বিদেশে পড়তে যেতে চান?
- তৌহিদা খানম, ফ্রান্স থেকে
আমি প্রায়ই ফেসবুকে কিছু মেসেজ ও কল পাই। তাঁদের একটা অংশ জানতে চান, কীভাবে বিদেশে পড়তে যাওয়া যেতে পারে। কোন এডুকেশন কনসালট্যান্সি ফার্মের মাধ্যমে প্রক্রিয়া করা যেতে পারে। এডুকেশন কনসালট্যান্সি ফার্মকে কত টাকা দিতে হতে পারে। টোটাল কত খরচ হবে ইত্যাদি।
এসব জানতে চাওয়া মোটেই দোষের কিছু নয়। আমি যেহেতু বিদেশে থাকি ও বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, তাই জানতে চাইতেই পারে।
তবে বলতেই হচ্ছে, আপনার যদি বিদেশে পড়াশোনা করার ইচ্ছে থাকে, তাহলে এডুকেশন কনসালট্যান্সি ফার্মের মাধ্যমে প্রক্রিয়া করানো বা কারও কাছ থেকে জানতে চাওয়াটা স্রেফ বোকামি। এর কারণ হচ্ছে আপনি যেই প্রশ্নগুলো করছেন, এর উত্তর ইন্টারনেট ঘেঁটেই বের করা যায়। এখন তো ইন্টারনেট সবার হাতে হাতে। আপনাকে প্রতিদিন বেশ কিছু সময় ইন্টারনেট ঘাঁটতে হবে।
ইন্টারনেটে আপনি কী তথ্য জানতে চাইবেন? শুরু করবেন গুগল সার্চ দিয়ে। ধরুন, আপনি আমেরিকায় পড়তে যেতে চাইছেন কিংবা ইংল্যান্ড, সুইডেন বা জার্মানি।
এখন আপনার কাজ হচ্ছে গুগলে সার্চ দিয়ে এসব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওয়েবসাইট থেকে তথ্য সংগ্রহ করা। জগতের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে তাদের ভর্তির তথ্য দেওয়া থাকে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অনলাইনেই আবেদন করা যায়।
এখন আপনি যে তথ্যগুলো নেবেন, সেটা হচ্ছে ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হতে কিংবা স্কলারশিপ পেতে কী কী যোগ্যতা লাগে। দেখবেন বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আলাদা একটা সেকশন থাকবে। যেখানে লেখা থাকবে, ইংলিশ রিকোয়ারমেন্ট। অর্থাৎ আপনাকে ইংলিশ টেস্টে স্কোর কত পেতে হবে। এ ছাড়া আপনার সিজিপিএ কত থাকা উচিত ইত্যাদি।
অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়তো দেখবেন অনেক বেশি ইংলিশ টেস্ট স্কোর চাইছে। অনেক জায়গায় হয়তো আপনার যে যোগ্যতা তাতেই হয়ে যাবে। আবার এমন বিশ্ববিদ্যালয়ও পাওয়া যেতে পারে, যেখানে হয়তো টেস্ট না দিলেও চলছে। এই তথ্যগুলো জানার জন্য আপনাকে যেটা করতে হবে, তা হলো প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট ঘাঁটতে হবে।
এভাবে ওয়েবসাইট ঘাঁটতে ঘাঁটতে একটা সময় আপনি পেয়ে যাবেন আপনার যোগ্যতা অনুযায়ী আসলে কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে পারবেন। আর এসব তথ্য বের করতে যদি আপনার কষ্ট লাগে, সে ক্ষেত্রে আপনি কোনো এডুকেশন কনসালট্যান্সি ফার্মের সহায়তা নিতে পারেন।
বিদেশে পড়তে আসা খুব সহজ। যদি থাকে ইচ্ছেশক্তি। যদি মনস্থির করেন আপনি বিদেশে পড়াশোনা করবেন, যাঁদের বিদেশে পড়াশোনার বিষয়ে তথ্য জানার আছে, তাঁরা এই লেখাটা পড়তে পারেন বা সংগ্রহে রাখতে পারেন।
বিদেশে উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতি
ক. প্রথমে আপনি একটি পাসপোর্ট করে নিন। পাসপোর্টে যাতে কোনো সমস্যা না থাকে যেমন সার্টিফিকেটের নাম ও জন্মতারিখ যেন মিল থাকে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
খ. কেবল একাডেমিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল নয়। ইংরেজিতেও দক্ষতা থাকতে হবে আইইএলটিএসে ভালো স্কোর। ন্যূনতম ৬-৭ স্কোর থাকতে হবে। না থাকলে বিদেশে পড়াশোনার চেষ্টা করে লাভ নেই। বিশেষত স্কলারশিপ যে মিলবে না এটা নিশ্চিত। তবে চীন, জাপান, জার্মানি ও ফ্রান্স এসব দেশে যেতে চাইলে ওই দেশের ভাষাটাও শিখে নেওয়া ভালো।
তাই আইইএলটিএসের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করুন। এ ক্ষেত্রে আপনি ইউটিউবের ভিডিও দেখে কিংবা ব্রিটিশ কাউন্সিল, এক্সিকিউটিভ কেয়ার বা অন্য কোনো কোচিং সেন্টারের সহায়তা নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করতে পারেন। ভালো প্রস্তুতি থাকলে আইইএলটিএস পরীক্ষাটা দিয়ে ফেলুন। আইইএলটিএস পরীক্ষা দেওয়ার জন্য আপনার পাসপোর্টের প্রয়োজন হবে। তাই প্রথমে পাসপোর্ট করে রাখার কথা বলেছিলাম।
গ. সব শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেট ইংরেজিতে করিয়ে নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে দুভাবে অনুবাদ করা যায়। বোর্ডের একটি নির্দিষ্ট ফরম পূরণের মাধ্যমে নির্দিষ্ট পরিমাণ ফি ব্যাংক ড্রাফটের মাধ্যমে জমা দিয়ে শিক্ষা বোর্ড থেকে সনদপত্র ও নম্বরপত্রের অনুবাদ কপি তোলা যায়। তবে এ ক্ষেত্রে একটু সময় বেশি লাগে বলে আপনি ইচ্ছে করলে নোটারি পাবলিক থেকেও অনুবাদ করাতে পারেন।
ঘ. ছবি ও সব একাডেমিক সার্টিফিকেট অবশ্যই বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি বিশেষ শাখা থেকে সব কাগজপত্রের মূল কপি দেখানো সাপেক্ষে সত্যায়িত করিয়ে নিতে হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সার্টিফিকেট সত্যায়িত করতে টাকা লাগে না। এ ছাড়া নোটারি পাবলিক থেকেও সত্যায়িত করা যায়।
ঙ. আপনার কোনো স্টাডি গ্যাপ থাকলে সেটা কেন বা ওই সময় চাকরি করলে তার প্রমাণপত্র সংগ্রহে রাখতে হবে। ক্ষেত্র বিশেষে এসব লাগতে পারে।
চ. স্কলারশিপের জন্য একটা মোটিভেশন লেটার লিখুন। আপনি কেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে অমুক বিষয়ে পড়তে যেতে আগ্রহী, আপনার পরিকল্পনা ও আপনাকে কেন স্কলারশিপ দেওয়া যেতে পারে, এগুলো সুন্দর ও যৌক্তিকভাবে মোটিভেশন লেটারে লিখুন। নিজে না পারলে অভিজ্ঞ কারও সহায়তা নিতে পারেন। তবে কোনোভাবে ইন্টারনেট থেকে সার্চ করে কপি করে দিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না।
ছ. ব্যাংক সলভেন্সি সার্টিফিকেট অর্থাৎ আর্থিক সামর্থ্যের প্রমাণপত্র লাগবে। বিদেশে পড়াশোনাকালে আপনি যাবতীয় খরচ বহন করতে পারবেন। এ জন্য বিভিন্ন অঙ্কের অর্থের ব্যাংক সলভেন্সি সার্টিফিকেট লাগে। প্রমাণস্বরূপ ব্যাংক গ্যারান্টিপত্রের সত্যায়িত ফটোকপি লাগবে।
কারণ, যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনি ভর্তি হতে চাচ্ছেন তার খরচ বহন করা আপনার পক্ষে সম্ভব কি না, সেটা কর্তৃপক্ষ দেখবে। যদি মনে করে ব্যয়ভার বহন করা শিক্ষার্থীর পক্ষে সম্ভব নয়, তাহলে ভিসা মিলবে না।
জ. বিদেশ ভ্রমণের জন্য আপনাকে ট্রাভেল ইনস্যুরেন্স করতে হবে।
ওপরের সবগুলো নিয়ে যদি আপনি প্রস্তুত। তাহলে আবেদন ও ভর্তিপ্রক্রিয়া শুরু করে দিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে যখন দেখবেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য যে যোগ্যতাগুলো দরকার, সেগুলোর সঙ্গে আপনার যোগ্যতা মিলে যাচ্ছে, তখন আপনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন করবেন। সেখানে দেওয়া আছে আবেদন করার শেষ সময় কত তারিখ কিংবা ঠিক কবে থেকে আবেদন করা যাবে।
অনলাইনে আবেদন করে ফেলুন, সেই সঙ্গে আপনার সব সার্টিফিকেট ও অন্য যেসব কাগজপত্র চায় সেগুলো সব স্ক্যান করে আপলোড করে দিন। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় হয়তো আপনাকে বলবে, কাগজগুলোর কপি পাঠাতে। সে ক্ষেত্রে বাইপোস্টে পাঠিয়ে দেবেন। নির্দিষ্ট দেশের বাছাইকৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য প্রথমে ভর্তি তথ্য, প্রসপেক্টাস ও ভর্তি ফরম চেয়ে আবেদন করতে হবে। আবেদন করার সময় নির্দিষ্ট দেশ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানভেদে একটা আবেদন ফি পরিশোধ করতে হয়। তবে আমার জানামতে, এটা ১০ হাজার টাকার মধ্যে।
আবেদন করার পর মাসখানেক বা মাস দু-এক পরে তারা আপনাকে ই–মেইল করে জানাবে, আপনি অ্যাডমিশন পেয়েছেন কি না। অ্যাডমিশন যদি পান, তাহলে তারা অ্যাডমিশন লেটার পাঠিয়ে দেবে। ভর্তির অনুমতিপত্র বা অফার লেটার পাওয়ার পর সাধারণত অফার লেটারে বা প্রসপেক্টাসে উল্লেখিত টিউশন ফির সমপরিমাণ অর্থ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংক ড্রাফট করতে হবে। সেই সঙ্গে আপনাকে বলবে ভিসার আবেদন করতে।
ভিসা প্রদানের ক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য থাকলেও প্রায় সব নিয়মই একই রকম। ভিসার আবেদন করা মোটেই ঝামেলার কিছু নয়। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনি চান্স পেয়েছেন, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটেই দেখবেন আলাদা করে একটা লিংক দেওয়া আছে, সেই দেশের মাইগ্রেশন বোর্ডের। সেখান থেকে আপনি জেনে নিতে পারবেন কীভাবে ভিসার জন্য আবেদন করতে হবে।
ধরুন, আপনি ইউরোপের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাডমিশন পেয়েছেন। এখন আপনাকে ভিসা কিংবা রেসিডেন্স পারমিটের জন্য আবেদন করতে হবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই ভিসার আবেদনপত্র সরবরাহ করে থাকে। এ ছাড়া আপনি বাংলাদেশে ওই দেশের অ্যাম্বাসিতেও যোগাযোগ করতে পারেন। তারা বসেই আছে আপনাকে তথ্য দেওয়ার জন্য।
অ্যাম্বাসি মানেই ভয়ের কিছু নয়। তারা বসেই আছে আপনাকে তথ্য দেওয়ার জন্য কিংবা ভিসা দেওয়ার জন্য। আপনাকে স্রেফ নিয়ম মেনে এগোতে হবে। নির্দিষ্ট দূতাবাস থেকে ভিসার আবেদনপত্র সংগ্রহ করে সঠিক তথ্য দিয়ে নির্ভুলভাবে প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্রসহ দূতাবাসে জমা দিতে এবং নির্দিষ্ট দিনে ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে ভিসা সংগ্রহ করতে হবে।
নতুন একটি ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে মানুষ হয় দেশান্তরিত। বিদেশে পড়ার স্বপ্নসারথিদের জন্য অগ্রিম শুভকামনা ও ভালোবাসা।
তৌহিদা খানম: পিএইচডি অধ্যয়নরত, সর্বন বিশ্ববিদ্যালয়, ফ্রান্স।
সূত্র: প্রথম আলো