দৃষ্টিপাত : একের ভিতর বহু
বইয়ের নাম : দৃষ্টিপাত
লেখক : যাযাবর
মারুফ ইসলাম: সকাল থেকেই সূর্যের মেজাজ খারাপ। দিনটা তাই আগুনগরম। এরকম এক অগ্নিগর্ভ দিনেই দিল্লির মাটিতে পা রাখলেন স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস এবং তাঁর সঙ্গীরা। উদ্দেশ্য, ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করবেন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সঙ্গে।
১৯৪৬ সালের সেই নিদাঘ-দুপুর দিনে এঁদের পিছু পিছু আরেকজন বিলাতফেরত যুবকও এসে পৌছলেন দিল্লিতে। তার উদ্দেশ্য, ক্রিপসের সেই আলোচনা লিখে পাঠাবেন বিলেতের এক সংবাদপত্রে।
যাযাবর নামের সেই যুবকের কাজ এ টুকুই। অন্তত পত্রিকা থেকে তাকে এ রকমই বলা হয়েছে। কিন্তু ধীমান সে যুবক এটুকু কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখলেন না নিজেকে। খুনের তদন্তের মতো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকলেন ভারতের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ। আর তা লিখে পাঠাতে থাকলেন তার এক বিলেতি বান্ধবীর কাছে।
তখন কী যুবক ঘুণাক্ষরেও টের পেয়েছিলেন, তার এ পত্রগুলোর সংকলিত রূপই একদা ‘দৃষ্টিপাত’ নাম ধারণ করে তুমুল আলোড়ন তুলবে ভূ-ভারতের বাঙালি পাঠক সমাজে? অমরত্ব লাভ করবে সাহিত্যের ইতিহাসে?
দুই
কী আছে দৃষ্টিপাতে যা আজও বাঙালি পাঠক হৃদয়ে যাযাবরকে জাগরুক রেখেছে? কী আছে দৃষ্টিপাতে যা আজও পাঠককে হাসায়, কাঁদায় আবার ভাবায়?
দৃষ্টিপাতে আছে অনেক কিছু। একের ভিতর বহু। এটি হাসায়, কারণ এতে আছে বহুরূপী মানুষ, বহুরূপী চরিত্র আর বহুরূপী ঘটনার সকৌতুক বয়ান। এটি কাঁদায়, কারণ এতে আছে আধারকার ও সুনন্দার বিয়োগান্ত প্রেম। এটি ভাবায়, কারণ এতে আছে ভারতবর্ষের অতীত ইতিহাস, বর্তমান রাজনৈতিক জটিলতা আর অদূরবর্তী ভারতের সম্ভাব্য চেহারা।
দৃষ্টিপাত অনন্য অসাধারণ। কারণ এতে আছে ভ্রমন কাহিনির স্বাদ, আছে ডায়েরি পড়ার মুগ্ধতা, আছে ঔপনিবেশিক শাসন দেখার অবসাদ, আছে সামাজিক আচার অনুষ্ঠানের চিত্র দেখার তৃপ্তি।
আর পাঠককে এসব চেখে দেখাবেন বলেই লেখক যেন পরিকল্পনা করেই দিল্লি পৌছেছিলেন। তাই হয়তো বিমান বন্দর থেকে বের হয়েই পাঠকের জ্ঞাতার্থে ধারা বিবরণীর মতো বলে যান, ‘নয়া দিল্লির রাস্তাগুলি নয়নাভিরাম। তবে রাস্তার পরিচয় আমলাতান্ত্রিক। সরকারি দপ্তরখানার পূর্বতন বহু ইংরেজি কর্মচারিদের নাম পথের প্রান্তসীমায় সুস্পষ্টাক্ষরে ঘোষিত। মোগল বাদশা বাবরের চাইতে চিফ কমিশনার তেলি সাহেবের গুরুত্ব এখানে অধিক। তাই নূরজাহান লেন অপেক্ষা বেয়ার্ড রোড অধিকতর অভিজাত।’
এই আমলাতান্ত্রিক সড়ক পেরিয়ে লেখক যার বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেন তিনি একটা বেসরকারি কোম্পানির স্থানীয় কর্ণধার। এ বাড়িতে থেকেই তিনি তার সাংবাদিকতার দায়িত্বটুকু পালন করেন। আর ফাঁকে ফাঁকে পাঠকের সামনে তুলে ধরেন নয়া দিল্লির প্রেসক্লাব, জিমখানা, যমুনার তীর, নাজিমুদ্দিন আউলিয়ার দরবার ইত্যাদি। এখানেই পরিচয় হয় লেখকের সঙ্গে ঘোষ দম্পতি, সেন মহাশয়, মোহিতকুমার, প্রিয়নাথ বাবু, ইন্দুমতি রায়, ভেঙ্কটশরণ আর চারুদত্ত আধারকারের। তারা প্রত্যেকেই জীবন্ত হয়ে উঠে আসে দৃষ্টিপাতের পাতায় পাতায়।
তবে যে উদ্দেশ্যে যাযাবরের দিল্লি আগমন সেই উদ্দেশ্যের (ক্রিপস মিশন) কথা তিনি একবারের জন্যও ভোলেন না। পাঠককেও ভুলতে দেন না। মাঝে মাঝেই বিজ্ঞাপন বিরতির মতো পাঠকের সামনে তুলে ধরেন ক্রিপস মিশনের আলোচনার কথা। এভাবে বর্ণনা দিতে দিতে শেষ পর্যায়ে এসে জানান, ‘ক্রিপস ব্যার্থকাম হলেন…।’
এবং যার জন্য দৃষ্টিপাত আপামর বাঙালি পাঠকের বাম অলিন্দে ঠাই করে নিয়েছে তার জন্য বোধকরি এর শেষ অধ্যায়ই দায়ী। এ অধ্যায়েই বর্ণিত হয়েছে আধারকারের অশ্রুমেশানো ব্যর্থ প্রণয়কাহিনি। এ কাহিনির পাঠকপ্রিয়তা যতটা না কাহিনির কল্যাণে তার চেয়ে বেশি এর বয়ানভঙ্গির গুণে। এখানে আছে এমন সব বাক্য, এমন সব উদ্ধৃতি যা আজও পাঠকের মুখে মুখে ফেরে। যেমন, ‘মন তো শিশুদের আঁক কষার শ্লেট নয় যে ইচ্ছামতো পেন্সিলের আঁচড় মুছে নতুন করে সংখ্যাপাত করা যাবে।’ কিংবা ‘পলিটিক্সের মতো জীবনও হচ্ছে অ্যাডজাস্টমেন্ট আর কম্প্রোমাইজ।’ অথবা সেই অন্তরভেদী আপ্তবাক্য ‘প্রেম জীবনকে দেয় ঐশ্বর্য, মৃত্যুকে দেয় মহিমা। কিন্তু প্রবঞ্চিতকে দেয় কী? তাকে দেয় দাহ…।’
তিন
এমন অসাধারণ বইয়েরও ত্রুটি আছে। বলা হয়ে থাকে, এই উপন্যাসে যাযাবর নারীদের প্রতি সুবিচার করেননি। সমগ্র দৃষ্টিপাতজুড়ে যত ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ-পরিহাস-কৌতুক তার সিংহ ভাগই মেয়েদের নিয়ে। সমস্ত নারী জাতিকে ‘বিশ্বাসঘাতিনী’রূপে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তিনি যে সুনন্দার দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন তা নিশ্চিতরূপেই একপেশে। কেননা এ বিশ্ব সংসারে কোনো দুটি মানুষের চরিত্রও এক রকম নয়।
তারপরও সব ত্রুটির উর্দ্ধে উঠে দৃষ্টিপাত আমাদের টানে। অন্তরঙ্গতায়, আকর্ষণে, বিমুগ্ধতায় কাছে টানে সম্মোহনী শক্তি দিয়ে। এ টান উপেক্ষা করার শক্তি নেই কোনো পাঠকের।