‘দীপাবলি’ এক অনুপ্রেরণার নাম
- সুরাইয়া রিয়া
সমরেশ মজুমদার। নামটা বই পড়ুয়াদের সকলেরই বেশ জানা। ১৩৪৮ সনের ২৬শে ফাল্গুন জন্ম এই কালজয়ী ঔপন্যাসিকের। কলকাতা তথা বাংলার সর্বকালের অন্যতম সেরা লেখক তিনি। তারই লেখা উপন্যাস ‘সাতকাহন’ এর এক অনবদ্য চরিত্র হচ্ছে ‘দীপাবলি’।
দীপাবলির সাথে লেখক আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন এক ভয়ঙ্কর মেঘ করা সন্ধ্যের মুখে। কিশোরী দীপা ভয় ভয় মুখ নিয়ে দাড়িয়ে আছে কদম গাছের নীচে। ভয়ের কারণ হলো সন্ধে নেমে এসেছে কিন্তু এখনো সে বাড়ি ফিরতে পারেনি। মায়ের বকুনি, ঠাকুমার চোখরাঙানির কথা মনে পড়েই ভয় পাচ্ছে সে।
অদ্ভুত চাঞ্চল্যতা আর প্রানশক্তিতে ভরা একটি মেয়ে সে। মায়ের পিটুনি, ঠাকুমার বকুনি উপেক্ষা করে পাখির মতো উড়ে চলা, নদীর মতো বেয়ে চলা স্বভাব তার। জঙ্গল, নদী, চা বাগান, খেলার মাঠ এসবই তার আপন বেশি।
নারীকেন্দ্রিক গল্প নিয়ে লেখা এই উপন্যাসটিতে সমাজের অনেক পিছিয়ে পড়া অবস্থা থেকে একজন মেয়ের উপরে উঠে আসার সংগ্রামের কাহিনি তুলে ধরা হয়েছে। জলপাইগুড়ির চা বাগানে বড় হওয়া এক কিশোরী দীপাবলি, যার জীবনে রয়েছে অসংখ্য ঘাত-প্রতিঘাতের গল্প। দীপার পরিবারের একমাত্র জীবিকার উৎস হচ্ছে চা বাগান। সহজ-সরল জীবন তাদের। আধুনিকতার ছোঁয়া তখন পূর্ণভাবে লাগেনি এমন একটি জায়গাতেই বেড়ে ওঠা এই মেয়ের।
দীপার দুজন বন্ধু ছিল। বিশু আর খোকন। মেয়ে কোনো বন্ধু ছিল না দীপার। এ নিয়েও মা ঠাকুমার আদেশ নিষেধের শেষ ছিল না। তাই দীপা নিজেই সবসময় নিজেকে প্রশ্ন করতো পরিবারের লোক কেন তাকে বিশু আর খোকনের সাথে মিশতে দেয় না? বিশু আর খোকন যদি মাছ ধরতে পারে, ফল পারতে পারে তাহলে সে কেন পারবে না? বিধবারা কেন আমিষ খেতে পারবে না? এসব ভাবতে ভাবতেই জীবন তাকে নতুন মোড়ে এনে দাঁড় করালো, কিন্তু উত্তর মিললো না তার কোনো প্রশ্নেরই।
সাহসী, সংগ্রামী প্রতিমার মতো সেই মেয়ে দীপা, আর শুরু হলো তার জীবন চালচিত্রের একের পর এক বর্ণাঢ্য ছবি। ভাগ্যদেবতা খুব একটা সুপ্রসন্ন ছিলো না দীপার প্রতি। এজন্যই নিরবচ্ছিন্নভাবে এই মেয়ের পাওয়া হয়নি কিছুই। একচোখা ধমার্ন্ধ থেকে শুরু করে সমাজ, পরিবার সকলের সাথেই যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হয়েছে তাকে। বেঁচে থাকার জন্য, সমাজে নিজের জায়গা তৈরি করে নেবার জন্য নিজের সাথেও লড়েছে বহুবার। নিজ যোগ্যতায় অর্জন করে নিয়েছিলেন আয়করের চাকরি। বেছে নিয়েছিলেন জীবনসঙ্গীও। তবুও যুদ্ধ থামেনি তার। বরং জীবন কঠিন থেকে কঠিনতর হতে শুরু করেছিল দীপার।
আত্নমর্যাদা ও আদর্শের জন্যও লড়ায়ে নামতে হয় তাকে। কাছের মানুষগুলোর স্বার্থের জন্য রঙ বদলানো চেহারা বহুবার ক্ষতবিক্ষত করেছিল তার কোমল হৃদয়কে। তবুও সে তার পথ থেকে সরে আসেনি। বরং সেসব মানুষের সঙ্গ ছেড়েছে সে। সমাজ, সংসারের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে মানুষের মতো করে বেঁচে থেকেছে দীপা। এতো যুদ্ধ, এতো সংগ্রাম সব কিছুর পরেও অবশেষে কি পেয়েছে সে জীবন থেকে?
ওই যে আগেই বললাম ভাগ্যদেবতা সুপ্রসন্ন ছিলো না তার প্রতি। তাই তো একাই জীবন পার করতে হয়েছে তাকে।
নিকষ কালো অন্ধকারে নিত্য আলো খুঁজতে থাকা, মেয়েদের উপর সমাজ আরোপিত নানা বিধিনিষেধের প্রতি আঙুল তোলা, মেয়েদের জন্য তৈরী পদে পদে কঠোর অনুশাসনকে তোয়াক্কা না করা, ব্যর্থতা-কষ্টানুভূতিকে ছাড়িয়ে জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্মান অর্জন করা মেয়েটিই হচ্ছে দীপাবলি। এজন্যই তাকে বলা হয়ে থাকে সকল মেয়েদের অনুপ্রেরণা।
কে এই দীপাবলি, এই প্রশ্নের জবাবে লেখক বারবারই বলতেন তিনি যে পাড়াতে থাকতেন সেখানেই থাকতো এই দীপাবলি। পুরুষের চেয়ে নারী যে কোনো অংশেই কম নয় সেটাই লেখক তুলে ধরেছেন এই উপন্যাসে। একটা মেয়ে যে চাইলে শূন্য থেকে শিখরে পৌঁছাতে পারে তারই মোক্ষম উদাহরণ হচ্ছে দীপাবলি।