শওকত আলী এবং একটি বিকেল

শওকত আলী এবং একটি বিকেল

সাদিয়া মাহজাবীন ইমাম একজন তরুণ গল্পকার। ১৯৮২ সালে ১২ অক্টোবর ফরিদপুরে জন্মগ্রহণকারী সাদিয়া একজন পেশাদার টিভি সাংবাদিকও। ২০১৪ সালে প্রকাশিত ‘পা’ গল্পগ্রন্থের জন্য তিনি হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার ২০১৫ অর্জন করেন। পুরস্কার পাওয়ার পর এক আনুষ্ঠানিক শুভেচ্ছা প্রতিক্রিয়া হিসাবে তিনি এই নিবন্ধ লেখেন।


সাদিয়া মাহজাবীন ইমাম:ই পুরস্কারের সনদপত্র নেই, শুধু অনুভব। বললাম স্যার, সালাম করি? না খুব রাগ করবো পায়ে হাত দিলে, বলেই আমার মুখে বাচ্চাদের মত হাত দিয়ে কয়েকবার স্পর্শ করলেন। বললাম, বেশ তাহলে মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করেন। মাথায় হাত রাখতে রাখতে আবার অন্যমনস্ক হয়ে উঠলেন। শিশুদের মত হয়ে গেছেন তিনি। একা ভালো করে হাঁটতে পারেন না। নভেম্বরের শুরুতেই একটা সোয়েটার গায়ে, বুঝলাম শরীরের তাপমাত্রা কমছে। ইচ্ছে করছিল বলি, অনুমতি পেলে আপনাকে আমার বাড়িতে নিয়ে আসব। কেউ বিরক্ত করবেনা। সারাদিন নিউজ দেখতে যেয়ে ভুলে কার্টুন চ্যানেল দেখবেন, খাবার ভালো না হলে আমার ওপর রাগ করবেন আর অফিস থেকে ফিরে আমি আপনার পায়ের কাছে বসে বসে ল্যাপটপে টাইপ করবো আর আপনি আবার লিখবেন প্রদোষে প্রাকৃতজন, কুলায় কাল স্রোত বা সীমান্তের যাত্রীর মত কোন এক কালজয়ী উপন্যাস।
প্রথম দেখাতে তুই বলে ডাকা, মুখে স্পর্শ করে স্নেহ প্রকাশ . . . এমন আনন্দের প্রাপ্তি গ্রহণ করাও কষ্টের। আমি কেমন করে সামলাই আমাকে……
এক্সিম ব্যাংক অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার ২০১৫ এর জন্য আমি কৃতজ্ঞ অন্যদিনের কাছে। প্রথম বইতে এমন পুরস্কার পেয়ে যাওয়াটা আসলেই অনেক বেশি প্রাপ্তি। ডক্টর আনিসুজ্জামান, হায়াৎ মামুদ, আবুল হাসনাত, সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম ও পূরবী বসুর মত বিদগ্ধ জনেরা আমার বই হাতে নিয়ে পড়েছেন এতেইত আনন্দের শেষ নেই সেখানে এই মানুষেরা মূল্যায়ন করে ভালো বই হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। নবীন লেখক হিসেবে প্রাপ্তিটা ভাবনার সীমানারও অনেক দূরে। তবে তাদের অজান্তেই তারা আমাকে দিয়েছেন ‘একটা চিরজীবী আনন্দ গাছ’। এই গাছ একটু একটু করে বড় হবে, গাছের পাতায় ঘ্রাণ থাকবে, ঝড়-বৃষ্টিতে ডাল ভাঙবে আবার শীতের সকালে শিশুর হাসির মত মুখ নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখবে। এমন একটা পুরস্কার দিয়েছেন যেমন অর্জন হয়ত আর কোনদিন হবেনা। আজীবন এই আনন্দ একটু একটু করে উদযাপন করবো, জীবনের প্রথম বই লিখেই এমন পুরস্কার নিয়েছি স্যারের পাশে দাঁড়িয়ে। শওকত আলী স্যারের সামনে দাঁড়ানোই আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
গত ৮ নভেম্বর বাংলা একাডেমীতে পুরস্কার ঘোষণার পর থেকে একটা জিনিস পেয়েছি, মানুষের শুভাশীষ।
পা আমার একমাত্র বই। বইটির কথা ফেসবুকে নিজে থেকে প্রকাশ্যে একবারই বলেছি তাও বই মেলার প্রায় শেষ দিকে। অহং বা প্রচারণা বিমুখ মনোভাব এমন কিছু কখনোই নয়, ব্যক্তিগত সংকোচ থেকে বলিনি। নিজের লেখা নিয়ে বিশ্বাসের যায়গা থাকলেও সংশয় বিস্তর এবং বিস্তর। কি এমন লিখি আর তাই নিয়ে এখানে বলা আমার কাছে আস্ফালন মনে হয়েছে। এবারের পুরস্কার-এর খবরের পর থেকে একটা ঘোর তৈরি হয়ে আছে। সেই ঘোর থেকে বের হওয়া একটু কঠিন। ঘোরে আমি কিছু অঘটনও ঘটিয়েছি। যেমন শাড়ি পড়তে জানিনা বলে আমার বন্ধুকে বলেছি, শেষ মুহূর্তে বেচারা এমন ভয়াবহ ঝামেলায় আটকে গেল যে অনুষ্ঠান শুরুর এক ঘণ্টা আগে জানালো আসতে পারবেনা। স্বভাবতই দেরি হয়ে গেল প্রস্তুত হতে। ৩০ মিনিট দেরিতে উপস্থিত হওয়ায় আয়োজকরাও অনুষ্ঠান শুরু করতে পারছিলেননা। এই সময় অন্যদিনের মোমেন ভাই আমাকে দুইশ তিনবার ফোন করেছেন এবং প্রায় কেঁদে ফেলেছেন…….আপা প্লিজ দ্রুত আসেন। এত যায়গায় ইন্টারভিউ দিলাম কিন্তু কোথাও বলাই হয়নি আমার বইটার নাম কিন্তু আমি রাখিনি। রেখেছেন এমন একজন যে অফিসে ডেজিগনেশনে আমার অনেক অনেক উপরে কিন্তু মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় ‘এটা আমাদের মঞ্জরী, বন্ধু ও সহকর্মী।’ আমি তিনটি নাম নিয়ে একদিন রুমি ভাইকে ( রুমি নোমান) কে মাথা খারাপ অবস্থায় ( নামকরণে আমার অসীম দুর্বলতা রয়েছে) বললাম কোনটা রাখবো? একবাক্যে তৃতীয় নামটি ধরে বললেন পা নামে কি গল্প আছে? বললাম আছে। বললো তাহলে তোমার বইয়ের নাম ‘পা’। বলা হয়নি একসময় সমকালের কালের খেয়াই আমাকে গল্প লিখতে সবচেয়ে বড় যায়গাটি দিয়েছে। উল্লেখ করিনি, আমার পরিবারের বাইরেও যে মানুষটি লেখা নিয়ে সবচেয়ে বেশি উন্মুখ থাকে তাঁর নামটিও কোথাও। কিন্তু এও জানি আমার আপনজনেরা কখনো এসব ত্রুটি হিসেবে দেখবেননা। আপন মানুষ বলেই দেখবেন না।
শওকত আলী স্যারের সামনে দাঁড়িয়ে পুরস্কার নেওয়াই আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। এই সুযোগটি দেবার জন্য আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার-২০১৫ -এর কাছে। আমি বাংলা ভাষার কাছে দায়বদ্ধ। দায়বদ্ধ আমার সেইসব পূর্বসূরীদের কাছে যারা এই ভাষাটা আমাকে দিয়েছেন।
সাহিত্য এমন একটি চলমান প্রক্রিয়া যে তা দিয়ে একবারেই সমাজ বদলে দেয়া যাবে এমন আশা করা অনুচিত। এটা তাঁর স্বাভাবিক নিয়মে প্রভাব ফেলে যায়। আর রাষ্ট্রের সময়ের উপরও নির্ভর করে সাহিত্য সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য। আগুনের মুখে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধের কথাই ভাবে, তখন হয়ত মধ্যরাতের জোসনা খোরাক হয়না আবার সাধারণ যাপিত জীবনের কাছে এসে অনেক কিছু পরাজিত হয়ে যায় সমাজ ভাবনার। বিশ্ব সাহিত্যের সাথে যদি আমি বাংলা সাহিত্যের অবস্থান দেখতে যাই তা হয়ত আশাহত করবে আবার যদি আঞ্চলিক সাহিত্য হিন্দী, উর্দু, মালয়, তেলেগু, আসাম ভাষার যা যা বাংলা ও ইংরেজিতে অনূদিত পড়েছি তাতে মনে হয়েছে বাংলা সাহিত্য যথেষ্ট শক্তিশালী। সাহিত্য যে সবসময় জনপ্রিয়তার কারণে বিশ্বে সার্বজনীনতা পায় বিষয়টি কখনো তেমন নয়। ভাষাকে নিয়ন্ত্রণ করে রাজনীতি, অর্থনীতি। প্রচুর বিদেশী সাহিত্য বাংলা ভাষায় অনুবাদ হয় কিন্তু বাংলাদেশের কয়টি কবিতা, গল্প অন্য ভাষায় অনূদিত হয়? এর কারণ শুধু বাংলা সাহিত্য দুর্বল এমন একপেশে কথা বললেই হবেনা। এখানে আমাদের অনাগ্রহ ও বিশ্ব সাহিত্যের কাছে বাংলা সাহিত্যকে তুলে ধরার গুরুত্ব না বুঝতে পারার বিষয়টি রয়েছে। আর একটা কথা বলতে ইচ্ছে করছে, আমাদের পাঠভ্যাস নেই। গত বাঁধা সমালোচনা যতটা আমরা করতে পছন্দ করি এর সিকি ভাগও যদি পড়ার অভ্যাস থাকত……
গল্পকার সাদিয়া মাহজাবীন ইমাম
গল্পকার সাদিয়া মাহজাবীন ইমাম
এ কদিনে বেশ কিছু সাক্ষাৎকার দেওয়া হয়েছে। সবার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা। তবে একটি কথা, আরো অনেক বিষয় নিয়ে কথা বলার অবকাশ রয়েছে। তুলনামূলক সাহিত্য, ছোট গল্পের নানাদিক, সাহিত্য নিয়ে সমাজ ভাবনা ইত্যাদি ইত্যাদি। কখনো যদি আবার সাক্ষাৎকার দিতে হয়, এমন সুবর্ণ সুযোগ জীবনে আসেও, মৌলিক প্রশ্ন করার অনুরোধ রইলো। আমি কোথায় বড় হয়েছি বা শৈশবের খুব বিশেষ কিছু ঘটনা এসব বলতে হয় অনেক অনেক পরে যখন মানুষ সত্যি জানতে চায় ব্যক্তি আমিটা কেমন। আর সেই ব্যক্তি আমিটাকে তখনই জানতে চাইবে যখন সত্যি সত্যি ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ এর ধারে কাছেও একটা কোন লেখা লেখক তৈরি করতে পারেন। ব্যক্তিগত ভাবনা বললাম।
শওকত আলী স্যারের সামনে দাঁড়িয়ে পুরস্কার নেওয়াই আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। এই সুযোগটি দেবার জন্য আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার-২০১৫ -এর কাছে।
আমি বাংলা ভাষার কাছে দায়বদ্ধ। দায়বদ্ধ আমার সেইসব পূর্বসূরীদের কাছে যারা এই ভাষাটা আমাকে দিয়েছেন।
কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও পুরস্কার প্রাপ্তি আনন্দ উদযাপন থেকে বের হতেও এই নোটটা লেখা প্রয়োজন ছিল। পুরস্কার প্রাপ্তি নিয়েইও বইএর মত নিজে থেকে লেখা এটি আমার একমাত্র নিজস্ব প্রচারণা । ভুল ত্রুটি ক্ষমা নিয়ে দেখবেন। এই লেখাটির পর পুরস্কার প্রসঙ্গে আর একটি বাক্যও ব্যয় করবোনা। শব্দ দিয়ে শুভেচ্ছা জানাবার দরকার নেই আর। দোয়া করবেন, জীবনে প্রথম বইতেই এমন একটি পুরস্কার প্রাপ্তির ঘটনা ঘটেছে, যেহেতু শওকত আলী স্যার মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করেছেন, তাঁর মত ব্যক্তিত্ব প্রথম দেখায় তুই ডেকে মুখে স্পর্শ করে স্নেহ প্রকাশ করেছেন, আমি যেন আমার দায়বদ্ধতার যায়গাটুকু ভুলে না যাই। লেখা যেন সার্বজনীন হতে পারে। প্রত্যেকের উষ্ণতা ও উপেক্ষা দুটো অনুভূতিই সমান মূল্যবান আমি উভয়ের কাছেই কৃতজ্ঞ।
মানুষই শ্রেষ্ঠ সাহিত্য, মুনষ্যত্বই শ্রেষ্ঠ শিল্প।
১৬ নভেম্বর ২০১৫  favicon

Sharing is caring!

Leave a Comment