আমেরিকায় কেন আন্ডারগ্রাজুয়েট পড়তে যাবেন না?

আমেরিকায় কেন আন্ডারগ্রাজুয়েট পড়তে যাবেন না?

  • ড. রাগিব হাসান

নানা সময়ে বিভিন্ন ফোরামে আমেরিকায় উচ্চতর শিক্ষা তথা মাস্টার্স ও পিএইচডি পর্যায়ে পড়া নিয়ে লিখেছি। অনেকেই সেসব লেখায় আমেরিকায় ব্যাচেলর্স বা স্নাতক পর্যায় বা আন্ডারগ্রাজুয়েট পর্যায়ে পড়ার ব্যাপারে প্রশ্ন করেছেন। আজকে সেটা নিয়েই কিছু লিখছি।

আমেরিকার অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স বা পিএইচডি পর্যায়ে বিদেশী শিক্ষার্থীদের পড়ার যে সুবিধা থাকে ফান্ডিং সহ, আন্ডারগ্রাজুয়েট পর্যায়ে সেরকম সুবিধা নেই বললেই চলে। তাই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রাজুয়েট শিক্ষার্থী হিসাবে বাংলাদেশীরা যত আসছেন, আন্ডারগ্রাজুয়েট পর্যায়ে সেরকম আসে না বললেই চলে। এর পরেও অনেকেই এইচএসসির পরে পরেই আমেরিকার নানা ইউনিভার্সিটি বা কলেজে পড়াশোনা করতে আসতে চান। লেখাটা তাঁদের জন্যই।

এক কথায় বলতে গেলে, আমি আন্ডারগ্রাজুয়েট পর্যায়ে বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় পড়তে আসাকে নিরুৎসাহিত করি পুরোপুরি।

কেন?

কারণগুলো (আমার অভিমত) নিচে লিখছি –

১) খরচ : অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়েই আন্ডারগ্রাজুয়েট পর্যায়ে বিদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য স্কলারশিপ দেয়া হয় না। কিছু ব্যতিক্রম আছে বটে কিন্তু তার জন্য সারা বিশ্বের বহু শিক্ষার্থীর সাথে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে পেতে হয়। কাজেই আন্ডারগ্রাজুয়েট পর্যায়ে ফুল স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে আসার সম্ভাবনা খুবই কম, যেটা মাস্টার্স বা পিএইচডি পর্যায়ে সহজেই সম্ভব।

আন্ডারগ্রাজুয়েট পর্যায়ে রিসার্চ বা টিচিং এসিস্টেন্টশিপও কম বা নেই বললেই চলে—আর থাকলেও সেটার বেতন ঘণ্টা হিসাবে।

আর অধিকাংশ আন্ডারগ্রাজুয়েট শিক্ষার্থীকে ডর্মিটরিতে থাকার খরচও দিতে হয় শুরুতে, ফলে টিউশন ও সেই খরচ মিলিয়ে বিশাল পরিমাণ টাকা দরকার হয় প্রতি সেমিস্টারে।

দেশে যদি কারো পরিবার কোটিপতি বা শতকোটিপতি হয়, তাহলে সমস্যা হবে না, কিন্তু অধিকাংশ মানুষের পরিবারই সেরকম নয়। কাজেই এই খরচ দিয়ে আমেরিকায় আন্ডারগ্রাজুয়েট সেলফ ফিনান্সে পড়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার একটা।

২) কষ্ট : আন্ডারগ্রাজুয়েট শুরু করতে যাওয়া একজন শিক্ষার্থীর বয়স ১৮ বা ১৯ মাত্র। টিন এইজ শেষ হয়নি। এই বয়সের একজন কিশোর বা কিশোরী আমেরিকায় পুরোপুরি একাকী পড়তে এসে যে পরিমাণ কষ্টের মধ্যে পড়ে, সেটা সামলে নেয়া অনেক কঠিন।

খরচের কথা আগের পয়েন্টেই বলেছি। বাংলাদেশের অধিকাংশ এই বয়সের কিশোর কিশোরী কোন কাজ করে অভ্যস্ত না। পড়ার বিশাল খরচ মেটাবার জন্য আমেরিকায় আসার পরে নানা রকমের অড জব করতে হয়। এমনিতেই তাড়াতাড়ি পাশ করার তাড়া, তার উপরে দিনে কয়েক ঘণ্টা স্বল্প বেতনে কাজ করা—এই দুইটা জিনিষ সামলানো খুব কঠিন। কাজ করতে গিয়ে পড়ার সময় পাওয়া যায় না, ফলে রেজাল্ট ভাল রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। তার উপরে এত অল্প বয়সে জীবনের কঠিন দিকটা দেখা, টাকার খোঁজে দিশেহারা হয়ে পড়া, এবং তদুপরি পরিবার থেকে এত দূরে ভিন্ন একটি দেশে থাকা—সব মিলিয়ে সেটা এত অল্প বয়সী একজন শিক্ষার্থীর জন্য প্রচণ্ড মানসিক চাপের কারণ হয়।

বাংলাদেশে পারিবারিক সাপোর্ট থাকে। এমনকি নিজের বাড়ি থেকে দূরে পড়তে গেলে ও হলে থাকলেও চাইলেই ঘণ্টা কয়েকের মধ্যে বাড়িতে যাওয়া চলে। আর নিজের সংস্কৃতি নিজের দেশের মধ্যে অনেক মানসিক শক্তি মিলে, যেটা বিদেশে হাজার চাইলেও মিলবে না। কাজেই একজন কিশোর বা কিশোরীর পক্ষে বিদেশে আন্ডারগ্রাজুয়েট পড়ার সময়টা খুব মানসিক চাপের কারণ হয়ে দাড়ায়।

৩) দেশে স্নাতক করার সুবিধা : বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সময়ে সেশন জট ছিল প্রচুর। এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেটা কমে এসেছে। আর প্রাইভেটে সেটা নেই। দেশে ভালো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও অনেক ভালো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ও হয়েছে। কাজেই পড়ার মানের দিক বিচার করলে বাংলাদেশের স্নাতক শিক্ষার মান আমেরিকার স্নাতক শিক্ষার মানের চাইতে খুব একটা খারাপ না। (আমি অবশ্যই এমআইটি বা হার্ভার্ডের স্নাতকের সাথে তুলনা করছি না—গড়পড়তা আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক শিক্ষার কথা বলছি)। কাজেই অনেক কষ্ট করে এবং লাখ লাখ টাকা খরচ করে আমেরিকায় আন্ডারগ্রাজুয়েট ডিগ্রি করতে গিয়ে খুব বেশি একটা সুবিধা পাওয়া যায় না যেটা বাংলাদেশে মিলবে না।

আর বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করার পরে চাইলে মাস্টার্স বা পিএইচডি পর্যায়ে ফান্ডিংসহ বিনা খরচে পড়ার সুবিধা তো আছেই। বাংলাদেশের নানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই আমেরিকার নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে এভাবে হাজার হাজার ছাত্র আসছেন প্রতিবছর।

৪) মানসিক পরিপক্কতা : মানসিক পরিপক্কতা একটা বড় ব্যাপার। সদ্য এইচএসসি পাশ করা একজন শিক্ষার্থী বয়সে তখনো অনেক কাঁচা। এই অবস্থার চাইতে ২৩/২৪ বছর বয়সের একজন স্নাতক পাশ করা শিক্ষার্থী মানসিকভাবে অনেক অভিজ্ঞ ও পরিপক্ক। কাজেই মাস্টার্স বা পিএইচডি পর্যায়ের একজন শিক্ষার্থী যতটা সহজে নতুন একটি দেশে খাপ খাইয়ে নিতে পারে, ১৮ বছরের একজন কিশোর বা কিশোরীর পক্ষে সেটা করা সম্ভব হয় না। ১৮-২২ বছরের এই সময়টা আসলে মানুষের formative year এর একটি অংশ। পরিবার কিংবা নিজের সমাজের সংস্কৃতির ছত্রছায়ায় এই সময়টাতে নৈতিক ও মানসিক দৃঢ়তার যে ভিত্তি দেশে গড়ে উঠে, বিদেশে পরিবারপরিজনহীন অবস্থায়, বাঁধনছাড়া পরিবেশে, এবং ভিন্ন একটি সমাজে সেভাবে একজন টিনেজারের বিকাশ ঘটে না। প্রচুর প্রচণ্ড মেধাবী শিক্ষার্থীর উদাহরণ জানি যাঁরা দেশে এইচএসসি পর্যায়ে বিশাল ভাল ফলাফল করে পরে আমেরিকায় মাঝারিমানের বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ে পড়তে এসে উপরের বিভিন্ন কারণে আর সেরকম সেরা ফলাফল ধরে রাখতে পারেননি। (ব্যতিক্রম আছে বটে, কিন্তু ব্যতিক্রম উদাহরণ না, আমি সামগ্রিক হিসাবের কথা বলছি যা একজন দুইজনের সাফল্য দিয়ে এড়ানো যায় না)।

কাজেই আপনি বা আপনার পরিচিত কেউ এইচএসসি পাসের পরেই আমেরিকায় যদি স্নাতক করতে যেতে চান, শুরুতেই ভেবে দেখুন, অঢেল টাকা, বিদেশে পারিবারিক সুবিধা, এসব আছে কি না। যদি না থাকে, তাহলে কষ্ট করে চার বছর অপেক্ষা করুন, এবং দেশে স্নাতক ডিগ্রি শেষ করে তবেই প্রস্তুত হয়ে আমেরিকায় পড়তে আসুন। তার আগে নয়।

Sharing is caring!

Leave a Comment