বাংলাদেশি কাঁকড়ার বিদেশ যাত্রা
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
ভোরের আলো তখনো ঠিকমতো ফোটেনি। শুরু হয়েছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে রাস্তার দুই পাশে ট্রাকের সারি। নামানো হচ্ছে ছোট ছোট বাঁশের খাঁচা। কচুরিপানা দিয়ে ঢাকা। ভেতরে ছোট-বড়-মাঝারি আকৃতির কাঁকড়া। দেশের উপকূল অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকার খামার থেকে বিদেশে রপ্তানির জন্য এগুলো আনা হয়েছে। বছরে এখন ২০০ কোটি টাকার কাঁকড়া রপ্তানি হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, রপ্তানি নীতিমালা সংশোধন ও এয়ারলাইনস এজেন্টদের বাধ্যতামূলক প্যাকেজ প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে আসার ব্যবস্থা করলে এই ব্যবসা আরও বাড়বে।
ঢাকার উত্তরার হরিরামপুর ইউনিয়নের নলভোগে গড়ে উঠেছে দেড় শতাধিক কাঁকড়া রপ্তানির বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ লাইভ অ্যান্ড চিল্ডফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, উত্তরায় ১৬০টির মতো কাঁকড়া রপ্তানির প্যাকিং প্রতিষ্ঠান আছে। এর প্রায় ৮০টি নলভোগে।
সরেজমিনে দেখা যায়, নলভোগের কাঁকড়ার প্যাকিং কারখানায় ভোরের আলো ফোটার সময় থেকেই শুরু হয় ব্যস্ততা। কাজের ধাপগুলো এ রকম—ট্রাক থেকে খাঁচা নামানো, কাঁকড়া পরিষ্কার করা, পুরুষ-মহিলা আলাদা করা, ওজন করে পুরুষ কাঁকড়া চারটি এবং নারী কাঁকড়া তিনটি মোট সাতটি গ্রেডে ভাগ করা, সুতো দিয়ে প্রধান কাঁটা বেঁধে ফেলা এবং সবশেষে চাহিদা অনুসারে প্লাস্টিক কিংবা ককশিটের বাক্সে ভরে প্যাকেট করা। এরপরে কাঁকড়াভর্তি প্যাকেটগুলো চলে যায় বিমানবন্দরে। সেখান থেকে বিভিন্ন দেশে।
কাঁকড়া রপ্তানিকারী ব্যবসায়ীরা জানান খুলনা, সাতক্ষীরা, নোয়াখালী, পটুয়াখালী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে কাঁকড়া আসে। দাম নির্ভর করে ওজনের ভিত্তিতে করা গ্রেডের ওপর। বড়গুলো প্রতি কেজি ৫৫০ টাকা, সবচেয়ে ছোটগুলোর কেজি ১০০ টাকা। তবে আন্তর্জাতিক বাজার অনুসারে দাম ওঠা-নামা করে। কখনো কখনো কেজি ১ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত উঠে যায়।
নৃপেন্দ্র নারায়ণ দাস, কাঁকড়া রপ্তানি শুরুর সময়ের একজন ব্যবসায়ী। ১৯৮৩ সালে নারায়ণগঞ্জের নিজস্ব একটি কারখানা থেকে তিনি কাছিম ও কাঁকড়া রপ্তানি শুরু করেন। কাছিম রপ্তানি নিষিদ্ধ হওয়ার পর এখন কাঁকড়া ও কুঁচিয়া মাছ রপ্তানি করছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আগে চট্টগ্রামের চকরিয়ায় সপ্তাহে মাত্র এক দিন কাঁকড়া বেচাকেনা হতো। সেখান থেকে কাঁকড়া কিনে এনে নারায়ণগঞ্জে প্যাকেট করে বিদেশে পাঠাতেন। কাঁকড়া প্যাকিংয়ের কারখানাগুলো আগে ঢাকার বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। বিমানবন্দরের কাছে হওয়ায় এই ব্যবসার অধিকাংশ প্যাকিং কারখানা গড়ে উঠেছে উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টর-সংলগ্ন হরিরামপুরের নলভোগে। অনেকে নলভোগকে এখন ‘কাঁকড়ার গ্রাম’ বলেও চেনেন।
বাংলাদেশ লাইভ অ্যান্ড চিল্ডফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সূত্র জানায়, প্রতিদিন গড়ে ২০ টন কাঁকড়া বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করা হচ্ছে। বছরে ১৫-১৬ ছুটির দিন বাদে সারা বছর প্রায় সাত হাজার টন কাঁকড়া রপ্তানি হয়। যায় চীন, কুয়ালালামপুর, হংকং, তাইওয়ান, মালয়েশিয়া, জাপান, আমেরিকা প্রভৃতি দেশে। সবচেয়ে বেশি যায় চীনে। টাকার অঙ্কে বছরে গড়ে প্রায় ২০০ কোটি টাকার কাঁকড়া রপ্তানি হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা জানালেন, তাজা কাঁকড়া রপ্তানি করতে হয়। রপ্তানি করা কাঁকড়া বাক্সের ভেতর মারা গেলে তার দাম মেলে না। গ্রীষ্মে কাঁকড়ার দাম ও চাহিদা কম থাকে, মারাও যায় বেশি। তখন লোকসান হয়। কিন্তু ক্রেতাদের ধরে রাখতে রপ্তানি অব্যাহত রাখাতে হয়। এ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা সরকারের তরফে আর্থিক বা অন্য কোনো সহায়তা পান না। বরং রপ্তানি রাজস্ব বাবদ প্রতি কেজিতে তিন টাকা দিতে হয় এবং ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হয়।
রপ্তানি নীতিমালা সংশোধন ও যথাযথ বাস্তবায়নের প্রয়োজন: পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাঁকড়া রপ্তানি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয় ১৯৯৮ সালে। এখন এই নীতিমালার কিছু বিষয় সংশোধন দরকার বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। নীতিমালায় রপ্তানির জন্য পুরুষ ও নারী কাঁকড়াভেদে সর্বনিম্ন ওজন নির্ধারিত সর্বনিম্ন ২০০ গ্রাম এবং ১৬০ গ্রাম। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই ওজন পুরুষের ক্ষেত্রে ১৬০ গ্রাম এবং নারীর ক্ষেত্রে ১০০ গ্রাম করলে মানসম্মত রপ্তানির হার আরও বাড়বে।
ব্যবসায়ীরা এজেন্টদের কাছে জিম্মি: রপ্তানির জন্য বিমানের জায়গা পাওয়া নিয়ে কাঁকড়া ব্যবসায়ীরা ঘোরতর সংকটে রয়েছেন। তাঁরা প্রায় একরকম জিম্মি হয়ে পড়েছেন বিভিন্ন এয়ারলাইনসের এজেন্টদের প্যাকেজ ব্যবস্থার কাছে। এজেন্টদের দাবি না মানলে তারা বিমানের জায়গা দিতে টালবাহানা করে। ৫০০ কেজির জায়গার প্রয়োজন হলে দেওয়া হয় ৫০ কেজির জায়গা। অথচ দ্রুত পাঠানো না হলে কাঁকড়া মরে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে বাধ্য হয়ে এজেন্টদের দাবি মানতে হয়।
কাঁকড়া রপ্তানির বিষয়ে বাংলাদেশ লাইভ অ্যান্ড চিল্ডফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আঞ্জুমান ইন্টারন্যাশনালের মালিক শিহাব উদ্দিন বলেন, এয়ারলাইনস এজেন্টরা প্যাকেজ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে রেখেছে। প্যাকেজ ব্যবস্থা বাতিল করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। পাশাপাশি তিনি রপ্তানি নীতিমালার সংশোধনের দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা কম ওজনের কাঁকড়া রপ্তানি করছেন। এটি রোধ করতে রপ্তানি নীতিমালা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করে সব সময় তদারক করতে হবে। পৃথিবীর কোনো দেশে এমনকি পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতেও কাঁকড়া রপ্তানির ওপর কোনো রাজস্ব কিংবা ভ্যাট আদায় করা হয় না। আর আমাদের কয়েক ধাপে কর দিতে হচ্ছে। কর মওকুফ করলে এই ব্যবসা আরও সম্প্রসারিত হবে।’