শুধু মার্কেসই নন, প্রত্যেক ঔপন্যাসিকেরই প্রচুর সময় ব্যয় করতে হয় উপন্যাস রচনায়। উপন্যাস আসলে এমন এক জটিল শিল্পকর্ম যার মধ্যে সারাক্ষণ থাকতে হয়। এটি লেখার মুড-এর উপরে নির্ভর করে না। উপন্যাস ওহী নয়, ইলহাম নয়, নয় কোনো অলৌকিক বাণী। এটি ঝলকানির মতো আসে না। একে ধরতে হয়। বড়শি দিয়ে যেমন মাছ ধরে শিকারী। কবিতা ঝলকানির মতো আসতে পারে। আমি কবি, ঘুমানোর জন্য আমি বালিশে মাথা রাখলাম, অমনি কবিতার পংক্তি আমার মাথায় ঝিলিক দিয়ে উঠল। শোয়া থেকে উঠে মাত্র দশ-বিশ মিনিটে আমি কবিতাটি মাথা থেকে কাগজে নামিয়ে ফেলতে পারি। ভোরে ঘুম থেকে উঠে কাটাছেঁড়া করে এটিকে আরো সুন্দর করে প্রকাশের জন্য পত্রিকায় পাঠিয়ে দিতে পারি।
উপন্যাসের ব্যাপারটা এমন নয়। উপন্যাস আসলে বিক্ষিপ্ত একটা ব্যাপার। সব কিছুই বিক্ষিপ্ত অবস্থার মধ্যে থাকে। কাহিনি, চরিত্র, শব্দ, বাক্য, আঙ্গিক―সবই কিছুই। অনেকটা নির্মিতব্য বাড়ির মতো। বাড়িটা তৈরির জন্য ফাঁকা একটা জায়গার একদিকে ইট-সুরকি, একদিকে সিমেন্ট-বালি, একদিকে রডের স্তুপ পড়ে আছে বিক্ষিপ্তভাবে। অক্লান্ত সাধনায় এই বিক্ষিপ্ত উপাদানগুলোকে সাজিয়ে তোলেন মিস্ত্রি। নির্মাণ করেন বিশাল এক দৃষ্টিনন্দন ইমরাত। এই সৃষ্টির জন্য তাকে লেগে থাকতে হয়। ব্যাপারটা এমন নয় যে ডিজাইনটা করে একদিনেই তিনি ইমরাতটা নির্মাণ করে ফেলতে পারেন। উপন্যাসের ব্যপারটাও এমনই।
‘মোড়লের শরৎ’ লিখবার জন্য গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ পরিকল্পনা করেছেন সতের বছর; লেখাটা শেষ করতে যদিও দু-বছরের বেশি সময় লাগেনি। লেখা শেষ করার পরও ঠিক লেখাটা পেতে গিয়ে দু-বার পুরো লেখাটা পাল্টাতে হয়েছিল। আর ‘শতবর্ষের একাকিত্ব’? এটি লেখার জন্য পরিকল্পনা করেছেন প্রায় পনের বছর; যদিও টাইপরাইটারে লিখতে সময় লেগেছে মাত্র আঠার মাস।
আমি ঔপন্যাসিক, আমার যখন লেখার মুড আসবে তখন লিখলাম, বাকি সময় ঘুরে-ফিরে কাটিয়ে দিলাম―এই করে আর যাই হোক, উপন্যাস লেখা হয় না। বেহায়া প্রেমিকের মতো ঔপন্যাসিককে সারাক্ষণ উপন্যাসটার পেছনে লেগে থাকতে হয়। কবির প্রেরণা বা মুড হঠাৎ করে আসতে পারে, ঔপন্যাসিকের প্রেরণা হঠাৎ করে আসে না। ঔপন্যাসিককে চেষ্টা-তদবির করে মুড আনতে হয়। ঔপন্যাসিকের প্রেরণা আসলে নিয়মানুবর্তিতারই ফল। অর্থাৎ প্রতিদিন তাকে লিখে যেতে হয়। হ্যাঁ, প্রতিদিন হয়ত তার পক্ষে উপন্যাস লেখা সম্ভব হয় না সত্যি, কিন্তু প্রতিদিন উপন্যাসটি নিয়ে অনুধ্যানের মধ্যে থাকতে হয়। প্রচুর নোট নিতে হয়। যে চরিত্রটি নিয়ে লিখছেন তার অবয়ব নিয়ে, তার চিন্তা-চেতনা নিয়ে, তার স্বপ্ন ও কল্পনা নিয়ে, তার আচার-আচরণ, তার যৌনতা, তার খাদ্যাভ্যাস এবং তার চারিত্রিক গুণবলী-দোষাবলী নিয়ে প্রচুর গবেষণা করতে হয়। পোদ্রো নোবা তো তার চরিত্রদের ছবি পর্যন্ত আঁকতেন লেখার আগে। তাদের চেহারা, চুল, তাদের পোশাক-আশাক সব এঁকে নিয়ে তারপর লিখতে বসতেন। আমি বলছি না সব ঔপন্যাসিককে নোবার মতো করতে হবে। বলছি, লেখার আগে মাথায় সাজিয়ে নিতে হবে সবকিছু। ডিজাইনটা করে নিতে হবে। এই সাজানোর জন্য সময়ের প্রয়োজন। অফুরন্ত সময়।
ঔপন্যাসিক আসলে দ্বৈত জীবন যাপন করেন। তিনি অফিস করছেন, সংসার করছেন, বাজার করছেন, বাস কন্ডাক্টরের সঙ্গে ভাড়া নিয়ে তর্ক করছেন, রিকশাঅলার সঙ্গে দরকষাকষি করছেন। তবু, সব কিছুর মধ্যে থাকলেও তার মন কিন্তু উপন্যাসের মধ্যেই নিবিষ্ট। বাসায় ফিরে তিনি কিভাবে চরিত্রটি নিয়ে লিখবেন, কী শব্দ দিয়ে, কী বাক্য দিয়ে লেখাটা শুরু করবেন―এই ভাবনার মধ্যেই ডুবে থাকেন হরদম। আর তাকে অবিরাম পাঠের মধ্যে থাকতে হয়। তিনি অনেকটা মৌমাছির মতো। ইতিহাস, বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্ম, সংস্কৃতি, ভূগোল, জ্যোতির্বিদ্যা, অধিবিদ্যা, সঙ্গীত, রাজনীতি, অর্থনীতি―এগুলো হচ্ছে তার কাছে একেকটি ফুলবাগান। এসব বাগান থেকে তিনি মধু আহরণ করে সঞ্চয় করবেন মৌচাকে। সেই মৌচাকটির নাম উপন্যাস। অর্থাৎ জ্ঞানকাণ্ডের শাখাগুলোর মধ্যে উপন্যাস এমন এক শাখা, যে সকল জ্ঞানকে ধারন করে। উপন্যাস আসলে প্রাচুর্যময় একটি শিল্পমাধ্যম।
টানা তিন মাস, ছয় মাস বা এক বছর পরিশ্রম করে উপন্যাসটি লেখা শেষ হলো। তারপর শুরু হলো সম্পাদনার পালা। উপন্যাস একটানা লিখে যাওয়া যায়, কিন্তু লিখে শেষ করা মাত্রই ছাপার জন্য প্রকাশকের হাতে তুলে দেয়া যায় না। লেখা শেষ হওয়ার পর শুরু হয় পরিমার্জনার পালা। প্রচুর ঘষামাজা করতে হয়। অনেকটা প্রতিমা নির্মাণের মতো। প্রথমে কাঁচা মাটির দলা দিয়ে একটা অবয়ব দাঁড় করাও, তারপর ধীরে ধীরে খুঁড়ে খুঁড়ে ঘষে ঘষে চোখ ফোটাও, কান ফোটাও, স্তন ফোটাও, যৌনাঙ্গ ফোটাও, হাত-পা ফোটাও।
পৃথিবীতে এমন কোনো ঔপন্যাসিক আছে কিনা সন্দেহ, যিনি একটানা উপন্যাসটি লিখে গেছেন, লেখা শেষে পরে আর সম্পাদনা করেননি। একবার হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি আমাকে বলেছিলেন, তিনি একটানা লিখে যান, কখনো দুবার লেখেন না। লেখা শেষে দ্বিতীয়বার সম্পাদনাও করেন না। তার সঙ্গে সেই কথোপকথন আমার ‘কথাসাহিত্যের অলিগলি’ বইটিতে ধরা আছে। ধরে রেখেছি এই জন্য যে, তার সেই কথাটি আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে। কে জানে, হতেও পারে। অসম্ভব সৃষ্টিশীলতা নিয়ে কিছু কিছু মানুষ পৃথিবীতে আসেন। হাসান স্যার হয়ত সেই অসম্ভব সৃষ্টিক্ষমতা সম্পন্ন লেখক, যিনি একটানা লিখে যান, পরে আর সম্পাদনা করেন না। কিন্তু আমি মনে করি, তিনি যদি ‘আগুনপাখি’ বা ‘সাবিত্রি উপাখ্যান’ লেখা শেষে ঘষামাজা করতেন, নিঃসন্দেহে এ দুটি উপন্যাসের ভাষা হতো আরো শক্তিশালী, আরো শিল্পমণ্ডিত।
অতএব, কবির চেয়ে ঔপন্যাসিকের পরিশ্রম অনেক অনেক বেশি―সৃষ্টিশীলতা সমান হলেও। পরিশ্রম ছাড়া কবিতা লেখা হতে পারে, উপন্যাস নয়। আমি ফরিদ কবিরের সঙ্গে একমত।
টুকে রাখা উপলব্ধি
২৫/১২/২০১৫