং গুরুত্ত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আমাদের কাছে তারা আরো নতুন নতুন আইডিয়া চেয়ে অনুরোধ করতে থাকে। এভাবেই এনালাইজেন বাংলাদেশের প্রথম ডিজিটাল অনলাইন এজেন্সি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এরপর বাকিটা ইতিহাস। আজ এনালাইজেন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ডিজিটাল মার্কেটিং এজেন্সি। দেশের নামকরা অনেক বড় বড় ব্র্যান্ড এখন তাদের পণ্যের অনলাইন প্রমোশনের জন্য এনালাইজেনের উপর নির্ভরশীল। দুইজন তরুণ উদ্যক্তার প্রয়াস এনালাইজেনে আজ ৪০+ জন দক্ষ প্রোগ্রামার এবং কন্টেন্ট ক্রিয়েটর আছেন।
: আপনার কাজ সম্পর্কে জানতে চাই
আমার নিজের প্রতিষ্ঠান এনালাইজেন এখন দেশের নামকরা সব ব্র্যান্ডের অনলাইন উপস্থিতিকে মানুষের সামনে তুলে ধরছে। বাইরের বিভিন্ন ক্লায়েন্টের জন্য সফটওয়্যার এবং ওয়েব এপ্লিকেশন্স বানানোর পাশাপাশি দেশীয় বিভিন্ন কোম্পানির সোসাল মিডিয়া মার্কেটিং এর কাজ করে থাকে এনালাইজেন। এর পাশাপাশি মোবাইল এপ্লিকেশন্স, অনলাইন এডভার্টাইজমেন্ট, সোসাল গেমস ডেভেলপমেন্ট, অনলাইন ভিডিও কমার্শিয়াল ডেভেলপমেন্ট, ওয়েবসাইট ডিজাইন এবং ডেভেলপমেন্ট এর কাজ করছে এনালাইজেন।
: কতটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন এই পেশায়?
আসলে সত্যি কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ জিনিসটা আসে স্বাধীনতা থেকে। আমি যা করতে চাচ্ছি তা করতে পারার স্বাধীনতা। আমি শুরুতে বেশ কিছু সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি করেছি। কিন্তু চাকরি জিনিসটা আমাকে কখনওই তেমন টানতোনা। এর কারণ সেখানে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ জিনিসটা ছিলনা। নিজের তৈরী করা প্রতিষ্ঠানে আমি সেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ পেয়েছি। যা চেয়েছি নিজের মত করতে পেরেছি। আমার কাজকে উপভোগ করতে পেরেছি। নিজের কাজকে উপভোগ করাটা খুবই জরুরী। বাঁধাধরা ৯টা – ৫ টা অফিস আমার কখনই ভাল লাগেনি। সেখানে নতুন কিছু করার স্পৃহাটাও থাকেনা বলে আমি মনে করি। তাই সবসময়ই চেয়েছি যা করব নিজের মত করে করব। সেখানেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ থাকবে আর আমি মনে করি সেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধই আজ আমার যেটুকু সাফল্য আছে, তার জন্য মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। শুরুটা কঠিন হয়েছে অনেক, অনেক প্রত্যাশার চাপ সামলাতে হয়েছে, সম্পূর্ণ নতুন একটা জিনিস নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে ঝুঁকি তো ছিলই। কিন্তু তবুও নিজের উপর আত্মবিশ্বাস এবং নতুন কিছু করার ইচ্ছা থেকেই আজ হয়ত এই অবস্থানে আমি আসতে পেরেছি বলে মনে করি। হয়ত সেকারণেই আজ নিজের ক্যারিয়ারের পাশাপাশি আরো অনেক উজ্জ্বল তরুণ-তরুণীর ক্যারিয়ার এর পথপ্রদর্শক হতে পেরেছি।
: পেশা হিসেবে এটা আমাদের দেশে কতটা উপযোগী?
আজ থেকে ৫ বছর আগের কথা চিন্তা করলে, এই পেশা ততটা উপযুক্ত ছিল আমি বলবনা। কিন্তু আজ আমি আমার সকল তরুণ ভাই-বোনদের উদ্দেশ্যে বলব, অনলাইন মার্কেটিং এবং আইটি ইন্ডাস্ট্রিজ দেশের জন্য এখন খুবই যুগোপযুগী একটি পেশা। প্রতি নিয়ত নিত্যনতুন টেকনোলজি আসছে, কাজের ক্ষেত্র দিন দিন বাড়ছে। এখানে নতুন কিছু করার, নতুন কিছু উদ্ভাবন করার অনেক অনেক বেশি সুযোগ রয়েছে। এই ইন্ডাস্ট্রি অনেক বড় এবং এর চাহিদা কমে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। এই যুগ হল ইন্টারনেটের যুগ। এখানে কাজের সুযোগের কোন অভাব নেই। আমাদের দেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। উন্নত দেশের তুলনায় উন্নয়নশীল দেশের কাজের ক্ষেত্র সবসময়ই বেশি থাকে। শুধু প্রয়োজন একটু ধৈর্য্য এবং অধ্যাবসায়। তাই বিদেশ মুখী না হয়ে এই দেশের আইটি সেক্টরে সকল তরুণ ভাই-বোনদের অবদান রাখার জন্য আমি আবেদন করছি।
যারা নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পছন্দ করেন তাদের জন্য এ সেক্টর উপযুক্ত স্থান। আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন কোম্পানি আসছে এবং তাদের পণ্য বাজারজাত করতে তারা অনলাইন মার্কেটিং এর সাহায্য নিচ্ছে। যদিও এক সময় অনলাইন মার্কেটিং বলে কোন ডিপার্টমেন্ট ছিল না কিন্তু বর্তমানে ডিজিটাল মার্কেটিং আলাদা ডিপার্টমেন্ট হয়েছে প্রায় সবগুলো কোম্পানিতে। সেই সঙ্গে এসব ডিপার্টমেন্টে প্রচুর দক্ষ লোকবল প্রয়োজন হচ্ছে। এ সেক্টরে চাকরির জন্য সাধারণত বিবিএ, এমবিএ এবং মার্কেটিংগ্র্যাজুয়েট এর পাশাপাশি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, ওয়েব প্রোগ্রামার, মোবাইল এপ্লিকেশন্স ডেভেলপার চাওয়া হয়। সঠিক জ্ঞান ও পরিশ্রম করলে এ সেক্টরে অল্প সময়ে ভালো অবস্থানে যাওয়া সম্ভব।
: নতুনদের কাজের সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ণ কী?
আমি খুবই ক্ষুদ্র একজন মানুষ। এই দেশের মানুষের অপার প্রতিভা এবং কাজের মূল্যায়ন করার ধড়ড়িষ্টতা দেখাতে চাইনা। তবে এটুকু বলতে চাই, নতুনদের কাজের প্রতি আমার অপরিসীম শ্রদ্ধা আছে। আমার প্রচুর বাইরের ক্লায়েন্ট দের সাথে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। সেখানেও আমি দেখেছি, অন্যান্য সকলের তুলনায় বাংলাদেশি ভাই-বোনদের কাজের প্রতি তাদের সম্মান রয়েছে। এই দেশের মানুষ অনেক প্রতিকূলতা কাটিয়ে, অনেক সীমাবদ্ধতা কে কাটিয়ে উঠে দেশে বিদেশে তাদের সাফল্যের নিদর্শন রাখছে। দেশে এখন অনেক ভাল ভাল কাজ হচ্ছে। আজ থেকে কিছুদিন আগেও যা চিন্তা করা যেতনা, দেশে এখন তাই হচ্ছে। দেশের ইন্টারনেট ইউজার, মোবাইল ইউজার দিন দিন বাড়ছে। প্রতিদিন নতুন নতুন মানুষ অনলাইনের দুনিয়ায় সংযুক্ত হচ্ছে। দেশের ভিতরে এখন অনেক অনেক বড় বড় আইটি কোম্পানি গড়ে উঠছে যারা অন্যান্য অনেক উন্নত দেশের কোম্পানি গুলোর সাথে প্রতিযোগিতা করে দেশের জন্য বাইরের মার্কেট থেকে কাজ নিয়ে আসছে। বিশ্ববিখ্যাত সফটওয়্যার কোম্পানি মাইক্রোসফট, অনলাইন জায়ান্ট গুগলের মত কোম্পানি বাংলাদেশে তাদের ব্রাঞ্চ অফিস সেট আপ করছে। যেখানে তারাই বাইরে থেকে আমাদের দেশে চলে আসছে, আমরা কেন তাদের দেশে যেয়ে তাদের সেবায় নিজেদের কে নিবেদন করব? তার চেয়ে এই দেশটার জন্য আমরা কিছু করি। দেশের টাকা দেশের বাইরে না নিয়ে, দেশের ভিতরেই রাখি, বিদেশ থেকে টাকা নিয়ে আসি!
আউটসোর্সিং এ বাংলাদেশের অবস্থান আমাদের প্রতিবেশি দেশ ভারতের থেকেও অনেক উপরে। এখনও তো আমরা সবে শুরু করেছি। তাই আমরা এতদূর চলে এসেছি। তাহলে সামনের দিন গুলোতে আমরা আরো কি করতে পারি সেটা অনুমান করেই নেয়া যায়। হয়ত এমন দিন দূরে নয় যেদিন বিদেশ থেকে মেধাবীরা এসে আমাদের দেশে সেবা প্রদান করতে আসবে।
: তাদের জন্য কী পরামর্শ দিবেন?
আইটি এবং ডিজিটাল মার্কেটিং সেক্টরের প্রতি এখনকার প্রজন্ম এমনিতেই অনেক বেশি আগ্রহী। ইন্টারনেটের সুবাদে এবং ফেসবুক, টুইটার, লিঙ্কডইন, ইউটিউব, গুগল প্লাস এসব সোসাল মিডিয়াকে আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্ম তাদের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে চলেছে। তাদের প্রতি আমার পরামর্শ বিনোদনের এই পরিচিত মাধ্যমটিকেই তাদের ক্যারিয়ারের মাধ্যম হিসেবে বেঁছে নিতে। এখানে প্রোগ্রামিং, কন্টেন্ট ডেভেলপমেন্ট, ডিজাইন, আইডিয়া জেনারেশন ইত্যাদি অনেক কাজের সুযোগ রয়েছে। নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী একটি সেক্টর বেছে নিয়ে সেই অনুযায়ী আগাতে থাকলে সাফল্য নিশ্চিত। আর এই পেশার সবচেয়ে ভাল দিক হচ্ছে এই পেশায় একঘেয়েমির সুযোগ নেই। অনেক মজা করে কাজ করা যায়। ফলে কাজকে উপভোগ করা যায়। যারা সৃজনশীল তাদের জন্য এর চেয়ে ভাল মিডিয়া আর হতে পারেনা।
আমার ছোট ভাই-বোনদের প্রতি আমার অনুরোধ নিজেদের পাঠ্যপুস্তকের বাইরে জানার চেষ্টা করুন। কারণ আমাদের একাডেমিক কোর্স গুলোতে জীবনমুখী অনেক কিছুই শেখানো হয়না। যেহেতু এই সেক্টরে প্রতিনিয়ত নিজের উদ্ভাবনী শক্তির স্বাক্ষর রাখতে হয়, তাই পাঠ্যপুস্তকের সীমিত জ্ঞানের গন্ডী থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আমার অভিজ্ঞতা থেকেই দেখেছি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নতুন কিছু ভাবার ব্যাপারে আমাদের সীমাবদ্ধতা থেকে যায়, অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের আইডিয়াগুলো একটা নির্দিষ্ট ক্ষেত্রবিশেষে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। অর্থাৎ নতুনরা নিজের গণ্ডি থেকে বের হতে পারছে না খুব আশাব্যঞ্জক হারে। সেজন্য আমাদের কে অনেক বেশি চোখ কান খোলা রাখতে হবে। আর নতুন প্রজন্মের জন্য ইন্টারনেট অনেক বেশি সহযোগিতাপূর্ণ একটি মাধ্যম, অনেক কিছুই সহজে জানতে পারে তারা। সেটা কাজে লাগাতে হবে তাদের। এ ক্ষেত্রে প্রতি নিয়ত আপডেট থাকাটাই হচ্ছে মূল কথা। এর পাশাপাশি রক্ষণশীলতা কাটিয়ে উঠতে হবে। এটা এই পেশায় অনেক ক্ষেত্রেই বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।
: আপনার শৈশব কৈশোর ও পরিবারের কথা জানতে চাই।
আমার ছেলেবেলা কেটেছে বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে বিভিন্ন শহরে। মাধ্যমিক পরীক্ষা দেই রংপুর জিলা স্কুল থেকে, তারপর নটরডেম কলেজ থেকে এইচএসসি। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাবে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করি। এরপর দেশের বেশ কিছু সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি করেছি। এখন নিজের প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি এনালাইজেন এ সার্বক্ষণিক সময় দিচ্ছি। আমার বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, মা গৃহিনী। মা বাবা নিয়েই আমার ছোট্ট সংসার। আমার অনুপ্রেরণা আমার বাবা। আমার বাবার কাজের ক্ষেত্রের সাথে আমার নিজের কাজের ক্ষেত্রের কোন সামঙ্গস্য না থাকলেও পরিশ্রম, কাজের পিছনে লেগে থাকা, অনেক বেশি চিন্তা করতে পারা এসব শিখেছি আমি আমার বাবার কাছে। পাশাপাশি আমার মমতাময়ী মায়ের ভূমিকা আমার জীবনে সবচেয়ে বেশি। আমি যখন যা করতে চেয়েছি আমার মা সর্বদা আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন। কাজের অবসরে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে এবং ইন্টারনেট ব্রাউজিং করতে পছন্দ করি।
: আপনার ভবিষ্যত স্বপ্ন কী ?
আমার ভবিষ্যৎ স্বপ্ন নিজের প্রতিষ্ঠা করা কোম্পানি এনালাইজেন কে ঘিরেই। এনালাইজেন কে গ্লোবালি নিয়ে যাওয়া। দেশে বসেই গ্লোবাল ব্র্যান্ড গুলোর হয়ে কাজ করা। বিশ্বমানের সফটওয়্যার কোম্পানি এবং ডিজিটাল মার্কেটিং এজেন্সি হিসেবে নিজেদের অবস্থান কে সুদৃঢ় করা। মেধাবী তরুন প্রজন্ম কে বিদেশমুখী না হয়ে স্বদেশমুখী করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে চায় এনালাইজেন। আরো স্বপ্ন আছে একটি বিশ্বমানের সফটওয়্যার এবং ডিজিটাল মার্কেটিং ট্রেনিং ইন্সটিউট প্রতিষ্ঠিত করা যা বাংলাদেশের তরুন প্রজন্মের পথপ্রদর্শক হয়ে কাজ করবে।