যদ্যপি আমার গুরু : এক গুরুর প্রতি শিষ্যের শ্রদ্ধা
- সুরাইয়া সুলতানা রিয়া
আহমদ ছফা। বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য নিয়ে যারা কিছুটা হলেও ধারণা রাখেন তাদের কাছে অতি পরিচিত এক নাম। বহু সমালোচকের মতে, মীর মশাররফ হোসেন এবং কাজী নজরুল পরবর্তী-যুগে বাংলা ভাষার অন্যতম সেরা গদ্যলেখক তিনি। তবে তিনি ছিলেন বহুমাত্রিক লেখক। শোষিত মানুষদের পক্ষে কথা বলে গেছেন পুরোটা জীবন। তিনি যেমন প্রতিবাদী ছিলেন, ছিলেন তেমনি মানবিক। মাত্র গোটা বিশেক বইয়ের মাধ্যমে বঙ্গীয় সাহিত্যে নিজের নামকে পাকাপোক্তভাবে স্থাপন করেছেন তিনি।
‘সূর্য তুমি সাথী’ এই উপন্যাসের মাধ্যমেই লেখালেখির জগতে পদার্পন তাঁর। মাত্র কয়েকখানা বই লিখেই পাঠকের মনে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। তাঁর লেখার বেশিরভাগই বিশ্লেষণধর্মী। ছফার অন্যতম একটি বই হচ্ছে ‘যদ্যপি আমার গুরু’।
‘যদ্যপি আমার গুরু’ বইটিকে বলা যেতে পারে ছফার সবচেয়ে মূল্যবান রত্ন। বইটি একটি স্মৃতিচারণমূলক বই। ইংরেজি ‘আইডল’ শব্দটার সঙ্গে এই প্রজন্মের প্রায় সকলেরই পরিচয় আছে। খাস বাংলায় যাকে আমরা বলি ‘গুরু’। পৃথিবীর বহু খ্যাতনামা ব্যক্তিও জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে কাউকে না কাউকে গুরু মেনেছেন। আহমদ ছফাও তার ব্যতিক্রম নন।
স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপকের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। সেই তালিকারই সবার উপরের দিকে যার নাম থাকবে তিনি হলেন অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক। কর্মজীবনের পুরোটা সময়ই কাটিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকতা করে। গভীর প্রজ্ঞা এবং পাণ্ডিত্যের কারণে সকলের কাছে পরিচিত ছিলেন ‘বাংলার ডায়োজিনিস’ হিসেবে। উনসত্তরের উত্তাল সময়ে বাংলা একাডেমির অধীনে পিএইচডি রিসার্চের সুবাদে অধ্যাপক রাজ্জাকের সঙ্গে পরিচয় ঘটে সেই সময়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী আহমদ ছফার। প্রথম দেখাতেই অসাধারণ দর্শন-জ্ঞানের অধিকারী অধ্যঅপক রাজ্জাককে নিজের গুরু হিসেবে গ্রহণ করে নেন ছফা। সেই গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক অটুট ছিলো জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। দীর্ঘ সাতাশ বছর ধরে অধ্যাপক রাজ্জাকের সঙ্গে থেকেও ছফার কাছে তিনি পুরনো হননি। বরং রোজই প্রফেসর রাজ্জাকের সান্নিধ্য নতুনের মতো মনে হতো তাঁর। বলা যেতে পারে অধ্যাপক রাজ্জাকের সান্নিধ্য লেখকের জন্য ছিলো একটা শিক্ষাসফরের মতো। এই মহান ব্যক্তির কাছ থেকে বহু শিক্ষা লাভ করেছেন লেখক ছফা।
প্রফেসর রাজ্জাকের জন্ম প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে এবং মৃত্যু গত শতকের একদম শেষভাগে। খুব কাছ থেকেই ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন হতে শুরু করে গণতান্ত্রিক মুক্তির আন্দোলন পর্যন্ত প্রায় সকল রাজনৈতিক পট পরিবর্তন নিজ চোখে দেখেছেন। নিজ হাতে কোনো বই লিখে যাননি। চেনা-পরিচিত মানুষজনের সঙ্গে অধ্যাপক রাজ্জাকের আলাপচারিতাই তাঁকে চেনার একমাত্র মাধ্যম। সেই কাজটাই যদ্যপি আমার গুরুতে নিষ্ঠার সঙ্গে তুলে ধরেছেন আহমদ ছফা। লেনিনের লাল-বিপ্লব কিংবা কিসিঞ্জারের কূটচাল, বাংলার শিক্ষাব্যস্থা বা ধর্ম—হেন বিষয় নেই যা সম্পর্কে অধ্যাপক রাজ্জাকের সুচিন্তিত কোনো মতামত ছিলো না। সাধে তো আর সক্রেটিসের সাথে তুলনা করা হতো না তাঁকে! জীবনকে সর্বদা পরখ করেছেন স্বজাত্যবোধীয় আতশকাচের নিচে রেখে। বইয়ের প্রতিটি পাতায় সেই কথাটাই যেন বারবার উঠে এসেছে। ছয় দফা আন্দোলনের কথা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু এই ছয় দফা’র যে অন্যতম রূপকার ছিলেন একসময়কার কট্টর মুসলীম লীগার অধ্যাপক রাজ্জাক এ কথা আমরা ক’জনই জানি?
একাধারে কলকাতা এবং বাংলার সকল গণ্যমান্য চরিত্রকে তুলে ধরা হয়েছে এই বইয়ে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল থেকে শুরু করে শেখ মুজিবুর রহমান কিংবা বিখ্যাত দাবাড়ু নিয়াজ মোর্শেদ থেকে শুরু করে শিল্পী সুলতান, এছাড়াও কাজী মোতাহার হোসেনের মতো মানুষেরাও উঁকি দিয়েছেন এই বইয়ের পাতায়।
যদ্যপি আমার গুরু বইটি অধ্যাপক রাজ্জাকের সেই অদেখা ভুবনকেই জানার এক নিমিত্তমাত্র। চিরাচরিত ঢাকাইয়্যা ভাষার মাঝে কীভাবে এক দার্শনিক লুকিয়ে থাকতে পারে তা হয়তো আজ কল্পনা করাও দুঃসাধ্যপ্রায়। একজন গুরুর প্রতি তার শিষ্যের শ্রদ্ধাঞ্জলির প্রগাঢ়তা দেখতে পাওয়া যায় বইটিতে।