নতুন ব্যবসায় : মহিষের দুধের দধি
- শাইখ সিরাজ
প্রিয় পাঠক! গত সপ্তাহে এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে মহিষের বাথান, অজানা উপাখ্যান লেখাটি। ভোলার বাথানে রাখালের জীবন, বাঁশের কেল্লা নিয়ে লেখাটি প্রকাশের পর বহু পাঠকের সাড়া পেয়েছি। সবারই আগ্রহের জায়গা ছিল মহিষের দুধ থেকে তৈরি দধি বা দইয়ের প্রতি। সে প্রসঙ্গেই আজকের লেখাটি। শহুরে বাংলার ইট-কংক্রিটের অট্টালিকার ঝাঁক পেরিয়ে ফসলি খেতের বাংলাদেশ। বিশাল আবাদি প্রান্তর ছাড়িয়ে সবুজ বন-বনানী, তার পর দক্ষিণাঞ্চলের নদী-নালা। এসব দেখতে দেখতেই পৌঁছে গিয়েছিলাম ভোলায়। ভোলার নতুন নতুন কিছু উন্নয়ন উদ্যোগ ও কাজ দেখতে দেখতে পৌঁছে যাই মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের জন্মভিটা, সদর উপজেলার দক্ষিণ দীঘলদি গ্রামে। তখন মধ্যাহ্ন। গল্প আছে, ভোলায় গিয়ে এ পর্যন্ত দেশের বহু খ্যাতিমান মানুষ তোফায়েল আহমেদের বাড়িতে আপ্যায়িত হয়েছেন। এই তালিকায় খোদ বঙ্গবন্ধুও রয়েছেন।
যা হোক, একটি দুপুরে আমারও সুযোগ ঘটল তার আতিথেয়তা গ্রহণের। এর ভিতরেই আমার দৃষ্টি আটকে গেল দ্বীপজেলা ভোলার ঐতিহ্যে। যে পণ্যটি ভোলার ব্র্যান্ড। ভোলার মহিষের দই। যে কোনো অনুষ্ঠান, পার্বণে খাওয়া শেষে ভোলার মানুষ এই বাংলাদেশি ডেজার্ট দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করবেই। সে কথাই জানালেন তোফায়েল আহমেদ। এটি এমন এক ঐতিহ্য যা চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। মহিষের কাঁচা দুধের এই দই গুড়ের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়া এখানকার দীর্ঘদিনের সামাজিক রেওয়াজ। মহিষের দধির স্বাদ গ্রহণ করতে গিয়েই এই ঐতিহ্য তুলে ধরার প্রয়াস। দক্ষিণ দীঘলদি গ্রাম থেকে বেরিয়ে যাত্রা করলাম ভোলা শহরের দিকে। শহরের মুখেই চেয়ারম্যান লেন। আদর্শ দধি ভাণ্ডার। একেবারেই নিজস্ব মহিষ থেকে কাঁচা দধি দেখতে পেলাম দধি ভাণ্ডারে। বাথান থেকে প্রতিদিন ৬০ কেজি মহিষের দুধ আসে আর তা দিয়েই তৈরি হয় দই, জানলাম দধি ভাণ্ডারের মালিক আবদুল হাইয়ের কাছ থেকে। ৬০ কেজি দুধ থেকে ৩০ কেজি দই হয়। একটি বিশেষ স্থানীয় মাটি দিয়ে বানানো পাত্র, টালিতে দুধ পাতলেন আবদুল হাই। প্রতি টালিতে ২ লিটার করে দুধ জমা করা যায়। টালিতে দুধ পাতার প্রায় ১৮ ঘণ্টা পর দই পাবেন তিনি। কাঁচা দুধ থেকেই দই তৈরি হয় এখানে, যদিও মিষ্টি দই করতে কিছুটা পুরনো দই বীজ হিসেবে ব্যবহার করতে হয়। মহিষের দুধের দধিই এই দধি ভাণ্ডারের বিশেষত্ব। এর স্বত্বাধিকারী আবদুল হাই, বংশানুক্রমিকভাবে পারিবারিক ব্যবসা পরিচালনা করছেন। তার প্রতিদিনের কাজ বিশেষ পাত্রে দই বসানো আর বিক্রি।
এখানে এসে জানা গেল মহিষের দুধের দধি নিয়ে অনেক অজানা গল্প। আবদুল হাইয়ের বাবা প্রায় ৫০ বছর যাবৎ এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার মৃত্যুর পর ছেলে আবদুল হাই দায়িত্ব নিয়েছেন আদর্শ দধি ভাণ্ডারের। ২০-২২ বছর হলো এই প্রখ্যাত দধি ভাণ্ডার চালাচ্ছেন আবদুল হাই। সাধারণত বিশেষ কোনো উৎসবে সবাই এই দই খেয়ে থাকে। দুধ বা চিনি দিয়েই খেতে হয় এই দই। এ ছাড়া খেতে কেমন লাগবে সবার, তা আমার জানা নেই। টালিগুলো একটু লম্বাটে ধরনের। সাধারণত আমরা দই পাতিলেই দেখি। কিন্তু এই মহিষের দই ভোলা পেরিয়ে চলে যায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায়। আর সুতলি দিয়ে এই লম্বাটে ধরনের টালি পরিবহনের জন্য বেশ সুবিধাজনক বলেই জানালেন আবদুল হাই। দধি দুই প্রকারে বিক্রি হয় এখানে। এক বা একাধিক দইয়ের হাঁড়ি যেমন বিক্রি হয়, একইভাবে খুচরা হিসেবেও মানুষ এখানে স্বাদ নিতে আসেন কাঁচা দুধের সুস্বাদু দধির। এখানে দই পরিবেশনেও রয়েছে বিশেষত্ব। ২ চামচ দই বিক্রি হয় ২০ টাকায়। ২ চামচ দই চিনির সঙ্গে মিশিয়ে আর মুড়ি দিয়ে খেলাম। কিছুটা টক লাগলেও স্বাদ মোটেও খারাপ নয়। স্থানীয়রা বলছেন, প্রথম প্রথম টক লাগলেও ধীরে ধীরে এই দই খাওয়া এক রকমের অভ্যাসে পরিণত হয় এবং তখন বেশ ভালো লাগে এর স্বাদ।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা হলো কাঁচা দুধের দধির বিশেষত্ব, চাহিদাসহ নানা প্রসঙ্গে। ৫০ বছর ধরে এক স্থানীয় বাসিন্দা খেয়ে চলেছেন এই দই। তার মতো আরও অনেকেই। দেখলাম এখানকার সবাই এই দইয়ের ভক্ত এবং এই দই ব্যবহার হয় নানান অনুষ্ঠান, উৎসব, আপ্যায়ন আর পার্বণে। সবচেয়ে মজার বিষয় যখন সবাইকে হাত তুলতে বললাম এই বলে, কার কার বিয়েতে মহিষের দই খাওয়ানো হয়েছে, সবাই দেখলাম হাত তুলে বসে আছে। সবার বিয়েতেই খাওয়ানো হয়েছে মহিষের দই। মহিষের দই ছাড়া এ অঞ্চলে বিয়ের অনুষ্ঠান পূর্ণতা পায় না। মহিষের দইয়ের সংস্কৃতি এখানে পাকাপোক্ত। ঠিক এভাবেই বাঙালি জীবনের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে নানান উপকরণ। তা একেক এলাকার জন্য একেক রকম। ভোলায় যেমন কাঁচা দুধের দধি ছাড়া বিয়ে থেকে শুরু করে যে কোনো পারিবারিক প্রীতিভোজই যেন অপূর্ণ। ভোলা শহরের ঘোষপট্টি এলাকায় একবার না গেলেই নয়। ব্রিটিশ আমল কিংবা তারও আগে থেকে স্থানীয় ঘোষ সম্প্রদায়ের বাণিজ্যিক বিনিয়োগ আর সুস্বাদু দধি তৈরির ঐতিহ্য নিয়ে সরগরম এই ঘোষপট্টি— দইয়ের আসল আখড়া। দিনের পর দিন এই ঐতিহ্যের গুরুত্ব যেন বাড়ছে। এই ঘোষপট্টিতে কাঁচা দুধের দধি, গাভীর দুধের দধি, আর মিষ্টি সন্দেশের দোকান রয়েছে অন্তত ৫০টির মতো।
কৃষিভিত্তিক এই কুটিরশিল্প যুগ যুগ ধরে ভোলা ও আশপাশের জেলার মানুষের জীবনে অতুলনীয় মিষ্টান্ন আর দধির স্বাদ গ্রহণের সুযোগ দিয়ে আসছে। বাসুদেব ঘোষের খাঁটি দধি ঘরে ঢুকে পড়লাম আরও বিস্তারিত জানতে। বাথান থেকে দুধ চলে আসে বেলা ২টার দিকে। আমার সামনে দেড় মণ দুধ পাতলেন বাসুদেব ঘোষের খাঁটি দধি ঘরের কর্মচারী স্বপন। তিনি কাজ করছেন এখানে ১২ বছর হলো। প্রতিদিন ৬০ কেজি দুধ পাতেন তিনি। এই ষোষপট্টিতেই দীর্ঘ জীবন কাটিয়ে দিলেন কেশব চন্দ্র ঘোষ। তার কাছেও জানা গেল অনেক কথা। ভোলার মহিষের দধির শুরুটা ভোলার সৃষ্টির সময় থেকে বলে জানান কেশব চন্দ্র ঘোষ। তিনি আরও বললেন, ভোলার বাইরে এই মহিষের কাঁচা দুধের দই আর কোথাও নেই। জনপ্রিয়তা এবং স্বাদের বিচারে সেরা এই দই যা ভোলার অহংকার, বললেন কেশব। অনেকেই হয়তো জানেন না, মহিষের দুধে মিষ্টি হয় না। মিষ্টি করতে গাভীর দুধের প্রয়োজন হয়। আবার মহিষের দুধের দই জমাতে কোনো বীজের প্রয়োজন হয় না। এমনকি জ্বাল দিতে হয় না দুধ। সরাসরি কাঁচা দুধই জমে যায় দই হিসেবে। মহিষের দইয়ে মিষ্টি হবে না কারণ এর ফ্যাট অনেক বেশি। যে কারণে মহিষের দুধ থেকে যেখানে প্রায় ৩ কেজি ঘি হবে সেখানে গাভীর দুধ থেকে তৈরি হবে এর অর্ধেক পরিমাণ ঘি।
দূরদূরান্তের ক্রেতারা প্রতিদিন এই পট্টিতে আসছেন দধি কিনতে। প্রিয় পাঠক! ঘোষপট্টিতে দই বসানো বিকিকিনি শুরু করে সব কিছুর সঙ্গেই ঐতিহ্যের একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। একজন ক্রেতাকে দই কেনার পর যেভাবে পাত্রটি বেঁধে দেওয়া হয়, তারও যেন ভিন্ন একটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। দই যেভাবে জমে আছে টালিতে তা দেখেও বেশ অবাক হলাম। হাতের ওপর পুরো টালি উল্টে দেখলাম একটু দইও পড়ে যাচ্ছে না মাটির পাত্র থেকে। কাঁচা দুধের দধি নিয়ে আরও কিছু তথ্য জানালেন আরেকজন প্রবীণ ঘোষ রমাপ্রসাদ ঘোষ। রমা ঘোষ বলছেন, এখন বাথান থেকে কম দুধ আসে। এর কারণ চরে ঘাস কমে যাওয়ায় মহিষ তার পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছে না। তিনিও ওই একই কথা বললেন, যে কোনো অনুষ্ঠানে এই দই ছাড়া মেহমানদারি হয় না।
প্রিয় পাঠক! ভোলার মহিষের দধি বা দইয়ের মতো আমাদের দেশের বিভিন্ন জেলায় রয়েছে অনেক ধরনের পণ্য যা একেবারেই আমাদের নিজস্ব। যেমন বগুড়ার দই, টাঙ্গাইলের চমচম, কুমিল্লার রসমালাই, নাটোরের কাঁচাগোল্লা, রাজশাহীর রেশম, মুক্তাগাছার মণ্ডা, চাঁদপুরের ইলিশ— এগুলো যেমন একেকটি জেলাকে তুলে ধরে, তেমনি ভোলাকে তুলে ধরছে মহিষের কাঁচা দুধের দই। আমি আশা করি এই পণ্যগুলোকে ব্র্যান্ডের মর্যাদা দিয়ে আমরা সমগ্র একটি জেলাকে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে তুলে ধরতে পারি। সে ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতা দরকার। এতে শুধু একটি ব্র্যান্ডের ইতিহাস উঠে আসবে না, উঠে আসবে মানুষের জীবন-জীবিকা, সংগ্রাম আর সাফল্যের প্রেক্ষাপট।
লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। ইমেইল: shykhs@gmail.com