ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘রোহিঙ্গা সংকট’ নিয়ে সংলাপ অনুষ্ঠিত
- ক্যাম্পাস ডেস্ক
চলমান রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগের আয়োজনে ‘রোহিঙ্গা সংকট : সমাধানের উপায় ও ভবিষ্যৎ করণীয়’ শীর্ষক এক সংলাপ অনুষ্ঠান আজ বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭) বেলা ১১:০০ টায় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ৭১ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিশিষ্ট লেখক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক সৈয়দ আবুল মকসুদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংলাপ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার এম সাখাওয়াত হোসেন (অব:), রাষ্ট্রদূত এম. জমির, রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফায়েজ আহমেদ, কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান, ডিবিসি নিউজের প্রধান সম্পাদক মঞ্জুরুল ইসলাম, আইওএমের সাবেক কান্ট্রি প্রধান আসিফ মুনির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক এম. শাহেদুজ্জামান এবং আলোকচিত্রী ও মানবাধিকারকর্মী সাইফুল হক অমি।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখবেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি’র পরিচালক স্টুডেন্ট এফেয়ার্স সৈয়দ মিজানুর রহমান। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করবেন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস। এছাড়া অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীবৃন্দ।
সভাপতির বক্তব্যে বিশিষ্ট গবেষক ও প্রাবন্ধিক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, গত দুই হাজার বছরের ইতিহাসে পৃথিবীতে যে ৮/১০টি মানবিক বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছে, বর্তমান রোহিঙ্গা সংকট তাদের মধ্যে অন্যতম। এই সংকটে বাংলাদেশের জনগণ এবং সরকার স্বাভাবিকভাবেই মানবিক দিক বিবেচনা করে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। এখন কূটনৈতিকভবে হোক আর রাজনৈতিকভাবে হোক, এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আজকের সংলাপ অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের শীর্ষ মেধাবীরা বক্তব্য রাখছেন। তাদের বক্তব্য শুনতে পারো নিঃসন্দেহে বিরাট সৌভাগ্যের ব্যাপার। আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছি তখন এ ধরনের সুযোগ পাইনি। এসময় তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজই হচ্ছে, বিভিন্ন পর্যায়ের জ্ঞানকে শিক্ষার্থীদের সামনে হাজির করা। ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় সেই উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বলে তিনি কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানান।
অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান তাঁর বক্তব্যে বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যার দুটি রূপ। প্রথমত: এ দেশে বানের স্রোতের মতো রোহিঙ্গা আসছে। দ্বিতীয়ত: মিয়ানমারে তাদের থাকার অধিকার নেই। সুতরাং রোহিঙ্গাদের শুধু ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিলেই চলবে না, তারা যেন সেখানে পূর্ণাঙ্গ নাগরিক অধিকার নিয়ে ফিরে যেতে পারে এবং বসবাস করতে পারে সেই ব্যবস্থাও করতে হবে। বাংলাদেশের একার পক্ষে এ দুটি কাজ করা প্রায় অসম্ভব। এ জন্য বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজন। বাংলাদেশ সরকারের উচিত এখনই মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ তৈরির জন্য সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা।
ব্রিগেডিয়ার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বিমানে অক্সিজেন সংকট হলে বলা হয়, প্রথমে আপনি নিজে অক্সিজেন নিন, তারপর আপনার সন্তানকে দিন। অর্থাৎ আমাদের নিজেদেরকে আগে বাঁচতে হবে। এসময় তিনি বলেন, আমাদের বড় সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, আমরা মিয়ানমার সম্পর্কে তেমন কিছুই জানি না। তাদের সঙ্গে আমাদের সব ধরনের যোগাযোগ অত্যন্ত সংকীর্ণ। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের জন্য তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হবে বলে মন্তব্য করেন ব্রিগেডিয়ার এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, মিয়ানমারের শক্তি সামর্থ সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত হয়েই সামনে আগানো উচিত।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম. জমির মিয়ানমারের নেত্রী অং সাং সূচির সমালোচনা করে বলেন, সূচি বর্তমানে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পাবলিক রিলেশন অফিসারে পরিণত হয়েছেন। সুতরাং তার কাছ থেকে সমস্যার সমাধান আশা করাটা বাতুলতা। তিনি তরুণদের উদ্দেশ্যে বলেন, ফেসবুকের দুনিয়া থেকে বের হয়ে এসে ইন্টারনেটের অন্যান্য মাধ্যমেও চোখ রাখতে হবে। তা না হলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের প্রকৃত অবস্থা অনুধাবন করা যাবে না।
মুন্সি ফায়েজ আহমেদ বলেন, ভারত তার স্বার্থে যেকোনো অবস্থান নিতেই পারে। আমাদের সরকারের তরফে ভারতকে বোঝানো দরকার যে, এটি একটি মানবিক ইস্যু। ভারতের উচিত মানবতার পক্ষে দাঁড়ানো। একইভাবে চীন ও রাশিয়াকেও বোঝাতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে এত কম সময়ে এত বেশি মানুষ কখনো সীমান্ত পার হয়নি। সুতরাং বুঝাই যাচ্ছে, মিয়ানমার একটি মানবিক যুদ্ধ বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। এ যুদ্ধে আমাদেরকে জয়ী হতেই হবে। এজ্যন্য আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তুলতে হবে। আমরা যদি মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিকভবে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক অবরোধ আরোপের ব্যবস্থা করতে পারি তাহলেই এ সমস্যার আশু সমাধান হতে পারে বলে মন্তব্য করেন সোহরাব হাসান।
ডিবিসি নিউজের প্রধান সম্পাদক মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থী সম্পর্কে বিভিন্ন উৎস থেকে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। সরকারের উচিত গণমাধ্যমে সঠিক তথ্য সরবরাহ করা। এসময় তিনি বলেন, সরকার এই মুহূর্তে তিনটি কাজ করতে পারে। এক. জনমত তৈরি করা, দুই. আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও তথ্যের সঠিক সরবরাহ নিশ্চিত করা, তিন. এ জন্য বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম কর্মীদের অবাধ গমনের ব্যবস্থা করা।
আইওএমের সাবেক কান্ট্রি প্রধান আসিফ মুনির বলেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য যে পরিবেশ তৈরি করতে হবে, সে কাজটি মোটেও সহজ নয়। এজন্য বাংলাদেশকে দীর্ঘমেয়াদে ভাবতে হবে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। আগামী তিন মাসেও যদি তাদেরকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো না যায়, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ কী কী সমস্যায় পড়তে পারে তা এখনই ভাবতে হবে এবং সে সমস্যা মোকাবেলায় করণীয় নির্ধারণ করতে হবে।
অধ্যাপক এম. শাহেদুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ অনেক বেশি পেশাগত কূটনীতির ওপর নির্ভর করেছে। গতানুগতিক কূটনীতির বাইরে যেতে পারেনি। এজন্য সংকট আরো ঘনিভূত হচ্ছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ভারত ও চীনের সঙ্গে আলোচনা করে এ সমস্যার সমাধান করার কথা আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কেন মনে আসেনি?
আলোকচিত্রী ও মানবাধিকারকর্মী সাইফুল হক অমি বলেন, বাংলাদেশ একটি নতুন কালপর্বে প্রবেশ করেছে। স্বাধীনতার পরে এত বড় আন্তর্জাতিক সমস্যায় বাংলাদেশ পড়েছে কিনা সন্দেহ। এ মুহূর্তে সবাইকে এক্যবদ্ধ হতে হবে। ২০০৭ সালে তিনি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরি গিয়েছিলেন। সেই স্মৃতিচারণ করে বলেন, ২০০৮ সালের সংকটের চেয়ে বর্তমান সংকট আরো জটিল। তখনকার মিয়ানমার আর বর্তমানের মিয়ানমার এক নয়। এজন্য বাংলাদেশ সরকারকে অনেক ভেবে চিন্তে পদক্ষেপ নিতে হবে।
তিনঘণ্টাব্যাপী অনুষ্ঠানে আলোচকরা নিজেদের বক্তব্যের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন।