করোনার ভারতীয় ধরন কতটা ঝুঁকিপূর্ণ
ড. নাদিম মাহমুদ
করোনাভাইরাসের রূপ পরিবর্তনের খপ্পরে অসহায়ত্ব বাড়ছে বিশ্বে। রূপান্তরের সুবিধা নিয়ে ভাইরাসটি যেন ক্রমেই আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠছে। যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকার সার্স-কভ-২ ধরনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট। প্রতিদিন ভারতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। অবস্থা এমন হয়েছে যে, দেশটির হাসপাতালগুলোতে কভিড রোগীর স্থান হচ্ছে না, চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, অপিজেন সংকটে পথে-ঘাটেই মরছে মানুষ। ভয়াবহ এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশটির সরকারপ্রধান অনেক দেশের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
এরই মধ্যে বাংলাদেশ থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, জার্মানি, কানাডা, জাপানসহ অন্তত কুড়িটির অধিক দেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট বি.১.৬১৭ ছড়িয়েছে। অথচ শূন্য মাইল দূরত্বে অবস্থিত বাংলাদেশে এখনও তা পাওয়া যায়নি! প্রতিবেশী দেশের অসহায়ত্ব দেখার পর আমরা নিজেদের শঙ্কামুক্ত ভাবতে পারি? আমাদের চেয়ে শিক্ষা, গবেষণা ও চিকিৎসার মানের দিক থেকে এগিয়ে থাকা দেশটি যখন কভিড মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে, তখন বাংলাদেশ তাদের অবস্থানে গেলে কি পরিস্থিতি দাঁড়াবে? আমরা কি আদৌ ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট থেকে দূরে থাকতে পারব? যদি সেই ভ্যারিয়েন্ট দ্বারা সংক্রমণ ছড়ায়, তা মোকাবিলায় বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত?
বাংলাদেশ কেন ঝুঁকিতে
ভারতীয় বি.১.৬১৭ ধরনটি ২০২০ সালের ডিসেম্বরের গোড়ার দিকে জিআইএসএআইডি-এর ডাটা বেইজে জিনোম সিকোয়েন্স জমা দেওয়া হয়। কিন্তু ভারতে সংক্রমণের মাত্রা বাড়তে শুরু করে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময় থেকে। এর কয়েক মাস পর এ ধরনটি যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, কানাডা, জাপানসহ কুড়িটি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। যুক্তরাজ্যে সংক্রমণের গতি বাড়াচ্ছে এই ভ্যারিয়েন্টটি। যে দেশগুলোতে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট পৌঁছেছে সেইসব দেশ অন্তত কয়েক হাজার মাইল দূরে। বাংলাদেশ থেকে ভারতের দূরত্ব শূন্যের ঘরে। ফলে আমাদের দেশে যে ভ্যারিয়েন্ট পৌঁছতে পারে তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। যদিও আউটব্রেক ডট ইনফোর তথ্য মতে, গত এক মাসে বাংলাদেশে ৮৪ শতাংশ কভিড সংক্রমণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট ই.১.৩৫১ দ্বারা হয়েছে। এই ভ্যারিয়েন্টটির বাইরে হয়েছে মাত্র ১৬ শতাংশ।
ওয়েবসাইটের তথ্য, বাংলাদেশে লাইনেজে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট এখনও স্থান পায়নি। কিন্তু ধারণা করি, সীমিত সুযোগ-সুবিধার অভাবে আমরা এখনও ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের অস্তিত্ব শনাক্ত করতে পারিনি, যা খুবই জরুরি ছিল। বিষয়টি মাঠ পর্যায়ে যারা এই বিষয়ে কাজ করছেন তারা ভালো বলতে পারবেন। তবে যত আগে আমরা এই ভ্যারিয়েন্টটি ট্রেস করতে পারব ততই মঙ্গল। এটি আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে আর নটের মান কিছুটা বেশি, যার ফলে ট্রান্সমিশনের হার বেশি। সরকারের উচিত হবে, বেশি বেশি জিনোম সিকোয়েন্স করা, বিশেষ করে ভারতফেরত কেউ কভিডে আক্রান্ত হলে, তার নমুনার আরটিপিসিআর করার চেয়ে জিনোম সিকোয়েন্স করাটায় বুদ্ধিমানের কাজ হবে। সরকার যদি মনে করে, বাংলাদেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট নেই, গুরুত্ব না দেয়, তাহলে সেটা হবে বড় ভুল। একবারে ম্যাসিভ আকারে সংক্রমণের খবর ভারতও পায়নি। দেশটি এখন চার লাখের বেশি মানুষ প্রতিদিন কভিডে আক্রান্ত হচ্ছে। সেই কথা বিবেচনা করা আমাদের জরুরি।
যেভাবে প্রস্তুতি নেওয়া যেতে পারে
কভিডের সংক্রমণ ঠেকাতে সারা বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধানরা পরামর্শ নিচ্ছেন মহামারিবিদ, ভাইরোলজিস্ট, ইমিউনোলজিস্ট, বায়োকেমিস্টসহ বিভিন্ন একাডেমিশিয়ানের। যে দলে থাকছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান, চিকিৎসক, অর্থনীতিবিদ ও তরুণ গবেষকরা। তাদের পরামর্শে সরকারের সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। গবেষকদের কথা উপেক্ষা করে ভারত ইতোমধ্যে তার মাসুল দিতে শুরু করেছে। গত ২৯ এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে দেওয়া এক খোলা চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন ৫৮৮ জন বিজ্ঞানী। তবে ডিসেম্বরের শুরুতে ভ্যারিয়েন্ট ধরা পড়ার পরেই নানা সময়ে বিজ্ঞানীরা সরকারকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। মাস্ক ব্যবহার থেকে শুরু করে হাসপাতালগুলোতে অপিজেন সামগ্রী বাড়ানোর নির্দেশনা বারবার দিয়ে আসছিলেন। ন্যাশনাল টাস্কফোর্স ফর কভিড-১৯ কে অনেক গবেষক লকডাউনের মডেলও দিয়েছিলেন, কিছু তারা গুরুত্ব দেয়নি। যার ফলে মৃত্যুর মিছিল ঠেকাতে পারছে না দেশটি।
আমাদের দেশ যে ভারতের চেয়ে ব্যতিক্রম তা বলা যাচ্ছে না। এই দেশে মহামারির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত গবেষক ও বিজ্ঞানীদের পরামর্শ থেকে নেওয়া হয়েছে কিনা তা নিয়ে আমার সংশয় রয়েছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ভেস্তে গেছে একের পর এক লকডাউনের সুবিধা। যদিও গত এগ্রিলের লকডাউনে সংক্রমণ ৭০ দশমিক ৮৯ শতাংশ কমেছে। আমাদের উচিত সময়ক্ষেপণ না করে কার্যকর সিদ্ধান্ত নেওয়া। মহামারি ঠেকাতে সরকার প্রস্তাবনাগুলো দেখতে পারে। দেশের ভেতর ও দেশের বাইরে থাকা কেবল এই বিষয়ে অভিজ্ঞ গবেষক, বিজ্ঞানীদের নিয়ে শক্তিশালী টাস্কফোর্স গঠন করা উচিত। যে টাস্কফোর্সটিতে কয়েক স্তরে কমিটি থাকতে পারে। আমার বিশ্বাস, সরকারের আহ্বানে ছড়িয়ে থাকা আমাদের মেধাবীদের অনায়াসে এই কাজে লাগানো যেতে পারে।
বিশেষজ্ঞ কমিটির মতামতের ওপর ভিত্তি করে, সরকার সরাসরি তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। ভ্যাকসিন থেকে শুরু করে কভিড শনাক্তকরণের নির্দেশনা তাদের কাছ থেকে নেওয়া যেতে পারে। আমরা জানি, দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকার আরটিপিসিআরের মাধ্যমে কভিড শনাক্ত করছে। দেশে খুব কম সংখ্যক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা ভাইরাসটির ধরনের জিনোম সিকোয়েন্স করতে পারছে। জরুরিভিত্তিক বরাদ্দের ব্যবস্থা করে, দেশের কয়েকটি স্থানে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে জিনোম সিকোয়েন্স ল্যাব স্থাপন করতে পারে। ফলে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জিনোম সিকোয়েন্স করে ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত করে কন্টাক্ট ট্রেসিং করার সুযোগ পাবেন, তেমনি প্রাপ্ত ডাটা নিয়ে নতুন নতুন গবেষণাপত্র প্রকাশ পাবে। ফলে, আমরা একদিক থেকে ভ্যারিয়েন্টগুলোর অবস্থান জানতে পারব, অন্যদিকে শিক্ষা ও গবেষণায় আমাদের নতুন নতুন সম্ভাবনা তৈরি হবে। জেনোমিক নজরদারি না বাড়লে লকডাউনের কার্যকারিতা বাড়বে না।
সংক্রমণ রুখতে লকডাউনের কোনো বিকল্প নেই। তবে আমাদের মতো গরিব দেশে লকডাউন বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা অমূলক নয়। যে দেশের মানুষ, একদিন বাইরে না বের হলে, খেতে পারে না, সেই দেশে লকডাউনের ভ্যালু কম। তাই সরকারের উচিত হবে, সংক্রমণের হার বুঝে অঞ্চলভিত্তিক লকডাউন সচল রাখা। দেশের ভেতর অনেক বিজ্ঞানী এবং ইঞ্জিনিয়াররা নতুন ভেন্টিলেটর এবং কভিড শনাক্তকরণের নতুন নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবনে কাজ করছেন। তাদের সেই কাজ মূল্যায়নে বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি করে দেওয়া, যারা কাজগুলো সরাসরি মনিটর করবেন। অযাচিতভাবে দেশে সব স্থানে মিছিল-সমাবেশ, ওয়াজ মাহফিল বন্ধ রাখতে হবে। হাট-বাজারের প্রবেশ পথে পর্যবেক্ষক রাখা, যারা মাস্ক ব্যবহার থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে সহায়তা করবেন। সংক্রমণশীল অঞ্চলে ভ্রমণে কঠোরতা প্রয়োজন। ভারতের সংক্রমণ যখন ঊর্ধ্বমুখী ছিল তখনই আমাদের উচিত ছিল সীমান্ত বন্ধ রাখা। তবে সরকার দেরিতে হলেও তা বন্ধ করেছে। অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে সকল ধরনের যানের বিধিনিষেধ পালনে সচেষ্ট থাকা। করোনার সংক্রমণ এবং টিকা সম্পর্কিত গবেষণা বৃদ্ধি করা। যত টাকা খরচ করে আমরা টিকা কিনছি, তার চেয়ে কয়েকগুণ কম টাকা দিয়ে অন্তত ৩০টি আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাগার তৈরি করা যেত। টিকা ও ওষুধ গবেষণায় আমাদের স্বাবলম্বিতা বাড়াতে হবে।
এই মহামারি সহজে দূর হবে না। আমরা যদি এখনই উদ্যোগ নিই, তাহলে আমরা কয়েক বছর পর ঠিকই এর ফল পাব। নিজেরা এক সময় নিজেদের টেককেয়ার করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে পারব। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। কভিড-১৯ ঠেকাতে সারাবিশ্বে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। আমাদের দেশেও তা শুরু করা উচিত। সীমাবদ্ধতার মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত। সমন্বিত চেষ্টাই পারে আমাদের এই খাদ থেকে বের করতে। চাই, উদ্যোগ। চাই সদিচ্ছা।
ড. নাদিম মাহমুদ : গবেষক, ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান
সূত্র: সমকাল