ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় বাংলাদেশের জেবা

ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় বাংলাদেশের জেবা

  • জেবা খান

যখনই আমি নতুন কোনো দেশে পা রাখার স্বপ্ন দেখি, কল্পনায় দেখতে পাই—দুটো স্যুটকেস হাতে আমি বিমান থেকে নামছি। চোখের সামনে একটা অচেনা শহর, হাজারো লাল-নীল রঙের বাতি। একেকটা বাতি, একেকটা উজ্জ্বল স্বপ্ন! যদিও কানাডার ভ্যানকুভারে পা রাখার সময় স্বপ্ন আর বাস্তবতার মিল হয়নি। শহরভর্তি লাল-নীল স্বপ্ন ছিল ঠিক, কিন্তু আমার স্যুটকেস দুটো কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলাম না!

একটা নতুন জায়গায় পা রেখে প্রথম দিনই লাগেজ হারিয়ে ফেলাটা মোটেও কোনো ভালো কথা না। ব্যাগভর্তি জ্যাকেট, জরুরি কাগজপত্র এবং তার চেয়েও বড় কথা—বাসা থেকে বয়ে আনা বহু মূল্যবান কিছু পুরোনো ছবি—সব হারিয়ে আমার তখন দিশেহারা অবস্থা। প্রচণ্ড ঠান্ডা থেকে নিজেকে বাঁচানোর কোনো উপায়ই আমার ছিল না। সেপ্টেম্বরের কনকনে শীতের একরাতে শুরু হয়েছিল আমার অভিযান।
ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় পা রাখার আগের দিন রেস্তোরাঁয় খেতে গেছি। রাতের খাবারও প্যাক করে দিতে বলেছিলাম। বাসায় ফিরে আবিষ্কার করলাম, পরদিন ক্লাস শুরু করব, সেই রোমাঞ্চে আমি খাবার নিয়ে আসতে ভুলে গেছি। ততক্ষণে অনেক রাত হয়ে গেছে। কোনো দোকান খোলা নেই। সারা রাত না খেয়েই থাকতে হয়েছিল। এখানে একটা কথা বলে রাখি, শুরুর দিকে আমি যে কতবার ভুল বাসে উঠে ভুল রাস্তায় চলে গেছি, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। তাই মাঝরাতে খাবার খুঁজতে বের হওয়ার সাহস আমার ছিল না। খুব মনে পড়ছিল দেশের কথা। যেখানে মা আমার জন্য খাবার নিয়ে বসে থাকতেন। দেশে হারিয়ে যাওয়ার ভয় ছিল না, কারণ ভাইয়েরা আমাকে সঙ্গ দিত।
অবশেষে সেই দিনটা এল, যেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডর্মে আমার জায়গা হলো। সেদিনই প্রথম ক্যাম্পাসটা ঘুরে দেখলাম। আগের রাতে ঘুম হয়নি। ভাবছিলাম, কেমন হবে আমার নতুন জীবন? মনে হচ্ছিল, প্রথম দিনই আমি বোধ হয় ভয়ের চোটে সবার সামনে ধপাস করে পড়ে যাব, আর বাকি জীবন এ ঘটনার জন্যই সহপাঠীরা আমাকে মনে রাখবে!
ইউবিসির ভাষায়, প্রথম দিনটাকে বলে ‘ইমাজিন ডে’। এটা নবীনবরণের চেয়ে একটু বেশি কিছু। আমাদের সবাইকে ছোট ছোট দলে ভাগ করা হয়েছিল, প্রতিটা দলে একজন দলনেতা। আমাদের দলনেতা আমাদের পুরো ক্যাম্পাস ঘুরে দেখালেন। সব শেষে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে জড়ো হলাম। ডিনের বক্তৃতা শুনলাম। তারপর যাদের ক্লাস ছিল, তারা চলে গেল ক্লাসে। আমার কোনো ক্লাস ছিল না, তাই ডর্মে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম।

পরদিন ভিরু ভিরু পায়ে ক্লাসে হাজির হলাম। যতটা রোমাঞ্চিত ছিলাম, ঠিক ততটা নার্ভাসও। ক্লাসে বসে মনে হলো, একদল মেধাবী মানুষের মধ্যে আমার জায়গা হয়েছে। ক্লাস শেষ হওয়ার আগেই মনে মনে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম, এখান থেকে আমি নিশ্চয়ই অন্য একটা মানুষ হয়ে বের হব। যাকে নিয়ে নিঃসন্দেহে গর্ব করা যায়!

এসব ভাবতে ভাবতেই ক্লাস থেকে ডর্মে ফিরছিলাম। তখনো জানতাম না, ঘরের দরজার কাছে আমার জন্য একটা বড় চমক অপেক্ষা করছে। হ্যাঁ, চমকটা ছিল আমার হারিয়ে যাওয়া স্যুটকেস! এয়ারলাইনস কোম্পানিটি স্যুটকেসগুলো পৌঁছে দিয়েছিল। স্যুটকেস ভর্তি আমার জামা, ছবি, কাগজগুলো পেয়ে হঠাৎ কেন যেন মনে হলো, এই শহরে আমি আর একা নই!

জেবা খান, বিজ্ঞান বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা।   সূত্র : প্রথম আলো।favicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment