আতঙ্কের আরেক নাম যানজট
- দিবাকার চৌধুরী
তিলোত্তমা নগরী ঢাকায় যেন টিকে থাকাটাই দায়। জীবনের তাগিদে প্রতিদিনই গ্রাম ছেড়ে শহরমুখী হচ্ছে মানুষ। মানুষের চাপে প্রাণের নগরী ঢাকা জৌলুস হারিয়েছে বহু আগেই। কোটি মানুষের জীবিকার সঞ্চার করা ঢাকা আজ তার নিজের জীবনই হারাতে বসেছে। বসবাসের অনুপযোগী শহরের তালিকায় ঢাকার নাম উঠেছে অনেক আগেই। নানা সমস্যায় জর্জরিত নগরীতে যানজট নতুন কিছু নয়! আর এই যানজটেই নাকাল পুরো নগরবাসী। সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে এই দুর্ভোগ থেকে রেহাই মেলেনি শিক্ষার্থীদেরও।
ঢাকা শহরের এই যানজট প্রতিদিন গড়ে ৪২ হাজার কর্মঘন্টা নষ্ট করছে। শিক্ষার্থীরা এই যানজটের কবলে পড়ে ক্লাসের সময়ে শ্রেণীকক্ষে উপস্থিত থাকতে পারছে না। মাঝে মাঝে তো অনেকে আবার ঠিক সময়ে পরীক্ষার হলে উপস্থিত হতে পারছে না। এছাড়াও তীব্র গরমে যানজটে বসে থেকে মানসিক ও শারীরিক বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে কোমলমতি এসব শিক্ষার্থীরা। দীর্ঘক্ষণ যানজটে আটকে পড়ে থাকার কারণে ক্লাসে অমনোযোগী থাকতে দেখা যায় বিভিন্ন শিক্ষার্থীদের। অনেক সময় তো আবার ক্লাসে উপস্থিতির প্রতি তৈরি করছে তীব্র উদাসীনতা। ভবিষ্যতে এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে পুরো জাতির উপরে, কারণ একজন শিক্ষার্থী আগামী-দিনের সম্ভাবনা। তাদের হাত ধরেই বাংলাদেশ একদিন পৌঁছাবে সফলতার চূড়ান্ত শিখরে।
যানজটের কারণে নিজেদের শিক্ষাজীবন থেকে মূল্যবান সময় হারিয়ে হতাশা বাসা বাঁধছে শিক্ষার্থীদের মনে। এমনই এক ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী বলেন, “আমি যাত্রাবাড়ী থেকে ধানমন্ডি ২৭ নম্বর আমার বিশ্ববিদ্যালয় আসি, যেখানে আমার আসতে ৩০ মিনিট সময় লাগার কথা সেখানে যানজটের কারণে আমার ব্যয় হচ্ছে দু’ঘণ্টার উপর। এই অসহনীয় যানজট আমাকে প্রতিদিন শারীরিক ও মানসিকভাবে নাজেহাল করছে”।
রাজধানী ঢাকার যানজটের মূল কারণ হচ্ছে অপরিকল্পিত নগরায়ন। ঢাকা শহরের রাস্তায় যে পরিমাণ গাড়ি চলার কথা, চলছে তার কয়েক গুণ বেশি। ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা দিনকে-দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যানজটের পিছনে অধিকাংশরাই দায়ী করছে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার বাড়ানোকে।
গাড়ির চাপ থাকা সত্ত্বেও রাজধানীর ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা হয় সেই সনাতন পদ্ধতিতে। পুরো বিশ্ব যখন সিগন্যাল বাতির সাহায্যের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করে সেখানে বাংলাদেশ হাঁটছে উল্টো পথে। তবে এর পেছনে মূল কারণ হচ্ছে এতে চালক ও সাধারণ মানুষের ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতা। কোটি কোটি টাকার ট্রাফিক বাতি অকেজো হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রয়েছে সিগন্যালগুলোতে।
চালকদের অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা ট্রাফিক জ্যামের অন্যতম একটি কারণও বটে। রাস্তার মাঝে প্রায়ই চোখে পড়বে ওভার টেকিং এর প্রবণতা এবং হরহামেশা যাত্রী তোলা এবং নামানোর চিত্র যেন এই সমস্ত বাস চালকদের নিত্যদিনের অভ্যাস।
এসবের মাঝে রয়েছে মরার উপর খরার ঘা; উন্নয়ন কাজের নামে নগরজুড়ে প্রতিনিয়ত খোঁড়াখুঁড়িতে ব্যস্ত বিভিন্ন সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। যার ফলে রাস্তায় একটি বড় অংশ বন্ধ থাকায় তৈরি হচ্ছে তীব্র যানজট। ফার্মগেট, মোহাম্মদপুর ও রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে অসাধু ব্যবসায়ীদের রাস্তা ও ফুটপাত দখল করে হরেক রকমের পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসে থাকতে। মোহাম্মদপুরের বড় একটি অংশজুড়ে রাস্তার একটি লেন দখল করে অসাধু ব্যবসায়ীরা চালিয়ে যাচ্ছে রমরমা ব্যবসা। স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ও অসাধু নেতাদের ছত্রছায়ায় ব্যবসা পরিচালনা করছে এসব ভ্রাম্যমান ব্যবসায়ীরা। যার ফলে ভোগান্তির শেষ হচ্ছে না সাধারণ জনগণের।
রাজধানীতে উল্টো পথে গাড়ি চালানো ছিল একসময় নিত্যদিনকার চিত্র। এখনো সেই চিত্র হরহামেশা দেখা না গেলেও, তা যে একেবারেই নেই তা কিন্তু নয়! এখনো মাঝে মাঝে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে মাঝে মাঝেই উল্টো পথে গাড়ি নিয়ে চলাচল করার রেওয়াজ আছে। যার ফলে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় সাধারণ মানুষকে।
তবে সবচাইতে অবাক করা তথ্য হচ্ছে করোনা পরবর্তী সময়ে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় গুলো খুলে দেওয়ার পরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোর সাথে ব্যক্তিগত গাড়ির চাপ লক্ষ করা গেছে। অনেক সময় তো রাস্তা বন্ধ করেই শিক্ষার্থীদের বহনকারী ব্যক্তিগত গাড়িগুলো রাস্তায় পার্কিং করা হয়।
এসব শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা বলছে, স্কুল কর্তৃপক্ষ যদি শিক্ষার্থীদের শতভাগ ট্রান্সপোর্ট সুবিধা দিতে পারতো তবে তারা ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার থেকে বিরত থাকতেন।
সাধারণ জনগনের গলার কাঁটা হিসেবে থাকা এই যানজট নিরসনে ইতিপূর্বে অনেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও তা যানজট নিরসনে তেমন কোন ভূমিকা রাখতে পারেনি, বরং প্রতিবছর ঢাকা শহরের যানজট বেড়েছে কয়েক গুণ। ৮১৬ বর্গমিটার ঢাকার শহরে বাস করে দেড় কোটিরও বেশি মানুষ আর এই মানুষগুলোর যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে রাজপথে গাড়ি রয়েছে ১৭ লাখেরও বেশি।
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালের ঢাকা শহরে মোট নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা ছিল ৫ লাখ ৯৩ হাজার ৭৭ টি । এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ১৩ হাজার ৫৫৪ টিতে। যার মধ্যে মোটর সাইকেলের সংখ্যা ৮ লাখ ৪৯ হাজার ৩৩৫ টি, যা মোট গাড়ির ৪৯ শতাংশ। প্রাইভেট-কারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৮ হাজার ৮৬০ টিতে, যা মোট গাড়ির ১৮ শতাংশ। অন্যদিকে, বাসের সংখ্যা মাত্র ৩৬ হাজার ৯৬৭ টি, যা মোট গাড়ির ২ শতাংশ। দেশকে যদি বিকেন্দ্রীকরণ করা না হয় তবে রাজধানীর এই যানজট তীব্র থেকে তীব্রতর হবে বলে জানিয়েছেন বিশিষ্টজনরা।
নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব এর মতে, গণ-পরিবহন ভিত্তিক ও পথচারীবান্ধব একটি নগরীর সম্ভাবনাকে গলার টুটি চিপে ধরে মোটরসাইকেল ও ব্যক্তিগত গাড়ি বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে নগরীকে আজকের যানজটের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এই নগরীকে আবারও ঢেলে সাজানো যেতে পারে যদি রাজনৈতিক স্বদিচ্ছা তৈরি হয়।
তিনি বলেন, “পাবলিক বাস গুলোর জন্য যদি আলাদা একটি লেন বরাদ্দ করা যায় তবে নগরীর যানজট কিছু অংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। যানজটের পেছনে সমাজের সাধারণ মানুষকে দায় দিতে আমি রাজি নই। মানুষকে যদি দায়ী করতে হয় তবে সরকার কেন আছে! ট্রাফিক সিস্টেমের পরিবর্তনের মাধ্যমে যানজট নিরসন করা সম্ভব। উন্নত বিশ্ব যেরকম সনাতন পদ্ধতি ছেড়ে ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে যানজট নিরসন করেছে বাংলাদেশকে সেই পথে এগোতে পারে।
তিনি আরও বলেন, “সম্প্রতি রাইড শেয়ারিং-এর নামে এক নৈরাজ্য গড়ে তোলা হয়েছে রাজপথ জুড়ে। ব্যক্তিগত গাড়ির পাশাপাশি এই মোটরসাইকেল ঢাকা শহরের যানজটের পিছনে বড় মাপে দায়ী। এগুলো সরিয়ে একটি সুশৃঙ্খল যাত্রীবান্ধব গণপরিবহন ব্যবস্থা চালু করতে পারলেই যানজট থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব। সমাজের সকল স্তরের মানুষ যাতে একটি নির্দিষ্ট গণপরিবহন ব্যবহারের দিকে ধাবিত হয় সেজন্য গণপরিবহন কে আধুনিকায়নের পাশাপাশি ঢেলে সাজাতে হবে তাতে গণপরিবহনের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে।”
সড়কগুলোতে শৃঙ্খলা ফেরাতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে ট্রাফিক আইন মেনে চলেই, কেবল এই দুর্বিষহ যানজট থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। সরকারের সঠিক নজরদারি ও ফুটপাত দখল করে ব্যবসা করা অসাধু দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান তৈরি করে এবং ট্রাফিক আইন ভঙ্গকারীদের জেল জরিমানার আওতায় আনার পাশাপাশি শহরকে বিকেন্দ্রীকরণ করলে মানুষের চাপ কমে যাবে রাজধানী ঢাকা থেকে; এমনটাই মনে করছেন বিশিষ্টজনেরা। আর এই পদক্ষেপগুলোর সুফল লাভ করবে সাধারণ মানুষ।