পাঠকথন : মাথায় কত প্রশ্ন আসে
মোজাফ্ফর হোসেন : প্রভাষ আমিনের ‘মাথায় কত প্রশ্ন আসে’ বইটি মেলা থেকে সংগ্রহ করেছি। প্রভাষ আমিন সাংবাদিক হিসেবেই হয়ত অধিক পরিচিত, কিন্তু লেখক হিসেবেও তিনি আলাদা করে পরিচিত হতে পারতেন। সেই লেখনী ক্ষমতা তাঁর আছে। বাংলা সাহিত্যে পড়াশুনা করেছেন বলে তিনি ভাষাটা কেবল অর্জন করেননি, একাডেমিকভাবে শিখেছেনও। সেটি তাঁর গদ্য পড়লে বোঝা যায়। যে কারণে তিনি প্রায়ই বিভিন্ন লেখকের উক্তি টেনে লেখাতে অন্যমাত্রা যোগ করেন। প্রসঙ্গক্রমে চলে আসে শামসুর রাহমান থেকে কাহলিল জিব্রান পর্যন্ত।
এই বইতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পঞ্চাশর্ধো গদ্য আছে। সবগুলোই সমসাময়িক বিষয় নিয়ে। সময় ও সমাজ থেকে রাজনৈতিক বাস্তবতার টুকে রাখা ভাবনাগুচ্ছ। যে-যে ঘটনা বাংলাদেশে আলোচিত হয়েছে বা ব্যক্তি প্রভাষ আমিন নিজে আলোড়িত হয়েছেন, সেই ঘটনা নিয়েই লিখেছেন। এখানে বাংলাদেশের চাপিয়ে দেয়া শিক্ষাব্যবস্থা, প্রশ্নফাঁসের বাণিজ্য নিয়ে যেমন লেখা আছে, তেমন ঐশীর ফাঁসি, রাজনের হত্যাকাণ্ড নিয়ে তিনি মর্মস্পর্শী লেখা আছে।
আমি অর্ধেকের বেশি একবসাতে পড়ে ফেললাম। প্রভাষ আমিনের গদ্য একইসঙ্গে থটপ্রভোকিং ও হার্ট প্রভোকিং। অর্থাৎ কোথাও কোথাও পড়ে খুব চিন্তার উদ্রেক ঘটে, কোথাও কোথাও হৃদয় নিংড়ে যায়। একটি উদাহরণ দিই। বইটির শুরুর গদ্যটির নাম মাথায় কত প্রশ্ন আসে। দীর্ঘ গদ্য। এখানে বাংলাদেশের সমাজ রাজনৈতিক বাস্তবতার বেশ কিছু প্রসঙ্গের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। আপাতভাবে তিনি নিজেকে ‘ইডিয়ট’ ধরে নিয়ে প্রশ্নগুলো করছেন। এক-একটি জ্বালাময়ী প্রশ্ন তিনি সহাস্যে ছুড়ে দিচ্ছেন। প্রায়ই গদ্যে তাঁর এই গদ্যঢঙটি চোখে পড়ে। আবার অপরাধ ঐশীর, দায় সবার গদ্যে আমাদের চিন্তার সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়টাও নড়ে ওঠে। আমরা শিশু রাজনের হত্যাকারীর ফাঁসির রায়ে যেমন যেমন উচ্ছ্বসিত হই, তেমনি ঐশীর ফাঁসির রায় শুনে আমাদের নিজেদের ভেতর একটা অপরাধবোধ যেন ফুঁসে ওঠে। ঐশী কেন খুনি হল, সেটি নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করে। তার অপরাধ নিয়ে লেখকের সহানুভূতি নেই, সহানুভূতি অপরাধের পাত্র নিয়ে।
সাংবাদিক প্রভাষ আমিন যখন ভাস্করশিল্পী নভেরাকে নিয়ে লিখেছেন সেখানেও তিনি একটি সময়ের পরিভ্রমণকে তুলে ধরেছেন। তাঁর এই লেখা শিল্পীর নান্দনিকতা তুলে ধরা নয়। সেটি শিল্প সমালোচকদের কাজ। লেখক যা করেছেন, তা হল, শিল্পীর সঙ্গে যে সময় জড়িয়ে, সেই সময়টাকে ধরতে। বা বর্তমানে ফিরিয়ে আনতে।
প্রভাষ আমিনের গদ্য খুবই ইনফর্মাল। তিনি প্রায়ই তাঁর লেখার ভেতর ছেলে প্রসূনের প্রসঙ্গ টেনেছেন। এসেছে তাঁর অন্ত্যজদের কথাও। এতে মাঝে মাঝে লেখার ভারত্ব বা গুরুত্ব পড়ে গেছে বলে মনে হলেও, পড়া শেষ হয়ে গেলে মনে হচ্ছে, লেখক যেন তার আপন পাঠকদের সঙ্গে গল্পের ছলে কথাগুলো বলছেন। অর্থাৎ হেঁয়ালিটা শেষপর্যন্ত অন্য কাজে দিয়েছে। তবে সেটি কিছু কিছু ক্ষেত্রে একটু নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে আরো ভালো হয়।
বইটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই জন্যে যে, এটি ভীষণভাবে সময়কে ধারণ করে। ২০১৫ সালের একটা সার্বিক সালতামামি এখানে উঠে এসেছে। একজন মানুষ (সাংবাদিক কিংবা লেখকের ভূমিকা থেকে নয়) একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি নিজের প্রতি সত্যনিষ্ঠ থেকে তুলে এনেছেন। তাই ইতিহাস বা ঘটনার বিকৃত ঘটার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। লেখক যেহেতু তাঁর বিশ্লেষণ আপনার ওপর জোর করে চাপিয়ে দিচ্ছেন না, তাই আপনি পড়তে পড়তে অন্য একটা উপসংহার টেনে নিতে পারেন।
বইটি প্রকাশ করেছে তাম্রলিপি।
প্রচ্ছদ এঁকেছেন ধ্রুব এষ।
মূল্য: ৩৩৫ টাকা।