নোবেল এবং নোবেল!
- আদিবা
একজন ১৭ বছরের পাকিস্তানী মেয়ে, নরওয়েজিয়ান অভিযাত্রী, তিব্বতী সন্ন্যাসী এবং আমেরিকান যাজকের মধ্যে কী কোনো মিল খুঁজে পান? যদি আপনি মিল পেয়ে থাকেন তাহলে বুঝতেই পারছেন আজকে কথা হবে নোবেল শান্তি পুরস্কার নিয়ে। বিশ্বের সকল শীর্ষ পুরষ্কারের মধ্যে নোবেল শান্তি পুরস্কার অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিদের সম্মানিত করেছে। চলুন, তাহলে জেনে নেওয়া যাক এই পুরস্কারের পিছনের গল্প।
নোবেলের যাত্রা বুঝতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ঠিক ১৮৮০ সালে। সুইডিশ রসায়নবিদ আলফ্রেড নোবেল সে সময়ে তার আবিস্কার ‘ডাইনামাইট’ এর সফল উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। মাত্র ৩০ বছরে তিনি অত্যন্ত সফল এবং ধনী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তবে অবাক করার বিষয় হচ্ছে তিনি কখনো বিয়ে করেননি। ১৮৯৬ সালে আলফ্রেড নোবেল যখন মারা যান, তার উইলে পাওয়া যায় একটি বিস্ময় যা এনেছে বিজ্ঞান, শান্তি এবং সাহিত্যে এক অন্যন্য পরিবর্তন। তিনি তার সকল সম্পত্তি পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, সাহিত্য এবং শান্তি—এই পাঁচটি বিভাগে যারা উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবেন তাঁদেরকে পুরস্কার হিসেবে দেওয়ার উইল করে যান। এই পুরস্কারগুলো বিজ্ঞানের প্রতি তার আজীবন অঙ্গীকার এবং তার সাহিত্যের প্রতি ভালবাসার চিত্র তুলে ধরেছে। কিন্তু শান্তি নিয়ে কেন তিনি পুরস্কার রাখলেন? অনেকেই ধারণা করেন যে, নোবেলের নাম যুদ্ধশিল্পে জড়িত ছিল বলে তিনি অনুতপ্তবোধ করেন। সেই অনুতাপ থেকেই তিনি শান্তির জন্য পুরস্কার রেখে গেছেন। যদিও এসকল মানুষের ধারনাই মাত্র, কারণ তিনি কখনও এমন কোনো কথা বলে যাননি। অনেকেই ধারণা করেন যে আলফ্রেড নোবেলের শান্তির প্রতি আকর্ষণের কারণ তার দীর্ঘদিনের বন্ধু বার্থা ভন সুতনা। ভন সুতনার ছিলেন একজন অস্ট্রিয়ান শান্তিবাদী। ভন সুতনার একজন আন্তর্জাতিক শান্তি আন্দোলনের নেতা ছিলেন এবং নোবেলের মৃত্যুর পর ১৯০৫ সালে প্রথম শান্তিতে তিনিই নোবেল বিজয়ী হন।
তিনটি মানদণ্ড বিচার করে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হতো। এই মানদণ্ডগুলো মূলত শান্তিকে সকলের কাছে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যই প্রচার করা হয়েছে। সবচেয়ে চমৎকার ব্যপার হচ্ছে নোবেল শান্তি পুরস্কার শুধু একজনের কাছেই যায় না। এখন পর্যন্ত নোবলে শান্তি পুরস্কারের এক-তৃতীয়াংশ এমন হয়েছে যে দুই থেকে তিনজন একসাথে এ পুরস্কার লাভ করেছেন। তাহলে আপনার মাথায় প্রশ্ন আসতেই পারে যে কীভাবে বাছাই করা হয় যে কারা পাবেন নোবেল পুরষ্কার? নোবেল ফাউন্ডেশনের মতে, একটি বৈধ মনোনয়ন আসতে পারে শুধুমাত্র ৩টি জায়গা থেকে। সেগুলো হলো জাতীয় পরিষদের সদস্য, রাজ্য সরকার এবং আন্তর্জাতিক আদালত। এখন আপনি চিন্তা করতেই পারেন যে কারা পেতে পারবে এই নোবেল পুরস্কার? আপনিও কী চাইলেই পেতে পারবেন? নোবেল পুরষ্কার মূলত জাতীয় পরিষদের বা আন্তর্জাতিক আদালতের সদস্য, সামাজিক বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন, আইনসহ আরও অনেক বিভাগের অধ্যাপকরা পেতে পারবেন। মজার তথ্য কিন্তু এখানেই শেষ নয়। আপনি কী জানেন কে মালালা ইউসুফজাইকে মনোনীত করেছিল? এটি মোটামুটি তেমন কেউই জানে না। মনোনয়ন সম্পর্কিত সকল তথ্যই প্রায় ৫০ বছরের জন্য লুকানো থাকে। মার্টিন লুথার কিংয়ের কথাই ধরুন। মার্টিন লুথার মূলত একটি কোয়াকার্সদের মাধ্যমে মনোনীত হয়েছিলেন যারা এর আগে নোবেল বিজয়ী ছিলেন এবং তাদের সাথে ছিলেন সুইডিশ পার্লামেন্টের ৮ জন সদস্য।
নোবেল বিজয়ের ক্ষেত্রে মূলত কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই, একজন হতে পারে আবার কোনো টিমও হতে পারে।
এবার সাহিত্যের কথায় চলে আসি। সাহিত্যের বিজয়ী যে একজন মানুষই হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার নির্বাচন একটি গোপন টিম করে থাকে হাতে পুরো এক বছর সময় নিয়ে। টিমে মূলত ৫জন সদস্য থাকে যাদের পরিচালনা করে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি। একটি ৩০০ জনের মনোনয়ন তালিকা মধ্যে প্রতিজনের প্রতিটি কাজ ঘেঁটে দেখা হয়। শেষে নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান অক্টোবরের দিকে বিজয়ীর নাম ঘোষণা করেন। প্রতি বছরের ১০ ডিসেম্বর, আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুবার্ষিকীতে নোবেল বিজয়ীদের হাতে পুরষ্কার তুলে দেওয়া হয়। পুরষ্কার হিসেবে দেওয়া হয় স্বর্ণপদক যেখানে লেখা থাকে, “Pro pace et fraternitate gentium”- “For the peace & brotherhood of men” (মানুষের শান্তি ও ভ্রাতৃত্বের জন্য)। এর সাথেও থাকে একটি ডিপ্লোমা এবং বড় আকারের পুরস্কৃত অর্থ। সম্প্রতি পুরস্কারের আর্থিক মূল্য ৪ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার হয়েছে যা হয় পান একজন, না হলে পায় পুরো টিম। বহু বছর ধরেই শান্তিতে নোবেল পুরষ্কারে প্রাধান্য পেতেন শুধুমাত্র ইউরোপীয় এবং উত্তর আমেরিকার ব্যক্তিরা। কিন্তু এখন এই চিন্তা ধারা উল্লেখযোগ্যভাবে বলদেছে যা আমরা সম্প্রতি দেখতে পাচ্ছি।
প্রতিটি নোবেল বিজয়ীর ক্ষেত্রে আমরা অনুপ্রাণিত হতে পারি তাদের অসাধারণ জীবন, তাদের চ্যলেঞ্জকে মোকাবেলার গল্পের মাধ্যমে।