পাথরে প্রাণ দেন সোহরাব
- ক্যাম্পাস ডেস্ক
সোহরাব তখন খুব ছোট। দাদির সঙ্গে গিয়েছিলেন কুমারপাড়ায়। ঘুরে ঘুরে দেখলেন তাঁরা ওদের কাজ। মাটির দলা থেকে পুতুল, ব্যাংক—কত কী বানাচ্ছে! অনেকগুলো মাটির ব্যাংক দেখলেন রোদে শুকাতে দেওয়া হয়েছে। একটি ব্যাংক কিনে দেওয়ার জন্য বললেন দাদিকে। কিন্তু তিনি নারাজ, ‘তুমি ছোট মানুষ, ব্যাংক দিয়ে কী করবে? বড় হও, তখন কিনে দেব। পয়সা জমাবে।’ তবে ব্যাংকের কথা ভুললেন না সোহরাব হোসেন। কিভাবে তারা বানায় সেগুলো, দেখে এসেছেন। বাড়ি এসে খেলার ছলে মাটি নিয়ে পড়ে থাকেন, ব্যাংক বানানোর চেষ্টা করেন। একসময় পাঁচ-ছয়টি বানিয়েও ফেললেন। সেই থেকে শুরু হলো তাঁর কোনো কিছুতে প্রাণ প্রতিষ্ঠার গল্প। কার্বন পেপারের ওপর ছবি এঁকে স্কুলের খাতা ভরে ফেললেন। কিছুদিন পর খাতার ওপর সরাসরি ছবি আঁকার হলো শুরু। ব্যানার, সাইনবোর্ডও লিখেছেন। তখন থেকেই তাঁর বাসনা, একদিন শিল্পী হবেন।
২০০৭ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করলেন। ঢাকায় এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে ভর্তি পরীক্ষাও দিলেন। তবে সুযোগ মিলল না। ভেঙে না পড়ে পরেরবার আবার ভর্তি পরীক্ষা দিলেন। এবার দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় তাঁর সুযোগ হলো। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে গেলেন। কেন চট্টগ্রামে ভর্তি হলেন? সোহরাব হেসে বলেন, ‘এখানে সৈয়দ আবদুল্লাহ আর অলক রায় আছেন। আমি আগে থেকেই তাঁদের কাজের ভক্ত। আমিও অলক স্যারের মতো বিখ্যাত কাঠ খোদাই শিল্পী বা আবদুল্লাহ খালেদ স্যারের মতো নামকরা স্থপতি হতে চাই।’
প্রথম ক্লাসেই অধ্যাপক অলক রায়ের নজরে পড়ে গেলেন নবীন ছাত্র। সেদিন মাটি দিয়ে একটি হাত বানিয়েছিলেন তিনি। সেটি দেখে অলক রায় এত খুশি হয়ে গেলেন যে সবার সামনেই বলে ফেললেন, ‘আরে, তুই তো একটা অ্যাটম বোমা।’ সেই কথাটি আজও ভুলতে পারেননি সোহরাব। এটিই তাঁর অনুপ্রেরণা।
তাঁর জীবনের বাঁকবদলের সঙ্গেও জড়িয়ে আছেন অলক স্যার। এই শিক্ষকের আমন্ত্রণে ২০১০ সালে জাপানের ভাস্কর হরি ইয়াসুজি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন। তাঁরা দুজনে বন্ধু। চারুকলা অনুষদের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে পাথরের ভাস্কর্য বিষয়ে সাত দিনের একটি কর্মশালা করালেন তিনি। তখন সোহরাব মাত্র দ্বিতীয় বর্ষে পড়েন। সেই কর্মশালায় অনার্স ফাইনাল ইয়ারের এবং মাস্টার্সের ছাত্রছাত্রীরাই শুধু সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু সোহরাবের ইচ্ছা, তিনিও এই কোর্স করবেন। চারুকলায় ইয়াসুজি যখন কাজ করেছেন, মুগ্ধ হয়ে দেখেছেন তিনি। ফলে স্যারের পেছনে লেগে থাকলেন এবং বিশেষ অনুমতি আদায় হলো। তবে সমস্যা হলো যন্ত্রপাতি নিয়ে। এই কর্মশালায় অংশ নেওয়ার সময় ছাত্রছাত্রীদের কাছে পাথর কাটার কিছু যন্ত্রপাতি থাকতে হয়, যাতে ইয়াসুজি যেভাবে বানাবেন, দেখে দেখে তাঁরাও সেভাবে পাথর কেটে ভাস্কর্য বানাতে পারেন। কিন্তু যন্ত্রপাতি কেনা তো দূরের কথা, সোহরাবের কাছে খাওয়ার টাকা পর্যন্ত নেই। বন্ধুবান্ধব, পরিচিতদের কাছ থেকে টাকা ধার করলেন। কর্মশালায় যোগ দিলেন। সাত দিনের এই কর্মশালায় শুরুর দিন ছাত্রছাত্রী ছিলেন ১৪ জন। পরদিন থেকে একজন বাদে আর কেউ এলেন না। কারণ প্রচণ্ড পরিশ্রম করে পাথর কাটতে হয়। অনেক কষ্ট হয় বলে কেটে পড়লেন তাঁরা। ইয়াসুজি একটিমাত্র ছাত্রকে টানা ছয় দিন ভাস্কর্য বানানো শেখালেন। প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার পর হাতুড়ি, বাটাল আর ছেনি দিয়ে একটি পাথরের পা বানিয়ে ফেললেন সোহরাব। সেটি দেখে সবচেয়ে খুশি হলেন তাঁর প্রিয় শিক্ষক। অলক রায় তাঁর বন্ধুকে বারবার শুধু একটি কথাই বলছিলেন, ‘ইয়াসুজি, আমার ছাত্র পেরেছে।’ তারপর টানা ১৯টি দিন এই আগ্রহী ছাত্রকে পাথরে প্রাণ প্রতিষ্ঠার কৌশলগুলো শিখিয়ে গেলেন জাপানের শিল্পী। তার পর থেকে নিজে নিজে কাজ করছেন সোহরাব।
চট্টগ্রামের জামালখান রোডের গোলচত্বরে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে তৈরি পূর্ব বাংলার প্রথম মুসলমান এমবি ও কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের স্বর্ণপদকজয়ী চিত্সিক ড. এম এ হাশেমের যে প্রতিকৃতিটি আছে, সেটি সোহরাবের করা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ম্যুরালগুলো আছে, সেখানকার পাথরগুলোর গায়ে ক্যালিগ্রাফি করেছেন তিনি। এ ছাড়া তিনি বানিয়েছেন ‘আলিঙ্গন’, ‘গোয়িং টু ডেস্ট্রয়’, ‘এক্সপ্রেশন-১’, ‘লাজুক’, ‘ঐক্য’। ভিকারুননিসার একটি প্রতিকৃতিও আছে তাঁর। মার্বেল ও পাথর দিয়ে তৈরি ‘আলিঙ্গন’ ভালোবাসার প্রকাশ। নারী-পুরুষ ছোট-বড়, ধনী-গরিব—সব রকমের ভালোবাসার জন্য দুটি পক্ষের প্রয়োজন হয়। সে বিষয়টিই উঠে এসেছে তাঁর এই ভাস্কর্যে। আর ‘গোয়িং টু ডেস্ট্রয়’ হলো নানা কারণে আমাদের এই পৃথিবী যে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, সেই বিষয় নিয়ে মার্বেল পাথরের ভাস্কর্য। সোহরাবের তৈরি দুর্ভেদ্য হলো একটি পাখির ভাস্কর্য। আর পাথর ও মাটি দিয়ে বানানো ‘ঐক্য’ হলো স্বাধীনতার ওপর তৈরি ভাস্কর্য, সেখানে ১১টি সেক্টরের ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ স্বাধীন করার জন্য লড়াইয়ের গল্প।
কিভাবে কাজ করেন—এই প্রশ্নের জবাবে হেসে ফেলেন সোহরাব। পরে বলেন, ‘সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যতক্ষণ আলো থাকে কাজ করি।’ প্রতিটি ভাস্কর্যের পেছনে তাঁর ভাবনা, ভালোবাসা মিশে আছে। যেমন—রাস্তাঘাটের, বাসাবাড়ির ময়লা-আবর্জনা দূর করতে একজন সচেতন নাগরিকের কর্তব্য কী হওয়া উচিত, সেটি নিয়ে তৈরি ‘দ্য ক্লিনার’। এখন তিনি স্টোন কার্ভিংয়ের ওপর প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য তিন মাসের ইন্টার্নশিপে দক্ষিণ কোরিয়ার মোসান আর্ট মিউজিয়ামে আছেন। ফিরে এসে নতুন করে, অন্য রকমভাবে পাথরে প্রাণ দেওয়াই সোহরাব হোসেনের ইচ্ছা।