অনুকরণীয় রাসেল

অনুকরণীয় রাসেল

  • ক্যাম্পাস ডেস্ক

ঘাতক ব্যাধি তাঁর শরীরে বাসা বেঁধেছে। তার পরও পরিবেশ বাঁচাতে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবেশ সংসদ’ গড়ে তুলেছেন শাহীন রেজা রাসেল। ক্যাম্পাসের গাছ বাঁচিয়েছেন, ময়লা পরিষ্কার করেছেন।


তখন সে নাইনে পড়ত। হঠাৎ জ্বর হলো। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে জানা গেল, তার রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। রোগটি দুই পা থেকে আস্তে আস্তে শরীরে ছড়িয়ে পড়বে, সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অকেজো হয়ে যাবে। বিশ্বখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংও এ রোগে আক্রান্ত। ডাক্তার বললেন, ‘১০-১২ বছর তুমি মোটামুটি ভালো থাকবে। এরপর থেকে হুইলচেয়ারে চলতে হবে। ’ খবরটি শোনার পর থেকে দুরন্ত কিশোরটি খুব ভেঙে পড়ল। একটি বছর একা একাই কাটল। পড়ালেখা হয়নি। বিকেলে মাগুরার কুমার নদের তীরে হাঁটত। নির্জনে বসে ভাবত। চোখ ফেটে জল গড়াত। ছোটবেলা থেকে বইপ্রেমী ছেলেটি বইকে আরো আঁকড়ে ধরল। দুই কিলোমিটার দূরের কাজলী গ্রামের গণকেন্দ্র পাঠাগার থেকে বই এনে রাত জেগে পড়ত। ডেল কার্নেগির বই পড়েই সে বাঁচার প্রেরণা পেল। সেই থেকে প্রকৃতিপ্রেমী ছেলেটির গাছ, ফুল, নদী, পাখির প্রতি মায়া আরো বেড়ে গেল।

ছোটবেলা থেকে শাহীন রেজা রাসেলের পরিবেশবিদ ইনাম আল হককে ভালো লাগে। তাঁর লেখা যেখানে পায়, পড়ে। স্কুলে বন্ধুদের নিয়ে বার্ড ক্লাব গড়েছিল। সবাই মিলে পাখি দেখতে যেত। আহত পাখির যত্ন নিত। মানুষকে বোঝাত, ‘পাখি মারবেন না, বন্দি করবেন না। ওরা প্রকৃতির সম্পদ।’ প্রাথমিকের পাঠ শেষে চলে যাওয়ার সময় বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে স্কুলে কটি গাছও লাগিয়েছিল। কলেজে পড়ার সময় শ্রীপুরে ‘প্রজ্জ্বলন’ নামে একটি সংগঠন গড়েছিল তারা। সবাই মিলে শ্রীপুর শহরে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালাত, গাছ লাগাত, সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও করত।

২০০৫ সালে রাসেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন’ বিভাগে ভর্তি হলেন। কিছুদিন পর বন্ধুদের নিয়ে ‘তীরন্দাজ’ নামে একটি নাট্যদল তৈরি করলেন। সেই থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোথাও গাছ বা গাছের ডাল কাটা হচ্ছে শুনলেই ছুটে যান তিনি। গাছ কাটার প্রতিবাদ করেন। তাঁর চেষ্টায় এসএম হলের সামনের কড়ইগাছগুলো বেঁচেছে। হাকিম চত্বরের প্রাচীন কড়ইটিও তিনি বাঁচিয়েছেন। ২০১২ সালে কোরবানির বন্ধের সময় হঠাৎ শুনলেন, ভাষা ইনস্টিটিউটের পেছনের কাঁঠালগাছটির পাতা বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে দেখলেন পাতা, ডাল কেটে গাছটিকে মেরে ফেলা হচ্ছে। প্রক্টরকে ফোন করে বললেন, ‘স্যার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কাঁঠালগাছের পাতা দুই হাজার টাকার জন্য বিক্রি করাটা আমাদের জন্য লজ্জাজনক। ’ স্যার ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে ভাষা ইনস্টিটিউটের পরিচালককে ফোন করে কাজ বন্ধ করে দিলেন। পরিচালক স্যারও ‘সরি’ বললেন।

তখন থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গাছগুলোকে চেনা শুরু করলেন তিনি। উপ-উপাচার্য স্যারের বাসভবনের আঙিনায় দুর্লভ তালিপাম, কলা ভবন, মল চত্বরের মহুয়া, টিএসসির সামনে বৌদ্ধ নারিকেলগাছ চিনেছেন। ক্যাম্পাসের কোথায় কোন গাছ আছে, এখন তিনি জানেন। ক্যাম্পাসের পাখির বাসাগুলোও তাঁর চেনা। রাসেল বললেন, ‘উপাচার্য ভবনের সামনের কড়ই, টিএসসির সুইমিংপুলের পাশে প্রাচীন মঠে দুটিতে টিয়া পাখির বাসা আছে। এসএম হলের সামনের কড়ইগাছে হুতুম পেঁচার বাসা আছে। ভুবনচিল জগন্নাথ ও শানসুন্নাহার হলের মাঝের তেলশুরগাছে সংসার পেতেছে।’ অনেকবার তিনি ঝড়-বাদলে আহত পাখির ক্ষতে ওষুধ লাগিয়ে কাপড় বেঁধেছেন, খাবার খাইয়ে সুস্থ করে উড়িয়ে দিয়েছেন, খুব আহতদের আলাউদ্দিন রোডের কেন্দ্রীয় প্রাণী হাসপাতালে নিয়ে গেছেন।

ক্যাম্পাসের ময়লা, গাছের ঝরা পাতা জড়ো করে গাছের নিচে পোড়ানো হয়। ফলে পরিবেশ দূষিত হয়, যে গাছের গোড়ায় আবর্জনা পোড়ানো হয়, সেটি ধীরে ধীরে মরে যায়। রাসেল ভিসি স্যারকে বলে এই অন্যায় অনেকটাই বন্ধ করেছেন। এসব করতে গিয়ে অনেকের সঙ্গেই পরিচয় হয়েছে। সবাইকে নিয়ে ২০১১ সালের ৫ জানুয়ারি তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম পরিবেশ সংগঠন ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবেশ সংসদ’ প্রতিষ্ঠা করলেন। প্রথম দফায় কর্মী হিসেবে যোগ দিলেন ৪০০ শিক্ষার্থী! গেল ছয় বছরে এই পরিবেশকর্মীদের অর্জন কম নয়। রাসেলের তত্ত্বাবধানে ক্যাম্পাসে তাঁরা ৩৫টি পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালিয়েছেন, সাধারণ মানুষ ও ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সচেতনতামূলক লিফলেট বিলি করেছেন, নানা জায়গায় স্টিকার সাঁটিয়েছেন।

পহেলা বৈশাখে হাজারও মানুষ ক্যাম্পাসে বেড়ান। ফলে ক্যাম্পাস নোংরা হয়ে যায়। তাই পহেলা বৈশাখের পরদিন নোংরা ক্যাম্পাস তাঁরা পরিষ্কার করেন। এ ছাড়া পরিবেশ বিষয়ে ছাত্রছাত্রীদের সচেতন করতে তাঁরা টিএসসিতে নাটক, যাত্রাপালা  করেন। রাসেলের রচনা ও নির্দেশনায় ‘হোয়াইট হাউস থেকে শান্তিপুর’ ও ‘৩০ লক্ষ গাছ’ নাটকের ৫০টির বেশি শো হয়েছে। তিনি বললেন, “আমাদের সবচেয়ে বড় কাজ ‘পরিবেশগত নিরাপত্তা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক তিন মাসের কর্মশালা করা।” দক্ষ পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মী গড়ে তুলতে তাঁর পরিকল্পনা ও পরিচালনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবেশ সংসদ মোট আটটি কর্মশালা করেছে। সেগুলোর মাধ্যমে ৭০০ পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মী তৈরি হয়েছেন। কর্মশালায় বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের অধ্যাপক, সামরিক-বেসামরিক পদস্থ কর্মকর্তা, পেশাজীবী, বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা অংশ নিয়েছেন। এ ছাড়া ‘এনভায়রনমেন্টাল ডিজাস্টার অ্যান্ড পসিবল মিটিগেশন অ্যান্ড অ্যাডাপটেশন মেজারস’ নামে ১০ বার এক দিনের কর্মশালা আয়োজন করেছেন। সেগুলোতে অন্তত বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারখানেক ছাত্র-ছাত্রীকে ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের অধ্যাপকরা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। ২০১২ থেকে ২০১৪ সালে তাঁরা ফায়ার সার্ভিসের সাহায্যে শতাধিক ছাত্র-ছাত্রীকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবেলায় প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।

২০১৬ সালের ৫ এপ্রিল বাবুপুরা পুলিশ ফাঁড়ির ভেতর বেশকিছু শতবর্ষী গাছ পুলিশ অনুমতি ছাড়াই কেটে ফেলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জমিতে বিশ্ববিদ্যালয়কে না জানিয়ে বহুতল ভবনের কাজও শুরু করে। খবর পেয়ে পরিবেশ সংসদের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে গাছ কাটতে বাধা দেন, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেন। পরে গাছকাটা বন্ধ হয়, ভবন নির্মাণও বাতিল হয়। টিএসসি ও রোকেয়া হলের মাঝের খোলা ডাস্টবিনটি পুরো এলাকা নোংরা, দুর্গন্ধ করে রাখত। তাঁরা উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলে ডাস্টবিনটি সরিয়েছেন। ২০১২-১৩ সালে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০০-রও বেশি ছোট ডাস্টবিন স্থাপন করেছেন। এ ছাড়া জাপানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে পরিবেশ নিয়ে দুবার মতবিনিময় করেছেন। নিয়মিত পরিবেশ, ধরিত্রী, ওজোন, পানি, বাঘ, দুর্যোগপ্রশমন দিবস পালন করছেন। প্রতিবছর শীতার্তদের শীতবস্ত্র বিতরণ, পরিবেশবিষয়ক চলচ্চিত্র-আলোকচিত্র প্রদর্শনী, সেমিনার, গোলটেবিল বৈঠক, পাখি অবমুক্তকরণ, গাছ বিতরণসহ অনেক কর্মসূচি পালন করেন।

টানা চার বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবেশ সংসদের সভাপতি ছিলেন শাহীন রেজা রাসেল। এখন তিনি কার্যনির্বাহী উপদেষ্টা। তাঁর পরিকল্পনা ও চিত্রনাট্যে সংসদ ‘ওয়াটার কন্টামিনেশন’ তথ্যচিত্র বানিয়েছে। শীতলক্ষ্যা-বুড়িগঙ্গার দূষণ নিয়ে তৈরি এ তথ্যচিত্রটির ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় শখানেক শো হয়েছে। সুন্দরবনের বাঘের অভয়ারণ্যে অবৈধভাবে ঢুকে সাতক্ষীরার দক্ষিণ দাতিনাখালী গ্রামের অনেক পুরুষ বাঘের হামলায় নিহত হয়েছেন। তাঁদের স্ত্রীদের ‘বাঘবিধবা’ বলা হয়। তাঁদের নিয়ে রাসেলের চিত্রনাট্য ও পরিকল্পনায় বানানো ‘বাঘবিধবা’তে সেই নারীদের দুর্দশার কথা আছে। সেখানে বাঘের অভয়ারণ্যে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে একে সংরক্ষণের কথাও তিনি বলেছেন। এটির ১৫০টির বেশি শো হয়েছে। পরিবেশবান্ধব ভ্রমণকে জনপ্রিয় করতে তিনি এ পর্যন্ত চারটি ইকো ট্যুর পরিচালনা করেছেন। ভ্রমণগুলোতে তাঁরা সেসব এলাকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য নিয়ে গবেষণা করেছেন। পরিবেশ রক্ষায় স্থানীয়দের সচেতন করেছেন।

আপনাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা? রাসেল বললেন, “এক বছরের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি গাছে সেগুলোর নাম ও গুণাগুণসহ নামফলক বসাব। মলচত্বরের গাছগুলোতে যেন পাখিরা বাসা বানাতে পারে, সে জন্য ছোট ছোট কলসি বেঁধে পাখির অভয়ারণ্য গড়ে তোলা হবে। এ কাজটি সারা ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে দেব। এ বছরের নভেম্বরে ক্যাম্পাসে ‘পরিবেশ উৎসব’ করব। উৎসবটি আমরা প্রতিবছর করতে চাই। তাতে পরিবেশ নিয়ে কাজ করা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবেশ পদক’ দিতে চাই।” তিনি দুঃখ করে বললেন, ‘আমাদের অনেক স্বপ্ন, পরিকল্পনা আছে। কিন্তু টাকার অভাবে অনেক কাজ করতে পারি না। সদস্যদের চাঁদা, সামান্য স্পনসরশিপ ও কর্মশালার সামান্য রেজিস্ট্রেশন ফি দিয়ে আমাদের সংগঠন চলে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বার্ষিক অনুদানও পাই না। অথচ আমাদের ২০০-র বেশি নিয়মিত সদস্য আছেন।’ এসব বলে তিনি ম্লান হেসে জানালেন, ‘প্রতি বর্ষায় আমরা ক্যাম্পাসে মেহগনি, বকুল, কদমসহ নানা জাতের চারা রোপণ করি। আমাদের লাগানো শ-তিনেক গাছ বড় হয়ে গেছে।’ গেল বছর থেকে এই মানুষটি হুইল চেয়ারে চলাফেরা করেন। এখন তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ‘পরিবেশ বিপর্যয়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব’ নিয়ে এমফিল করছেন।

সূত্র: কালের কণ্ঠfavicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment