শান্তি সম্প্রীতির চাকমা সম্প্রদায়
- সানজিদা হোসেন
স্বাধীন বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডে বসবাস করছে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী। তন্মধ্যে বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের নৃ-গোষ্ঠী জাতিগুলোর মধ্যে প্রধান নৃ-গোষ্ঠী হলো চাকমা সম্প্রদায়। যারা ‘জুম্ম’ জনগোষ্ঠী হিসেবে অধিক পরিচিত। শান্তি প্রিয় ক্ষুদ্র এই নৃগোষ্ঠী দেশের পাহাড়ি এলাকাগুলোর সৌন্দর্য্য ধরে রাখতে এবং সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও সভ্যতাকে সমৃদ্ধি করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।
সংস্কৃত শব্দ ‘শক্তিমান’ থেকে উৎপত্তি চাকমা শব্দটির। বাংলা কিংবা ইংরেজি উচ্চারণে ‘চাকমা’ বলা হলেও তারা নিজেদের ভাষায় ‘চাঙমা’ বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। চাকমা নৃ-গোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের বৃহত্তম উপজাতি। কক্সবাজারের টেকনাফ ও বান্দারবনে তারা সংখ্যালঘু কম হলেও রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে বেশিরভাগের আবাসস্থল।
‘মঙ্গোলিয়’ জাতি থেকে আগত চাকমা সম্প্রদায়ের রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও বর্নমালা। তবে বর্তমানে বাংলা ভাষায়ও চর্চা করা হয়। তাদের আদি ভাষার নাম ‘চাকমা’। ‘চাকমা’ ভাষায় কিছু প্রাচীন পুথিও ছিল, তন্মধ্যে তালপাতায় লিখিত ‘চাদিগাং চারা পালা’ অন্যতম। চাকমারা মূলত বৌদ্ধ ধর্মালম্বী। তবে পূর্বে এরা হরি ধর্মের অনুসারী ছিল। বর্তমানে এদের অনেকেই খ্রিস্টান ধর্মেরও দীক্ষা নিচ্ছে। এরা জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী। তারা বিশ্বাস করে “সৎকর্ম সাধনের ফলে নির্বাণ লাভ করা যায়”।
চাকমারা মূলত একটি পিতৃতান্ত্রিক সমাজ। সমাজ বা কলোনীর প্রধানকে এরা ‘রাজা’ বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। রাজা তাদের প্রথা, রীতিনীতি, পার্বত্য জেলা পরিষদ অধিবেশনে যোগ দেয়া থেকে শুরু করে তাদের অধিকার আদায়েও কাজ করে থাকে। ব্রিটিশ আমল থেকে আঞ্চলিক ও জাতীয় রাজনীতিতে এরা নেতৃত্বধর্মী ভূমিকা পালন করে আসছেন। চাকমাদের সামাজিক ও প্রশাসনিক বিচার ব্যবস্থাও সুবিন্যস্ত।
চাকমা সম্প্রদায়ের জীবিকার প্রধান উৎস ‘কৃষিকাজ’। পাহাড়ি অঞ্চলে এরা জুম চাষ করে। তবে বর্তমানে বাজারের কথা চিন্তা করে কেউ কেউ কৃষিকাজ ছেড়ে শ্রমবাজারে প্রবেশ করেছে। দেশের নানা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও তারা কর্মরত রয়েছেন। এছাড়াও হস্তশিল্পতেও তাদের নাম উল্লেখযোগ্য।
চাকমা নারীরা ‘হাদি ও পিনোন’ এবং পুরুষেরা ‘সিলুম’ নামে গায়ের জামা ও ‘টেন্নে হানি’ নামক জামা পরিধান করেন। নারীরা খাদি বক্ষ, পাগড়ি, কাগই পোষাক পরে এবং অলংকার হিসেবে রুপা ও হাতির দাঁতের তৈরী হাসুলী, চন্দ্রহার, নেকলেস এবং নাকে নাকফুল ব্যবহার করে। এছাড়াও চাকমা নারীরা একপ্রকার কোমর তাঁতে কাপড় তৈরী করে যার নাম ‘বৈইন’। এছাড়াও নারীরা দক্ষ বুননের অধিকারী।কাপড় বুননের সরঞ্জামকে এরা ‘সজপদ’ বলে।
চাকমাদের বিবাহ প্রথা অন্য সকলের থেকে ভিন্ন। এরা বিবাহ অনুষ্ঠানকে ‘চুমুলং’ বলে। অনুষ্ঠানটি মূলত বৌদ্ধভিক্ষু দ্বারা পরিচালিত হয়। তাদের সম্প্রদায়ে একাধিক বিয়ের গ্রহণযোগ্যতা থাকলে ও এরা স্বামী অথবা স্ত্রীর মৃত্যুর পর পূর্ণবিবাহ করে।
‘বৌদ্ধপূর্ণিমা’ চাকমাদের মূল ধর্মীয় উৎসব। এ সম্প্রদায়ের মানুষ চীবর দান, মাঘী পূর্ণিমা, বৈশাখী পূর্ণিমা, ফানুস ওড়ানো ইত্যাদি অনুষ্ঠান পালন করেন। এছাড়াও এদের অন্যতম প্রধান উৎসব হচ্ছে ‘বিজু’।প্রতিবছর এপ্রিল মাসের শুরুর দিকে ‘বিজু’ উৎসব জাঁকজোমক ভাবে পালন করার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে চাকমারা।
তাছাড়াও চাকমাদের নিজস্ব কিছু সংস্কৃতি রয়েছে।লোকসাহিত্য ও নৃত্যশিল্পে ধরে রেখেছে অন্যরকম একটি স্থান। এরা নাচগান খুব পছন্দ করেন। যেকোনো অনুষ্ঠানে এরা তাদের ঐতিহাসিক পার্বত্য গান গেয়ে থাকে। তাদের প্রধান খেলা হা-ডু-ডু। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এ খেলা আয়োজন করে থাকে। বিভিন্ন রকমের খাবার দাবার, পানীয় ও আয়োজন করে বেশ চমকপ্রদ ভাবে উৎসব পালন করে। এছাড়াও ঘিলে খারা, নাদেং খারা পাঝা খারা তাদের নিজস্ব কিছু নিজস্ব খেলা বেশ অঞ্চলগুলোতে বেশ জনপ্রিয়।
চাকমাদের রন্ধনশিল্পেও রয়েছে ঐতিহ্য। যা তাদের কাছে খুব সম্মানের ও মানুষের কাছে প্রশংসনীয়। তাদের ঐতিহ্যবাহী রান্নার উপাদান ‘শ্রিম পাস্তে’। একে ‘সিদোল’ নামেও ডাকে তারা। যদিও এদের প্রধান খাদ্য ভাত, ভুট্টা দিয়ে তৈরী খাদ্য, সরিষা ও শাক সবজি। চাকমাদের ঐতিহ্যগত খাদ্য হলো ‘বাঁশের অঙ্কুর’; যা ‘বাচ্চুরী’নামে পরিচিত। বাঁশ দিয়ে রান্না করা খাদ্যকে এরা ‘গরাঙ’ও বলে থাকে।
প্রাচীনকাল থেকেই এরা সমৃদ্ধ সংস্কৃতির অধিকারী। শান্তিপ্রিয় এ জাতি দেশের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক কাজে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। তবুও নানান কারণে ও তাদের জন্য সুবিধার কমতিতে চাকমা সম্প্রদায় এখনও কঠিন সংগ্রামের মাঝে দিন কাটিয়ে যাচ্ছে।