প্রযুক্তির যাঁতাকলে বই পড়ার অভ্যাস
- বিপ্লব শেখ
তরুণ থেকে শুরু করে বৃদ্ধ, একটা সময় অনেকেরই অবসর সময়ের বন্ধু ছিল বই। কারণ তারা এই অবসর সময় কাটাত বই পড়ে। নতুন নতুন বইয়ের ভাঁজ খুলে পৃষ্ঠা উল্টে-পাল্টে কাটত তাদের সময়। আর এর মাধ্যমেই তারা আনন্দ খুঁজে পেত।
কিন্তু প্রযুক্তির ভারে বই পড়ার এই অভ্যাসটায় পরিবর্তন আসছে অনেকেরই। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, নব্বইয়ের দশকেও কিশোর-কিশোরীদের মাঝে কাজী আনোয়ার হোসেনের মাসুদ রানা সিরিজ কিংবা মুহাম্মদ জাফর ইকবালের বইগুলো ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়।
এসময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ ঘাসে কিংবা চায়ের দোকানে হরহামেশাই দেখা যেত তরুণ-তরুণীদের সাহিত্য আড্ডা। সেখানে কথা হতো শিল্প, সাহিত্য, রাষ্ট্র, সমাজ ইত্যাদি নিয়ে। তবে বর্তমান সময়েও এ ধরনের আড্ডা চোখে পড়ে। কিন্তু সেখানে সাহিত্য নয়, বরং চর্চা হয় প্রযুক্তির। তারা এখন আর বইয়ের পাতার উপন্যাসের চরিত্র নিয়ে কথা বলে না। আড্ডা দেয় ঠিকই, তবে যে যার ফোনের মধ্যেই ডুবে থাকে। ঘরে, বাইরে, অবসরে, এমনকি আড্ডায় সবখানেই তাদের নিত্যসঙ্গী মুঠোফোন।
প্রযুক্তি তো খারাপ নয়। বরং বিশ্বের জন্য আশীর্বাদ। এ কথা কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট ভিত্তিক পড়ালেখা অথবা বইয়ের বিকল্প হিসেবে প্রযুক্তি কতটুকু সঠিক বলে আপনি মনে করেন?
বই শিক্ষার্থীদের নিত্য দিনের সঙ্গী। দিনরাত বই নিয়ে ছোটাছুটি, সারাদিন বই নিয়ে পড়ে থাকাটা শিক্ষার্থীদের সুন্দর অভ্যাস। কিন্তু অভ্যাসটা এখন উল্টে গেছে। বর্তমান সময়ে শিক্ষার্থীরা বই নয়; বরং তারা ল্যাপটপ, মোবাইল, আইপ্যাড নিয়ে ছুটাছুটি করে। বইয়ের পরিবর্তে গুগল থেকে পিডিএফ পড়ে। আর এই অভ্যাসটা তৈরি হচ্ছে শিশু থেকে বুড়ো সবার মাঝেই।
কিন্তু ক্ষতিটা কোথায়? আপনি যখন আপনার সন্তানের হাতে বই দেবেন তখন অবশ্যই সেটার প্রসঙ্গ, লেখা যাচাই করেই দিবেন। এখানে আপনার সন্তান পুরোপুরিভাবে সঠিক জ্ঞানই অর্জন করবে। কিন্তু আপনি যখন জ্ঞান অর্জনের জন্য আপনার সন্তানের হাতে মোবাইল, ইন্টারনেট বা প্রযুক্তি দেবেন তখন আপনি কখনোই নিশ্চিত হতে পারবেন না যে সে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারই করছে। কারণ এটা বহুমুখী। এখানে যেমন জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব তেমনি কুরুচিপূর্ণ প্রসঙ্গও রয়েছে। যেখানে বই আপনাকে শুধুমাত্র পজিটিভ চিন্তা দেয়, প্রযুক্তি সেখানে আপনাকে পজিটিভ-নেগেটিভ উভয়ই সমানভাবেই দিবে। তাই প্রযুক্তি আপনাকে ভালো-খারাপ উভয় পথেই ধাবিত করতে পারে।
আবার দেখা যায় প্রযুক্তির বাইরে মানুষ যখন বই পড়ে তখন পুরো সময়টাতেই তার পড়ায় মনোযোগ থাকে। কিন্তু ইন্টারনেটে পড়লে তিন ভাগের এক ভাগ সময়ও পড়ায় মনোযোগ থাকে না। এখানে বহুমুখী সুযোগ থাকায় পড়ার মাঝে একটু ফেসবুকিং, মেসেঞ্জার দেখা, ভিডিও দেখা শিক্ষার্থীদের নিত্যদিনের কাজ, যা সম্পূর্ণ জ্ঞান অর্জনে বাধা দেয়।
বই মানুষের যুক্তিবুদ্ধি বাড়ায়, চিন্তাশীল করে এবং ভিতরে থাকা সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তোলে। কিন্তু এই বই পড়ার চর্চাটাই কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। তবে এই প্রযুক্তির ভিড়ে এখনো কিছু মানুষের দেখা মিলে যারা পড়ার মাঝে বইয়ের ঘ্রাণ খোঁজে। কোনো পিডিএফ বা ইন্টারনেটে নয়, বই পড়াতেই তাদের নেশা। তবে এরা অধিকাংশই পেছনের প্রজন্মের মানুষ। বর্তমান প্রজন্মের মাঝে বই পড়ার নেশাটা নেই বললেই চলে। কিন্তু বইকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র প্রযুক্তি দ্বারা জ্ঞান অর্জনের ফল কখনোই ভালো হতে পারে না। বইয়ের পাতার ভাঁজেই রয়েছে মনুষত্ব্য বিকাশের আসল শিক্ষা।