ইন্দ্রজিৎ সরকারের ‘এইসব কাছে আসা’
- শিল্প-সাহিত্য ডেস্ক
ইন্দ্রজিৎ সরকারের উপন্যাস ‘এইসব কাছে আসা’ পাঠ শেষে প্রথম যে কথাটি মনে আসে তা হচ্ছে—কী অর্থ বহন করে এইসব কাছে আসা? লেখক এই উপন্যাসে কতিপয় মানব-মানবীর কাছে আসার গল্প শুনিয়েছেন, যে কাছে আসাগুলো দিনশেষে নিরর্থক মনে হয়। মনে হয়, এরা সুখের লাগি প্রেম খোঁজে সুখ মেলে না…।
মানুষ মূলত সুখ অন্বেষণকারী প্রাণী। এ তার চিরন্তন স্বভাব। সুখের খোঁজে সে ইতিউতি বিভিন্ন জায়গায় যায়। ঘাটে ঘাটে নাও ভিড়ায়। কিন্তু সবসময় যে সুখ মেলে তা নয়। এখানে মানে এই গল্পে, এই উপন্যাসে সুকণ্যা, সৌরভ, কবির, নন্দিতা ও সজল নামে পাঁচটি চরিত্র রয়েছে যারা সুখ তালাশকারী। ঘটনা পরম্পরায় নানা কারণে তাদের মনে হয়, অথবা তারা মনে করতে বাধ্য হয়ে যে তারা কেউ সুখী নয়। তারা পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে যে সম্পর্কের দ্বারা যুক্ত সেই সম্পর্ক তাদেরকে সুখ এনে দিতে পারছে না।
জীবন বড় যাতনা উগরে দেয় এই পাঁচজন মানুষের ঘরে, বারান্দায়, জানালায়, কার্নিশে, বিছানা, বালিশে প্রতিদিন। তাই তারা অন্য সম্পর্কে জড়ায়, যে সম্পর্ক সমাজের চোখে ‘অবৈধ‘। সমাজ যে সম্পর্কের নাম দিয়েছে অবৈধ, সেই সম্পর্ক কী শেষ অব্দি সুখ দিতে পেরেছিল সুকন্যা-সৌরভ-কবির-নন্দিতা-সজলের জীবনে? এই একটি প্রশ্নই পাঠককে টেনে নিয়ে যায় উপন্যাসের শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত।
ইন্দ্রজিৎ সরকার পেশায় সাংবাদিক। তার লেখায় রয়েছে বিবিধ মুন্সিয়ানা। তিনি প্রতিটি অধ্যায়ের শেষেই এমন এক শ্বাসরুদ্ধকর প্রশ্ন রেখে যান, যা পাঠককে বাধ্য করে পরবর্তী অধ্যায়ে যেতে। পাঠককে পরের অধ্যায় পড়তে বাধ্য করার এমন নির্মম ক্ষমতা তার মত অপরাপর তরুণ লেখকদের মধ্যে খুব কম দেখেছি। এ আমার দৃষ্টিক্ষীণতা নাকি বর্তমান তরুণ লেখকদের লেখার দীনতা সেটা অবশ্য ভিন্ন বিতর্ক। সে বিতর্কে না গিয়ে শুধু এটুকু বলতে চাই, ইন্দ্রজিৎ সরকারের কলমে এক মোহিতকরণ জাদু রয়েছে। সেই জাদুবলে তিনি পাঠককে মোহিত করে রাখতে পারেন। তার ভাষা অসম্ভব মিষ্টি। এই উপন্যাসে তিনি অনেক তিক্ত সত্যই অনেক মিষ্টি করে বলেছেন। কখনো কখনো মনে হয়েছে তিনি সমাজের গালে, মানুষের বিবেকের গালে মিষ্টি করে থাপ্পর দিয়েছেন, যেমন দুষ্টু প্রেমিকের গালে মিষ্টি করে থাপ্পর দেন প্রেমিকাগণ এবং বলেন—যাহ দুষ্টু!
ইন্দ্রজিৎ কেন কড়া করে থাপ্পর না দিয়ে মিষ্টি করে থাপ্পর দিলেন, সে নিয়েও হতে পারে বিতর্ক, যেহেতু আমরা বিতর্কপ্রবণ জাতি। কিন্তু বিতর্ক পরিহার করে আমাদেরকে বরং যে বিষয়ের প্রতি নজর দেওয়া উচিত সেটি হচ্ছে, ইন্দ্রর বার্তা। ইন্দ্রজিৎ এই উপন্যাসে যে বাস্তবতা তুলে ধরেছেন এবং যে বার্তা দিতে চেয়েছেন সেটি আমরা বুঝতে পারছি কি না? যদি বুঝতে পারি, তাহলেই লেখকের শ্রম স্বার্থক হবে বলে মনে করি। কারণ লেখকের কাজ মাস্টারি করা নয়, বরং সমাজের চিত্র, সময়ের বাস্তবতা দর্পনের মতো তুলে ধরাই তাঁর কাজ। লেখকের কাজ ঈশ্বরের মতো সর্বজ্ঞ দৃষ্টি নিয়ে দেখে যাওয়া এবং ধারাভাষ্যকারের মতো নিঁখুতভাবে বয়ান করে যাওয়া। ইন্দ্রজিৎ সেই কাজ অতিশয় দক্ষতার সঙ্গে করতে পেরেছেন, তা মাথার দিব্যি দিয়েই বলা যায়।
লেখক উপন্যাসটির ধারনা পেয়েছেন বিবিসির হিন্দি সংস্করণে ‘হার চয়েস’ নামের একটি ধারাবাহিক প্রতিবেদন থেকে। প্রতিবেদনগুলো ভারতীয় নারীদের নিয়ে। ইন্দ্র ভেবেছিলেন, বাংলাদেশে এমন ঘটনার প্রচলন সম্ভবত এখনো শুরু হয়নি। কিন্তু একটু খোঁজ-খবর নিতেই জানতে পারলেন, তার পরিচিতা এবং বন্ধুভাবাপন্ন চারজন নারীর জীবনেই্ ঘটছে এমন ঘটনা। ঘটনাগুলো যেন বিবিসির প্রতিবেদনকেও হার মানায়। ইন্দ্র ভাবলেন, একটা আস্ত উপন্যাসই লেখা যায় এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে। তারই ফসল এই ‘এইসব কাছে আসা’।
‘এইসব কাছে আসা’ একদিকে যেমন উপন্যাস পঠনের স্বাদ দেয়, তেমনি প্রতিবেদন পাঠেরও আনন্দ দেয়। ইন্দ্র একজন সচেতন সাংবাদিক বলেই হয়ত সিএনজিচালিত অটোরিকশা শব্দটিও তার নজর এড়ায় না। এখানে রয়েছে ভ্রমণ কাহিনী পাঠেরও আনন্দ। লেখক সাজেক, লাউয়াছড়া, সাতছড়ি ইত্যাদি পর্যটন এলাকার যে বর্ণনা দিয়েছেন তা এক কথায় অসাধারণ। এবং ইন্দ্রজিৎ সরকার শুধু জীবন ও জগতের সত্যই নয়, মাঝে মাঝে দার্শনিক সত্যেরও মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন পাঠককে।
একস্থানে লেখক বলছেন, ‘কষ্টের কথা বললে কষ্ট কমে না, বরং যতবার কষ্টের কথা বলি ততবার মন খারাপ হয়’। অথচ চিরকাল আমরা জেনে এসেছি, কষ্ট ভাগ করলে কমে। কষ্ট অন্যের কাছে বললে কষ্ট লাঘব হয়। এই চিরন্তন দার্শনিক সত্যকে চ্যালেঞ্জ করেছেন লেখক ইন্দ্রজিৎ। সত্যিকারের বড় লেখকরা তো চিরকাল এমনটাই করে এসেছেন।
তবে কোথাও কোথাও গল্পের বর্ণণা অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। ইকবাল ও নদীর প্রেমের বর্ণনা অনর্থক পৃষ্ঠা বাড়িয়েছে বলে মনে হয়েছে আমার কাছে।এক ঘেয়ে ও বিরক্তিকর এই প্রেম। সেই তুলনায় সজল ও নন্দিতার প্রেম অবশ্য বেশ কৌতুহল উদ্দীপক।কিছু কিছু দার্শনিক উক্তি রীতিমতো হৃদয়ে গেঁথে যাওয়ার মতো। যেমন, জীবন পিছনে হাঁটে না, সামনে এগোয়।
ফেইসবুকে সম্ভবত বইটির লেখক অথবা প্রকাশক ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, যারা উপন্যাসটি পড়ে মন্তব্য জানাতে আগ্রহী তাদের মধ্যে লটারি করে কয়েকজনকে বইটি উপহার দেওয়া হবে।আমি সেখানে নিজের আগ্রহের কথা জানিয়েছিলাম। তার কিছুদিন পর লেখকের তরফ থেকে ফোন পেলাম। বললেন, বইটি আমার ঠিকানায় পাঠিয়েছেন তিনি। সে সব বেশ ক’মাস আগের কথা। মাঝখানে পেরিয়ে গেছে কতগুলো মাস! জীবনের নানান উষ্ঠা-লাত্থি খেতে খেতে সময় করতে পারছিলাম না এত অনিন্দ্য উপন্যাসটি পড়ার। অবশেষে গতকাল জোর করেই পড়তে ধরলাম এবং এক রাতেই শেষ করতে বাধ্য হলাম।নির্ঘুম এই পাঠাভিজ্ঞতা এক কথায় অসাধারণ।