দেশে হতদরিদ্র কমেছে বেড়েছে চ্যালেঞ্জ
- নিউজ ডেস্ক
দারিদ্র্য, অনাহার, জীবনযাত্রার নিম্নমানের কথা আলোচনা হলে বাংলাদেশের নাম উঠে আসে। ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (এফএও), ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট (আইএফডি) এবং ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের (ডব্লিউএফপি) পক্ষ থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এখনো বিশ্বে ৮০ কোটি বা প্রতি নয়জনের একজন মানুষ ক্ষুধার শিকার। এ দরিদ্র ও ক্ষুধার্ত মানুষের বড় একটি অংশ বাংলাদেশে বসবাস করে। দারিদ্র্য এমন অর্থনৈতিক অবস্থা, যখন একজন মানুষ জীবনযাত্রার ন্যূনতম মান অর্জন করতে এবং স্বল্প আয়ের কারণে জীবনধারণের অপরিহার্য দ্রব্যাদি ক্রয় করার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। দারিদ্র্য সৃষ্টির কারণ হিসাবে সাংস্কৃতিক স্বেচ্ছাচারিতা ও আগ্রাসন, জনসংখ্যার চাপ, অর্থনৈতিক দুর্দশা, সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, খরা ইত্যাদির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগকে দায়ী করা হয়।
সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের অতি দারিদ্র পরিস্থিতির বেশ উন্নতি হয়েছে। দেশে হতদরিদ্রের সংখ্যা কমেছে। সাত বছরের ব্যবধানে প্রায় ৮০ লাখ হতদরিদ্র লোক অতি দারিদ্র্যসীমার উপরে উঠেছে। একাধিক পরিসংখ্যান বলছে, ২০১২ সালে ১৬.৪ শতাংশ, ২০১৩ সালে ১৬.৪ শতাংশ, ২০১৪ সালে ১৮.৭ শতাংশ, ২০১৫ সালে ১৩.৮ শতাংশ এবং ২০১৬ সালে ১২.৯ শতাংশ মানুষ অতি দরিদ্র। সংস্থাটি বলছে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানামুখী উদ্যোগ আর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকায় বাংলাদেশের হতদরিদ্রের হার ১২.৯ শতাংশে নেমে এসেছে। গত ৩ অক্টোবর ২০১৬ সারাবিশ্বের বিভিন্ন দেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতি নিয়ে ‘টেকিং অন ইন-ইকোয়ালটি’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। এ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের উপর একটি অংশ রয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের এ চিত্র উঠে এসেছে। সংখ্যায় হিসাব করলে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে দুই কোটি ৮০ লাখ বর্তমানে অতি দরিদ্র। অথচ ২০০৫ সালে এ হার ছিল ৪৩.৩ শতাংশ। অর্থাত্ মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই ছিল হতদরিদ্র। ক্রয়ক্ষমতার (পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি-পিপিপি) ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশে এখন অতি দরিদ্রের দৈনিক আয় ১.৯০ ডলারের কম অর্থাত্ টাকার হিসাবে ১৪৮ টাকার কম (এক ডলার=৭৮ টাকা)। অতি দরিদ্রের হার কমিয়ে আনতে বাংলাদেশের অর্জন অবিস্মরণীয়। দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে ভারত, পাকিস্তান ও ভুটানের মতো দেশকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। ২০০৫ সালে ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে কোনো ব্যক্তি দৈনিক ১.২৫ ডলারের (বাংলাদেশি টাকায় ৯৮ টাকা) নিচে আয় করলে তাকে অতি দরিদ্র হিসাবে গণ্য করা হতো। সেটিকে সংস্কার করে এখন ১.৯০ ডলারে উন্নীত করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী নতুন এ মানদণ্ড গতবছর থেকে কার্যকর করা হলেও বাংলাদেশে হয়েছে ২০১৬ সাল থেকে।
বিশ্বব্যাংক দারিদ্র্য হ্রাসের সাফল্যের সাথে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের কথাও বলেছে। চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার। কিন্তু বিশ্বব্যাংক এ প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। আর আগামী অর্থবছরে এ প্রবৃদ্ধি আরও কমে ৬ দশমিক ২ শতাংশে নেমে আসবে বলে মনে করছে। সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বৃদ্ধি প্রবৃদ্ধিতে একটি ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। তবে গত অর্থবছরের প্রাথমিক প্রাক্কলনের তুলনায় ব্যক্তি খাতের ও সরকারি ভোগব্যয়ের প্রবৃদ্ধি কম হবে বলেই চলতি অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি কম হবে।
জিডিপির তুলনায় বেসরকারি বিনিয়োগের হার সাড়ে ২১ থেকে সাড়ে ২২ শতাংশে সীমিত হয়ে পড়েছে। অনেকেই মনে করছেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগের অন্যতম সমস্যা অর্থ পাচার। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৫৫৮ কোটি ৮ লাখ ডলার পাচার হয়ে যাচ্ছে। দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ৪৪ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। এর পেছনে কারণ হচ্ছে, অবকাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার হয়নি এবং ব্যবসার ভোগান্তি বেশি।
বাংলাদেশে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশের ঘাটতি রয়েছে উল্লেখ করে জাহিদ বলেন, এখানে বিদ্যুতের সংযোগ পেতে সময় লাগে ৪০৪ দিন। নির্মাণ কাজের অনুমতি পেতে সময় লাগে গড়ে ২৭৮ দিন। নিবন্ধন পেতে লাগে ২৪৪ দিন। আর আইনী কোনো বিষয় নিষ্পত্তি হতে সময় লাগে এক হাজার ৪৪২ দিন। এসব কারণে বাংলাদেশে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ উত্সাহিত হয় না। ‘বাংলাদেশ উন্নয়ন আপডেটে’ বেশ কিছু ঝুঁকির কথাও বলেছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশের আর্থিক খাত এখনো বেশ দুর্বল। এখনো অনেক সংস্থার দরকার। বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সংস্কারের উপর জোর দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে বিনিয়োগের অফুরন্ত সম্ভাবনা থাকলেও দুর্নীতি অন্যতম অন্তরায় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ পরিবেশ সংক্রান্ত বিবৃতি ২০১৫-তে বাংলাদেশ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতিকে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। দেশটি বলছে বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো বাজার ও সম্ভাবনার জন্য যে বৃহত্তর ব্যবসায়িক পরিবেশ চায়, দুর্নীতি তাতে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ পরিবেশ সংক্রান্ত বিবৃতি-২০১৫-তে বাংলাদেশ সম্পর্কে এমন মন্তব্য করা হয়েছে। বিনিয়োগ পরিবেশ সংক্রান্ত বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্র বলেছে ঘুষ, অর্থ আত্মসাত্ ও অন্যান্য ধরনের দুর্নীতি মোকাবেলায় সরকারের আইন থাকলেও এ বিষয়ে পদক্ষেপগুলো ধারাবাহিক নয়।
দারিদ্র্য হ্রাসের বর্তমান জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের (এসডিজি) দারিদ্র্য বিমোচনের প্রথম লক্ষ্যটি অর্জিত হবে না বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক। এসডিজির লক্ষ্য অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে অতি দারিদ্র্যের হার ৩ শতাংশের নিচে নামাতে হবে। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংক ব্যাখ্যায় বলেছে, ২০০০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত মোট জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় প্রবৃদ্ধি হিসাব করে দেখা গেছে, ওই সময়ে প্রতিবছর ১ দশমিক ৫৪ শতাংশ দারিদ্র্য কমেছে। এ সময় অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি বেশি হয়েছে। দারিদ্র্য হ্রাসের এ ধারা বজায় থাকলে ২০৩০ সালে এ দারিদ্র্য হার কমে দাঁড়াবে ৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ। একইভাবে ২০০৫ সালের পর থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বার্ষিক দশমিক ৯২ শতাংশ হারে দারিদ্র্য কমেছে। আগের পাঁচ বছরের তুলনায় কম অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালে এ দারিদ্র্যের হার ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ।
এসডিজির লক্ষ্য অর্জনে বিশ্বব্যাংক আরও বলছে, প্রতিবছর দারিদ্র্য হ্রাসের হার ৯২ শতাংশ বজার রেখে এসডিজি লক্ষ্য অর্জন করতে হলে প্রতিবছর গড়ে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। এটি বেশ চ্যালেঞ্জিং। আর ১ দশমিক ৫৪ শতাংশ হারে দারিদ্র্য হ্রাসের ধারা বজায় থাকলে ৬ দশমিক ১ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশের দারিদ্র্য জয়ের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা।