দেশে ফেরার অপেক্ষায় ফারজানা

দেশে ফেরার অপেক্ষায় ফারজানা

  • ক্যাম্পাস ডেস্ক

যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ওয়েলসে ফারজানা রহমান পিএইচডি করছেন ‘কম্পিউটেশনাল বায়োলজি’ নিয়ে। কম্পিউটেশনাল বায়োলজি? একটু কি খটমটে মনে হচ্ছে? ফারজানা বুঝিয়ে বললেন, ‘কম্পিউটেশনাল বায়োলজি ও বায়োইনফরমেটিকস কম্পিউটার বিজ্ঞানের এমন একটি ক্ষেত্র, যেখানে গবেষকেরা গণিত ও পরিসংখ্যানের বিভিন্ন বিশ্লেষণাত্মক কৌশল কাজে লাগিয়ে জীববিদ্যার জটিল সব প্রশ্নের উত্তর পেতে চেষ্টা করেন। মূলত অণুজীববিজ্ঞানের আধুনিক গবেষণায় এর ব্যবহার রয়েছে।’ ফারজানা কাজ করছেন উদ্ভিদ ও প্রাণীতে বিষক্রিয়া ছড়ায় এমন ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য অণুজীবের উৎপত্তি এবং বিকাশের বিভিন্ন দিক নিয়ে।

সারা বিশ্বে কম্পিউটেশনাল বায়োলজি নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা আছে—ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কম্পিউটেশনাল বায়োলজি বা আইএসসিবি। ২০১৮ সালের জন্য এই সংস্থার তরুণ শাখা ‘স্টুডেন্ট কাউন্সিল ফর কম্পিউটেশনাল বায়োলজি’ (iscbsc.org)-এর সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন বাংলাদেশের এই তরুণ। বিস্তারিত শুনব। তার আগে চলুন, ভিকারুননিসা নূন স্কুল থেকে শুরু করে ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ওয়েলস অবধি যাত্রার গল্পটা শোনা যাক।

স্বপ্নযাত্রার শুরু
d05d8355598bfc8aeab1c4a9a5df8dce-58c4421a99e74
প্রকৌশলী বাবা মমতাজুর রহমান, বড় বোন চিকিৎসক ফারহানা রহমান আর মা রওশন আরা রহমানের অণুপ্রেরণাকে পুঁজি করে কিশোর বয়স থেকেই ভিন্ন কিছু করার তাগিদ অনুভব করতেন ফারজানা। ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজ থেকে ২০০১ সালে এসএসসি এবং ২০০৩ সালে এইচএসসি পাস করে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমান যুক্তরাজ্যে। যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ওয়েলসে স্নাতক শেষ করেন তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিষয়ে। স্নাতক পড়ার সময়ই শিক্ষানবিশ গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন ‘বশ ইঞ্জিনিয়ারিং’ কোম্পানির যুক্তরাজ্য শাখায়। তখন থেকেই গবেষণায় আগ্রহ ছিল তাঁর। ফলাফল, শেষ বর্ষের গবেষণাপত্রের জন্য বশ-এর পক্ষ থেকে শিক্ষাবৃত্তি পান তিনি।

২০১১ সালে অংশ নেন কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োইনফরমেটিকস-বিষয়ক একটি যৌথ প্রকল্পে। এর কিছুদিন পরেই ফুজিৎসু ল্যাবরেটরিজ ইউরোপের বৃত্তি নিয়ে প্রফেসর ডেনিস মারফির তত্ত্বাবধানে পিএইচডি গবেষণা শুরু করেন ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ওয়েলসে। পিএইচডির পাশাপাশি ২০১১ সাল থেকে খণ্ডকালীন প্রভাষক হিসেবে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন তিনি।

জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে
২০০৯ সাল থেকে ফারজানা কাজ করছেন ব্রিটেনের একটি সরকারি প্রকল্প—এসটিইএমের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে। ‘আমরা ওয়েলসের স্বল্পোন্নত এলাকার প্রাথমিক ও নিম্নমাধ্যমিক স্কুলগুলোতে গিয়ে বিজ্ঞান-বিষয়ক সচেতনতা গড়ে তোলার কাজ করি। এই কাজ করতে গিয়ে একটা মজার ব্যাপার লক্ষ করলাম। সব দেশের শিশুরা আসলে একই রকম। ঠিকভাবে উদ্বুদ্ধ করতে পারলে তারা বিজ্ঞানের বিষয়ে আগ্রহী হয়।’ বলছিলেন তিনি।

কম্পিউটেশনাল বায়োলজি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে ফারজানা দেখলেন, স্নাতকোত্তর পর্যায়ে এই বিষয়ে পড়ালেখা করে এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা তুলনামূলক কম। কারণ, বিষয়টি এখনো নতুন। এই বিষয়ের সহপাঠী খুঁজতে গিয়েই ফারজানা সন্ধান পান আইএসসিবির।

আইএসসিবির এই তরুণ শাখার উদ্দেশ্য বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কম্পিউটেশনাল বায়োলজিস্টদের উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা। স্টুডেন্ট কাউন্সিলের সদস্য শিক্ষার্থীরা প্রতিবছর বিভিন্ন দেশে আলোচনা সভা, বৈজ্ঞানিক কর্মশালা ও সম্মেলন আয়োজন করে। ‘আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের শিক্ষার্থীদের বৃত্তি ও শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করার সুযোগও করে দেয় আইএসসিবি স্টুডেন্ট কাউন্সিল।’ বলেন ফারজানা।

বিশ্বব্যাপী ৩০টির বেশি দেশে কার্যক্রম থাকলেও যুক্তরাজ্যে আইএসসিবি স্টুডেন্ট কাউন্সিলের কোনো শাখা ছিল না। ফারজানা বলছিলেন, ‘বিষয়টা আমাকে অবাক করল। মজা লাগল এই ভেবে যে সংগঠনের প্রবীণ বিজ্ঞানীরা অনেকেই যুক্তরাজ্যের। অথচ যুক্তরাজ্যে তরুণদের শাখা নেই। ভাবলাম ভিনদেশে এসে দায়িত্বটা তাহলে আমাকেই নিতে হয়!’

যেই ভাবা সেই কাজ। লন্ডনপ্রবাসী ভারতীয় বাঙালি সায়নি দাস, রহিত ফার্মার আর নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক স্বদেশি সহকর্মী মেহেদি হাসানকে নিয়ে ফারজানা আইএসসিবি স্টুডেন্ট কাউন্সিলের যুক্তরাজ্য শাখার নাম নিবন্ধন করেন। সেই থেকে গত পাঁচ বছর ধরে অংশ নিয়েছেন একাধিক উদ্যোগে। ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন ও যুক্তরাজ্যের ওয়েলসে, ২০১৫ সালে আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন ও যুক্তরাজ্যের নরউইচে শিক্ষার্থী সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি।

আইএসসিবি স্টুডেন্ট কাউন্সিল একটি গণতান্ত্রিক সংগঠন। প্রতিবছর সদস্যদের ভোটে এর সভাপতি নির্বাচিত হন। সদস্যদের ভোটেই ২০১৮ সালের স্টুডেন্ট কাউন্সিলের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন ফারজানা রহমান।

দেশে ফেরার অপেক্ষায়
ফারজানার পিএইচডি গবেষণা প্রায় শেষের পথে। গবেষণা শেষ করে বাংলাদেশের গবেষণাকেন্দ্রে কাজ করতে চান তিনি। বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের নিয়ে গঠন করতে চান আইএসসিবি স্টুডেন্ট কাউন্সিলের জন্য ‘রিজওনাল স্টুডেন্ট গ্রুপ’ বা আরএসজি, যে সংগঠন দেশের শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন ছোঁয়ার পথ সহজ করে দেবে।

ফারজানা আশা করছেন, তাঁর পিএইচডি গবেষণা দেশের কৃষি খাতে কাজে আসবে। তিনি বলেন, ‘আমার গবেষণার সাফল্যের ওপর নির্ভর করে আমাদের দেশের ফসল, খাদ্য ও কৃষি খাতের গবেষণায় ভালো কিছু করা সম্ভব।’

সূত্র: প্রথম আলোfavicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment