নাহিদের স্বপ্নের ড্রোন

নাহিদের স্বপ্নের ড্রোন

  • এস এম রাসেল

ছোট বেলায় আকাশে ঘুড়ি উড়ানো অথবা খেলনার বিমান উড়ানোই ছিল আমাদের শখ। কখনো ড্রোন আকাশে উড়বে তা ছিল যেন স্বপ্নের মতো! আজ  শুনবো নাহিদে ফেরদৌসের ড্রোন আকাশের উড়ার গল্প।

নাহিদে ফেরদৌসের জন্ম ঠাকুরগাঁও জেলায় । ২০০৮ সালে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পান। ঢাকার একটি কলেজে ইলেকট্রনিকসে ডিপ্লোমা করে ওই বছর ভর্তি হন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগে।

ছোটবেলা থেকেই রোবটিক্স (রোবট বিষয়ক বিজ্ঞান) এবং মোটরাইজড প্রযুক্তির প্রতি ভীষণ আগ্রহ ছিলো নাহিদের। ড্রোনের দিকে নাহিদের প্রথম নজর যায় ২০০৯ সালে মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্র ‘থ্রি ইডিয়টস’ দেখার পর। সেখানে বন্ধুরা মিলে তৈরি করা ড্রোন আকাশে ওড়ানোর দৃশ্য দেখে অনুপ্রাণিত হন তিনি, ‘ছবিটা দেখেই মনে হয় আমাকে এমন কিছু বানাতে হবে।’

নাহিদের বানানো ড্রোন। ছবি: ফেসবুক।
নাহিদের বানানো ড্রোন। ছবি: ফেসবুক।

এরপরেই নাহিদ বিভিন্ন ব্লগ ও ইউটিউব থেকে পড়ালেখা করে ড্রোন বানানোর রহস্য আবিষ্কার করেন নাহিদ। কিন্তু খুব ইচ্ছে থাকলেও প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি সহজলভ্য না হওয়ায় এবং ব্যয়বহুল এ কাজে যথেষ্ট আর্থিক সহায়তা না পাওয়ায় সে সময় এগোনো সম্ভব হয়নি ড্রোন বানানোর কাজ।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর উন্নত প্রযুক্তি পেয়ে এবং বিশ্ববিদ্যালয় তহবিলের আর্থিক সহায়তা নিয়ে নাহিদ ড্রোন তৈরির কাজ শুরু করেন ২০১৩ সালে। চার মাসের চেষ্টায় যৌথভাবে তৈরি করেন ‘ড্যাফোডিল স্পাই কোয়াড কপটার-হেলিক্যাম’। এরপর আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। বন্ধুরা মিলে আবার তৈরি করেন ড্রোন। আলট্রাসনিক সেন্সর ব্যবহার করা সেটিতে, যেটির মাধ্যমে বের করা সম্ভব কত উচ্চতায় রয়েছে ড্রোনটি। তিন কেজি ওজন বহনে সক্ষম ওই ড্রোন এক হাজার মিটার উচ্চতা পর্যন্ত উড়তে পারে। তিন কিলোমিটার পর্যন্ত ড্রোনটি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এটি বাতাসে স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। আর এ ড্রোন দিয়ে ২০১৪ সালে ঢাকার এমআইএসটি আয়োজিত ‘প্রথম জাতীয় অ্যারো-ডিজাইন প্রতিযোগিতা’র রোটারি উইং বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করে নাহিদের দল।

প্রথমে দলীয়ভাবে কাজ করলেও একসময় দেশের সার্বিক পরিস্থিতির কারণে নাহিদের বন্ধুরা ড্রোন নিয়ে গবেষণা করার ওপর আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু থেমে যাননি নাহিদ। তখন থেকে মোটামুটি একাই কাজ করছেন। এ পর্যন্ত মোট ১২টি ড্রোন তৈরি করেছেন তিনি। এদের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য।

নাহিদের আরও কিছু অর্জনের দিকে নজর দেওয়া যাক। ২০১৩ সালে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো হেলিক্যাম প্রজেক্ট তৈরি করেন। এরপর ২০১৪ সালে জাতীয় অ্যারো-ডিজাইন প্রতিযোগিতায় প্রথম হন। এ বছর গ্লোবাল রোবোটিক চ্যালেঞ্জ প্রতিযোগিতায় প্রথম রানার আপ হয়েছেন। জাতীয় হ্যাকাথন প্রতিযোগিতায়ও হয়েছেন রানার আপ। ভারতের টেকক্রিট প্রতিযোগিতায় হয়েছেন পঞ্চম এবং রোবোলোশন প্রতিযোগিতায় হয়েছেন তৃতীয়।

ড্রোন নিয়ে আমাদের দেশে কী করার পরিকল্পনা আছে, এমন প্রশ্নের জবাবে নাহিদ বলেন, ‘ড্রোন ব্যবহার করে আমরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো ক্যাম্পাসের অ্যারিয়াল ভিউ (আকাশ থেকে তোলা ছবি/ভিডিও) ধারণ করেছি। বাংলাদেশে এই প্রচেষ্টা এই প্রথম। এর মাধ্যমে সহজেই চিহ্নিত করা সম্ভব একটি এলাকার কোথায় কী আছে, কীভাবে আছে।’

12009709_10153918834037203_3537124005583816428_n
নাহিদের ড্রোন থেকে তোলা ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস।

এক গবেষণায় নাহিদ বের করেন ঢাকার যানজট কীভাবে দূর করা যায়। ‘গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস) প্রযুক্তির চালকবিহীন বিমান (ড্রোন) ব্যবহার করে যানজট সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।’ ঢাকার মিরপুরে নিজের গবেষণাগারে বসে এই কথা বলেন নাহিদ ফেরদৌস। বিষয়টি পরিষ্কার করেন তিনি। জানান, রাস্তায় প্রতি ২০০ মিটার দূরত্বে জিপিএসসহ ড্রোন রাখা যেতে পারে। দূর থেকে নিয়ন্ত্রিত এসব ড্রোন ট্রাফিক নিয়ে যেসব তথ্য সংগ্রহ করবে, সেগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনলাইন ডেটাবেইসে যুক্ত হবে। নাহিদ বললেন, ‘সরকার যদি এ বিষয়ে অনুমতি দেয়, প্রাথমিকভাবে পল্লবী থেকে মিরপুর পর্যন্ত তা আমি করে দেখাতে পারব, দুই মাসের মধ্যে। এ নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি সে ধরনের ড্রোন আমি ইতিমধ্যে তৈরি করেছি।

কৃষিক্ষেত্রেও ড্রোন ভূমিকার রাখতে পারবে বলে আশা নাহিদের। এক্ষেত্রে এক থেকে দুই কিলোমিটারের মতো বড় বড় কৃষিজমি ড্রোনের মাধ্যমে মনিটর করে জমি ও ফসলের কী অবস্থা, কোথায় কী করা প্রয়োজন এসব তথ্য সংগ্রহ করা যায়।সহায়তামূলক উদ্দেশ্য ছাড়াও বাণিজ্যিক কাজে ড্রোন ব্যবহারের পরিকল্পনাও আছে নাহিদের। ছবি তোলা এবং বিভিন্ন চলচ্চিত্র ধারণের কাজে আসতে পারে ড্রোন। পাশাপাশি পণ্য পরিবহনও করা সম্ভব হবে ড্রোন দিয়ে। তবে এর জন্য আগে প্রয়োজন উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া। নির্দিষ্ট পরিমাণ ভার বহনে সক্ষম ড্রোন দিয়ে পণ্য বহনের জন্য যে অঞ্চলের মধ্যে পরিবহন সেবা দেয়া হবে তার পুরোটাতেই নেটওয়ার্ক টাওয়ার বসাতে হবে।

তবে আমাদের দেশে এটি হতে এখনো দেরি আছে বলে মনে করেন নাহিদ। কারণ যথেষ্ট প্রযুক্তিগত সুবিধা এবং সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে পর্যাপ্ত সহায়তা ও সতর্কতা ব্যবস্থা এখনো বাংলাদেশে নেই।

নাহিদে ফেরদৌসের  কিছু ছবি ও ভিডিও। ইউটিউব লিঙ্ক : https://goo.gl/CImGI3

12719172_1245821408766708_5407918987559062628_o
পাখির চোখে বাংলাদেশ। নাহিদের ড্রোন থেকে তোলা ছবি।

favicon59

Sharing is caring!

Leave a Comment